মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১০ ১৪৩১

৩৪ জনের দখলে কালিয়ানী খাল

যুগের চিন্তা অনলাইন

প্রকাশিত: ৯ জুন ২০২১  

১৫ হাজার ৮শ ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যরে কালিনীর বুক বিদীর্ন করে বিশাল বিশাল স্থাপনা গড়েছেন ৩৪ জন দখলদার। এরমধ্যে রয়েছে ১৭টি শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং বাকি ১৭টি আধাপাকা বসত ঘর। এছাড়া, মিল ফ্যাক্টরীর পলিথিন বর্জ্যসহ স্থানীয়দের নানাবিধ বর্জ্যরে ভাগাড়েও পরিণত হয়েছে এক সময়ের প্রবাহমান কালিয়ানী বিল।  

 

স্থানীয়রা জানান, এক সময় পালতোলা নৌকা আর পণ্যবাহী ট্রলার দাপিয়ে বেড়াতো ফতুল্লার কালিয়ানী বিলে। এর স্বচ্ছ পানিতে জলকেলিতে মত্ত থাকতেন স্থানীয়রা। তবে, শিল্পায়নের কবলে পরে কালিয়ানী বিল পরিণত হয়েছিল খালে। সময়ের বিবর্তনে বিল থেকে খালে পরিণত হওয়া এই কালিয়ানী এখন কেবলই রূপ কথার গল্প। কেননা খালও এখন আর নেই! নেই এর পানি প্রবাহ। উপর্যোপুরি দখলদারিত্বে সরু নালায় পরিণত কালিয়ানী যেন কাঁদছেন অস্তিত্ব হারানোর বেদনায়। সেই কান্না হয়তো শুনতে পায়না দখলদার কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।  

 

সরেজমিনে দেখা যায়, মূলত বুড়িগঙ্গা থেকে সৃষ্ট কালিয়ানী এনায়েতনগরের ধর্মগঞ্জ এলাকা দিয়ে হরিহরপাড়া, আমতলা, শাসনগাঁও, বিসিক, মাসদাইর ও বাড়ৈভোগ হয়ে কাশীপুর ইউনিয়নের বুক চিরে বহমান। তা মিশেছে শীতলক্ষ্যার বুকে। ঐতিহ্যবাহী এই খাল জুড়ে এসব এলাকার প্রভাবশালীরা চালিয়েছেন দখলদারির রামরাজত্ব। খাল ভরাট করে কেউ গড়ে তুলেছেন ইটপাথুরে অট্টালিকা, আবার কেউবা গড়েছেন নামি-দামি শিল্প কারখানা। এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের বিষয়ে চেষ্টা চালানোর কথা জানিয়েছিলেন এনায়েতনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান।

 

তবে, উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে কার্যকরি কোন সিদ্ধান্ত না আসায় ইচ্ছে থাকলেও সম্ভব হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। দৈনিক যুগের চিন্তাকে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘খালের অস্তিত্ব এখন নেই বললেই চলে। যতটুকু আছে, তাও আবার ময়লা আবর্জনায় ঠাসা। খালের মধ্যে আসলাম সানী ও সালামসহ ফকিরা গার্মেন্টেস কর্তৃপক্ষ ও আরো প্রভাবশালী অনেকে ব্যক্তি শিল্প কারখানা গড়ে তুলেছে। কেউ কেউ বসত বাড়ি গড়ে তুলেছে। তাই খালটি অস্তিত্ব সংকটে। এতে করে বর্ষা মৌসুমে আমার ইউনিয়নবাসী ভয়ানক জলাবদ্ধতার শিকার হচ্ছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি বেশ কয়েকবার জানানো হয়েছে। এখনো কোন প্রতিকার পাচ্ছি না।’ 


অনুসন্ধানে দেখা যায় যায়, খালের মাসদাইর ও হরিহরপাড়া মৌজা এলাকায় ৭ ফুট প্রস্থ ও ৪৫০ ফুট দৈর্ঘ্য জায়গা দখল করে নির্মিত হয়েছে আঃ সালাম এর মালিকানা নেভী গার্মেন্টস,  হরিহরপাড়া মৌজায় ৫ ফুট প্রস্থ আর ১২০ ফুট দৈর্ঘ্য জায়গা জুড়ে রয়েছে মোঃ কাশেম এর এম.এস ফ্যাক্টরী, বিসিক ৩নং গেইট ও বাউন্ডারী দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে খালের ৪০ ফুট প্রস্থ ও ২০ ফুট দৈর্ঘ্য জুড়ে, এর পাশেই ৫ ফুট প্রস্থ ও ৯০ ফুট দৈর্ঘ্য পরিমাণ খাল ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে ফকির মনিরুজ্জামানের প্রতিষ্ঠান ফকির নীট ওয়্যার, হরিহরপাড়া ও বাড়ৈভোগ মৌজা এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া খালের ১২ ফুট প্রস্থ ও ২৫ ফুট দৈর্ঘ দখল করে ট্রাইকট ফ্যাশন লি. নামক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে কাজী জৈনউদ্দিন ইফতেখার।

 

সমপরিমাণ খালের জায়গা দখল করে পাশেই গড়ে উঠেছে ইব্রাহিমের পেন টেক্স লিঃ, এর পাশে ৫ ফুট প্রস্থ আর ৩৫ ফুট দৈর্ঘ্যরে খাল দখল করে দাঁড়িয়ে আছে ফ্রিডম এ্যাপারেলস্, বাড়ৈভোগ এলাকায় খালের পৃথক ৪টি স্থানে প্রায় ৮ ফুট প্রস্থ ও ৪৫০ ফুট দৈর্ঘ জুড়ে অবস্থিত ফকির মনিরুজ্জামানের ফকির এ্যাপারেল্সের ৪টি অংশ, হরিহরপাড়া এলাকায় খালের ৪ ফুট প্রস্থ ও ২০ ফুট দৈর্ঘ্যে হাসানের মালিকানা জীবন এ্যাপারেল্স, একই এলাকায় ২০ ফুট দৈর্ঘ্য জুড়ে এস.এম ফ্যাক্টরী লিঃ, এনায়েতনগর এলাকায় ৩ ফুট প্রস্থ আর ১০ ফুট দৈর্ঘ্য জায়গায় মোক্তারের এ্যাপোলো বেকারী, হরিহরপাড়া এলাকায় ইউসুফ রহমানের মার্টিন গার্মেন্টস এর গর্ভে ঢুকেছে খালের প্রায় ১৭ ফুট প্রস্থ আর ৬০ ফুট দৈর্ঘ্য পরিমাণ জায়গা, হরিহরপাড়া এলাকায় ১৪ ফুট প্রস্থ ও ২৮ ফুট দৈর্ঘ দখল করে আসলামের এভারগ্রীন, একই এলাকায় ৩৫ ফুট প্রস্থ ও ৫৫ ফুট দৈর্ঘ্য দখল করে সানীর ক্রোনী গ্রুপ, মাসদাইর ও হরিহরপাড়া এলাকায় ৭ ফুট প্রস্থ ও ৪৫০ ফুট দৈর্ঘ্য খাল দখল করে বালু ভরাটসহ মাওলানা সালিম এর মালিকানা এমএস ডাইং এন্ড প্রিন্টিং কারখানা গড়ে উঠেছে।


এছাড়া, হরিহরপাড়া এলাকার মনোয়ার হোসেন, পার্শ্ববর্তী মনির হোসেন, ডাক্তারের বাড়ি, হরিহরপাড়ার রাকিবুল, জাফর হালদার, বাড়ৈভোগ এলাকায় সুরুজ্জামানের মেয়ের জামাই, একই এলাকার সেলিম সরদার, হরিহরপাড়ার আজগর সরদার, ইউসুফ রহমান, আব্দুল আলী, আমান উল্লাহ, রাজ্জাক ওরফে গগন মিয়া, মৃত মোবারক, রহমান, মুকুল ও সুরুজ মিয়া। এদের মধ্যে কেউ কেউ প্রস্থে সর্বনি¤œ ৫ ফুট থেকে সর্বোচ্চ ২৮ ফুট এবং দৈর্ঘ্যে সর্ব নি¤œ ১০ ফুট থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৯০ ফুট পর্যন্ত দখলে নিয়ে বসতঘর গড়েছেন। পরিসংখ্যানগত দিক থেকে দখল-দারিত্বের এই মহোৎসবে এগিয়ে রয়েছে এনায়েতনগর ইউনিয়নের হরিহরপাড়া মৌজাভুক্ত এলাকা। এরপরের স্থানেই আছে বাড়ৈভোগ ও বিসিক শিল্প অঞ্চলটি।  

 
দখল দারিত্বের এই চিত্র বহু পুরনো হলেও এর বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন আদৌ কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কি না তা জানতে চাইলে এনায়েতনগর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. মাহাবুব হোসেন দৈনিক যুগের চিন্তাকে জানান, ‘এদের উচ্ছেদের বিষয়ে জেলা প্রশাসকসহ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবেন। ইতিপূর্বে কালিয়ানীর খালের বিষয়ে সাবেক জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন মহোদয়ের নির্দেশে ২০১৯ সালের ১৬ এপ্রিল দখলদারদের পূর্নাঙ্গ তালিকা তৈরী করে তা এসিল্যান্ড অফিসে প্রেরণ করা হয়েছিলো। পরবর্তীতে আবারও তালিকা চাওয়ায় গত বছরের ২৫ আগস্ট পূনরায় এসিল্যান্ড অফিসে তালিকা প্রেরণ করি। কিন্তু এখনও কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। কেন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, তা জেলা প্রশাসক মহোদয় ভালো বলতে পারবেন। মূলত উচ্ছেদের বিষয়ে তিনিই নির্দেশ দিবেন।’


এই বিষয়ে বর্তমান জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার দায়িত্বকালে দখলদারদের তালিকা করা হয়নি। তালিকার বিষয়ে আমি অবগত নই। যেহেতু এখন জানতে পেরেছি, সেহেতু তালিকা দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’ 


এব্যাপারে সাব-ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়াল এনামুল করিম যুগের চিন্তাকে বলেন, এটি আমার অধিগ্রহণ করা খাল নয়, এটি জেলা প্রশাসনের অধীনে খাস খাল। খালটির বর্তমান পরিস্থিতির কারণে তা খননের উপায় নেই। স্থানীয়রা বিভিন্নভাবে দখলে নিয়ে খালটি ভরাট করে ফেলেছে। এখন তা প্রথমে উচ্ছেদ করে দখলমুক্ত করতে হবে। উচ্ছেদ কার্যক্রম করবে জেলা প্রশাসন। আমাদের সহায়তা চাইলে আমরা অবশ্যই তাতে সহায়তা করবো।  


 

এই বিভাগের আরো খবর