বুধবার   ০৪ অক্টোবর ২০২৩   আশ্বিন ১৯ ১৪৩০

এবার কে হবেন বলির পাঠা

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩  

 

# সেলিম ওসমান নিজেও নৌকা মার্কা চান : ভিপি বাদল
# আমাকে নির্বাচন করতে হবে এমন কোনো কথা নাই : সেলিম ওসমান
# সেলিম ওসমানের সভায় চিহ্নিত রাজাকারগণ উপস্থিত থাকে বলে অভিযোগ
# সেলিম ওসমানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দুর্বল প্রার্থী খোঁজা হচ্ছে বলে অভিযোগ

 

 

২০২২ সালে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের আগে থেকেই ধারণা করা হয়েছিল তখনকার আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াত আইভীকে ঘায়েল করার জন্য এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য শক্তিশালী একজন প্রার্থী খুঁজছিল আওয়ামী লীগেরই একটি পক্ষ। তখন মিডিয়ায় সংবাদ এসেছিল ‘খোঁজা হচ্ছে বলির পাঠা’ শিরোনামে। এরপর খবর প্রকাশ হয় ‘কে হচ্ছেন বলির পাঠা’ শিরোনামে। সেই নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করলেও শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হন তৎকালীন বিএনপি নেতা তৈমূর আলম খন্দকার।

 

এরপর তৈমূর আলম খন্দকারকেই সেই বলির পাঠা বলে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল থেকে ধারণা করা হয়। আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াত আইভীও তৈমূর আলম খন্দকারকে ওসমান পরিবারের প্রার্থী বলে সরাসরি দাবি করেন। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও জাতীয় পার্টির বর্তমান এমপি একেএম সেলিম ওসমানকে জয়ী করতে সেই ওসমান পরিবার ও তাদের সমর্থক হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ নেতাদের মাধ্যমে একই ফর্মূলায় বলির পাঠা খোঁজা হচ্ছে বলে মনে করেন তারা।

 

এরই মধ্যে এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে তাদের সিন্ডিকেট মাঠে নেমে গেছেন বলেও তাদের ধারণা। রাজনৈতিক বোদ্ধাদের মতে যেকোন মূল্যে এবারও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন একেএম সেলিম ওসমান। সচেতন মহলসহ নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির অনেকেরই ধারণা এবারের নির্বাচনে এই আসন থেকে লাঙ্গলের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নৌকার প্রার্থী ঘোষণা করার সম্ভাবনা থাকলে সেলিম ওসমান প্রয়োজনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নেওয়ার চেষ্টা করবেন।

 

কিছু দিন আগে বন্দরের একটি অনুষ্ঠানে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আবু হাসনাত মো. শহীদ বাদল (ভিপি বাদল) বলেন, এখান থেকে নেত্রী (শেখ হাসিনা) যাকে নৌকা দিবেন আমরা তার হয়েই কাজ করবো। সেলিম ভাইকেও যদি আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয় তাহলেও আমাদের আপত্তি নেই। তিনি আরও বলেন, সেলিম ভাইকে আমি বলবো আপনি জাতীয় পার্টি থেকে না, নৌকা থেকে নির্বাচন করুন।

 

কিছুদিন আগে নারায়ণগঞ্জ-৫ ও নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে নৌকার প্রার্থী দেওয়ার দাবী তুলে মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, ১৫ বছর ধরে এই দুটি আসনে নৌকার স্লোগান দেওয়া যায় না। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের করুণ অবস্থা। গত নির্বাচনে হয়তো নানা কারণে জাতীয় পার্টিকে (এই আসন দুটো) দিতে হয়েছে। কিন্তু এখন সময় এসেছে আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী দিতে। এ নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের জন্ম। উনি (সেলিম ওসমান) তো আওয়ামী লীগের ঘরের সন্তান। আওয়ামী লীগে চলে আসুক, নির্বাচন করুক। আমরা এইখানে নৌকা চাই।’

 

বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জের যে দুটি আসন জাতীয় পার্টির জন্য ছেড়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তার মধ্যে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনটি ওসমান পরিবারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই আসনটি একদিকে মূল শহর এবং এর সাথে বন্দরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা জড়িত থাকায় এই আসনটি ওসমান পরিবার নিজেদের করে নিতে চায়। এজন্য আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা এবং জোটগত নির্বাচন করার জন্য জাতীয় পার্টিকে রাজি করানোসহ যেকোন উপায়ে এই আসনটি লাঙ্গল প্রতীকের জন্য বরাদ্দ নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

 

এমনকি প্রয়োজনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রার্থী নিয়ে নির্বাচন করা সম্ভব কি না তার জন্যও সকল প্রকার চেষ্টা তদবীর চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও নিশ্চিত করেছেন একাধিক সূত্র। কেননা এই আসন জয় করাটা সেলিম ওসমানের জন্য এখন প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন তারা। তাই এই আসন থেকে যদি আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টি আলাদা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে তাহলে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের ওসমান পরিবারের বলয়ের নেতাদের মাধ্যমে সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করবে কোন দুর্বল প্রার্থীকে মনোনীত করার।

 

তাদের পক্ষ হতে যেই সূত্র এর আগেও দুইবার করা হয়েছে বলে রাজনৈতিক বোদ্ধাদের ধারণা। একবার সফল হলেও বিফল হয়েছেন দ্বিতীয় বার। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বন্দরের ইউনিয়ন গুলোতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে অনেকটাই সফল হয়েছেন বলে মনে করেন তারা। সেই নির্বাচনেও বলির পাঠা খুঁজে নিয়ে তাদের নাম মাত্র প্রার্থী করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছেন বলে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের তৃণমূলসহ একাধিক নেতা-কর্মী।

 

নির্বাচনের আগে সেলিম ওসমানের দেয়া ঘোষণাকে (যারা চেয়ারম্যান আছেন তাদেরকেই নতুন করে চেয়ারম্যান হিসেবে চান তিনি) সফল করার জন্য সেখানকার ওসমান ভক্তদের মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিবেশটাকে তাদের মতো করে শক্তিশালী প্রার্থীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখেন এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রার্থী দেওয়াসহ তাদের ভক্তরা প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে নৌকাকে হারিয়ে লাঙ্গলকে জিতিয়েছেন বলে প্রকাশ্যে অভিযোগ আসে।

 

কলাগাছিয়া ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে শক্তিশালী প্রার্থী মনোনীত হওয়ায় তিনি নৌকাকে নিয়ে বেফাঁস মন্তব্যও করেন সেলিম ওসমান। তবে গত সিটি নির্বাচনেও এই পদ্ধতি ব্যবহার করে অর্থাৎ বলির পাঠা দাঁড় করিয়েও ওসমান পরিবার বিফল হয় বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের একটি অংশসহ রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ। তবে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের ওসমান পরিবারের ভক্তগণ এখনও চাচ্ছে যেকোন উপায়ে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন থেকে সেলিম ওসমানকে নির্বাচিত করতে।

 

এমনকি যদি সম্ভব হয় তাহলে সেলিম ওসমানকে নৌকা প্রতীকে দেখতেও আপত্তি নেই তাদের। অর্থাৎ লাঙ্গল কিংবা নৌকা যেকোন প্রতীকে যেকোন মূল্যে আবারও সেলিম ওসমানকে ক্ষমতায় আনতে চায় তারা। বন্দরের একটি প্রস্তুতি সভায় ভিপি বাদল বলেন, যিনি কোন দল মত দেখেন না তিনি সেলিম ওসমান। মানুষ কাকে ভোট দিবে, শেখ হাসিনা যাকে ভোট দেওয়ার জন্য মনোনীত করবেন তিনিই এখানে নির্বাচন করবেন। নেতাকর্মীদের কাছে তার নাম জানতে চাইলে তারা বলেন সেলিম ওসমান।

 

তিনি বলেন, সেলিম ওসমান ভাই নিজেও নৌকা মার্কা চায়। সেলিম ওসমান ভাই নারায়ণগঞ্জের ৫টি আসনে নিজেও নৌকা মার্কা চায়। আমরাও সেই দাবি জানাই। তিনি শেখ হাসিনার নির্দেশনা পালন করেন। তিনি একটা দলে থেকে বঙ্গবন্ধুর কন্যার দিক নির্দেশনা পালন করেন। তিনি আরও বলেন, আমি মিথ্যে কথা বলি না। আমি স্ট্যাজ (মঞ্চ) থেকে নেমে গেলে আমাকে জাতীয় পার্টির দালাল বইলেন না।

 

এর আগে সেলিম ওসমান নিজেও নারায়ণগঞ্জ জাতীয় পার্টির সকল কর্মীকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক বলে মন্তব্য করে বলেন, আমি যতদিন বেঁচে আছি নারায়ণগঞ্জ জাতীয় পার্টি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করে রাজনীতি করে যাবে। আওয়ামী লীগের সকল বন্ধুদের বলতে চাই, এটা নিয়ে ভুল বোঝা বুঝির কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ভাইদের কাছে অনুরোধ রাখলাম রেষারেষি করবেন না। অন্তত আমাদের এই সদর বন্দর নারায়ণগঞ্জে কোনো রকম রেষারেষি করবেন না।

 

আমি যতক্ষণ আছি আমার সাথে যারা আছে তারা সবাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের সৈনিক। আমাদের সাথে রেষারেষি করার চেষ্টা করবেন না। তিনি আরও বলেন, আমি স্পষ্ট ঘোষণা দিচ্ছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া আমার জাতীয় পার্টির একটি সদস্যও কোনো দলে বিশ্বাস করে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে আমাদের প্রতিটি সদস্য বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

 

আমাদের নারায়ণগঞ্জ এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমি অনুরোধ করলাম স্থানীয় আওয়ামী লীগ যারা করেন আমাদের সাথে রেষারেষি কইরেন না। আমাকে নির্বাচন করতে হবে এমন কোনো কথা নাই। নির্বাচন ছাড়াও আমার ভাইয়ের পাশে ছিলাম। যদিও আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার অভিযোগ, সেলিম ওসমানের বেশিরভাগ সভা-সমাবেশেই চিহ্নিত ও কুখ্যাত রাজাকারগণ উপস্থিত থাকেন।

 

তবে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের দাবি এবারের নির্বাচনে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগসহ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা নারায়ণগঞ্জের পাঁচটি আসন থেকেই নৌকার প্রার্থী দিবেন। শুধু তাই না, এই এলাকার আওয়ামী লীগের অবহেলিত নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের জাগিয়ে তুলে এখানকার আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব রক্ষায় কোন পরিবারের তদবীরকে মূল্যায়ন না করে আওয়ামী লীগের প্রকৃত প্রেমিক ও ত্যাগী নেতাদের পক্ষ হতে কাউকে মনোনয়ন দিয়ে এখানকার আওয়ামী লীগের খড়া কাটাবেন। যাতে গত ইউপি নির্বাচনের মতো কোন বলির পাঠাকে নিয়ে আওয়ামী বিরোধীরা কোন নতুন খেলা খেলতে না পারে। এস.এ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর