
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি দিনমজুর, শ্রমিক এমনকি ব্যবসায়ীদেরকেও যেতে হচ্ছে জেলখানায়। নারায়ণগঞ্জে সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর, সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনায় মঙ্গলবার থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত আরও ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ নিয়ে জেলায় ৩০ মামলায় গ্রেপ্তার হলেন প্রায় ছয় শতাধিক ব্যাক্তি।
বুধবার সরেজমিনে নারায়ণগঞ্জের আদালতপাড়া ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে পুরোদমে চলছে স্বজনদের আহাজারি। আদালতে একেকটি প্রিজন ভ্যান আসছে আর তাতে আপনজনের খোঁজে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন উদ্বিগ্ন স্বজনরা। ভোরের আলো না ফুটতেই তাদের কেউ ভাই, কেউ সন্তান, কেউ বাবা আর কেউ বা স্বামীর সন্ধ্যানে আদালতে এসে অপেক্ষা করছেন। গেলো কয়েকদিনের ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’ জড়িত সন্দেহে পুলিশ ও ডিবি তাদের স্বজনদের গ্রেপ্তার করেছে।
রাজিব সরকার মা ও স্ত্রীকে নিয়ে আদালতে এসেছেন তার ছোট ভাইয়ের জন্যে। মঙ্গলবার বিকেলে মাঠে খেলতে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয় ইয়ামিন সরকার। এরপর তারা জানতে পারেন তার ছোট ভাইকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তিনি বলেন, আমার ছোট ভাই কলেজে পড়াশোনা করে। মঙ্গলবার খেলা শেষে বাড়ি ফেরার পথে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে। অথচ, কোটা আন্দোলনের সময় আমার ছোট ভাইকে আমি বাড়ি থেকে ১ সেকেন্ডের জন্যেও বের হতে দেইনি। কেনো আমাদের এভাবে হয়রানি করা হচ্ছে বুঝতে পারছি না!
সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার হওয়া রায়হানের খোঁজে আদালতপাড়ায় অপেক্ষা করছিলেন বৃদ্ধা মা ও তার ছোট ভাই। রায়হান সিদ্ধিরগঞ্জে ফল বিক্রি করে। প্রতিদিনের ন্যায় ব্যবসায়ীক কাজে বাসা থেকে বের হয়েছিল সে। কিন্তু সন্ধ্যার সময় তার পরিবার জানতে পারে রায়হানকে আটক করা হয়েছে। মা আমেনা বেগম বলেন, আমার পোলাডা কোন ঝামেলাতেই আছিল না। ওয় এমনেই মারামারিরে খুব ডরায়। আন্দোলন যখত হইতাছিল তখন রায়হান ব্যবসা বন্ধ রাইখা বাসাতেই ছিল। পুলিশ যে কেন ওরে গ্রেপ্তার করলো বুঝতে পারতাছি না।
ফতুল্লায় গ্রেপ্তার হয়েছেন দিনমজুর ইব্রাহিম। মঙ্গলবার তার খোঁজ না পেয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে খোঁজাখুজি করা হলে পরে জানা যায়, ইব্রাহিমকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। ইব্রাহিমের স্বজনরা জানান, উনার বয়স এমনিতেই প্রায় ষাটের কাছাকাছি। উনি তো নিজেই ভালোমতো চলাফেরা করতে পারেন না। এই মানুষটা আন্দোলনে কিভাবে ছিল? পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তিটাকে গ্রেপ্তার করায় অনেকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে হলো।
ফতুল্লা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন ইজিবাইক চালক সাদ্দাম। মঙ্গলবার বিকেলের দিকে তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে জানিয়েছেন সাদ্দামের স্ত্রী ঈশিতা। তিনি বলেন, আমার স্বামী ইজিবাইক চালায় প্রায় ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে। সে তো কোন আন্দোলনে ছিল না। সন্ধ্যায় শুনলাম সাদ্দামকে পুলিশ ধরসে। আর এখন তার খোঁজে আদালতে এসে বসে আছি।
শুধু ইয়ামিন, রায়হান, ইব্রাহিম বা সাদ্দামই নন, এমন শত শত স্বজনদের আহাজারিতে প্রতিদিনই ভারী হয়ে উঠছে আদালতপাড়া। এসব বিষয়ে কমপক্ষে ১০ জন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছেন যুগের চিন্তার এই প্রতিবেদক। এর মধ্যে ছাত্রদের পাশাপাশি মাঝবয়সি, ব্যবসায়ী, শ্রমিকও রয়েছেন বলে জানা গেছে। যাদের সহিংসতার সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এদের সবাইকেই ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি ও নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। আর তাদের এক নজর দেখতে এবং আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জামিন করাতে আদালতপাড়ায় চলছে স্বজনদের আহাজারি।