
বিশেষ প্রতিনিধি : ‘বাজান রোজা রাখছি আল্লারস্তে কিছু দেন।’ দোকানী ২ টাকা বাড়িয়ে দিলেন। ভিক্ষুক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। টাকা নিচ্ছেনা। দোকানী জিজ্ঞেস করলো খালা কি চান ? ভিক্ষুক মহিলা হাহাকার করে বললো, ‘বাজান দুই মুঠ পান্তা ভাত খাইয়া রোজা রাখছি। কোন তরকারি আছিলনা। পাশের ঘরের একজন একবাটি ডাইল দিছিলো। ডাইল দিয়া কোন মতে ভাত গিলছি।
পেটও ভরে নাই। আল্লার নামে রোজা রাখছি। বাজান পারলে আমারে কিছু চিড়া দেও। ইফতার খুইল্যা খামু।’ দোকানী এক পোয়া চিড়া দিলেন বৃদ্ধা মহিলাকে। বৃদ্ধা মহিলা শুকরিয়া আদায় করলেন। তিনি থাকেন শহরের পশ্চিম দেওভোগ আদর্শনগর সংলগ্ন গাইবান্ধা বাজার এলাকায়। তার নাম খাদিজা বেগম। ইটভাঙ্গার কাজ করেন।
করোনার কারনে তিনি বেকার। নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকায় তিনিও বেকার। গ্রামের বাড়ি উত্তরবঙ্গের কোন এক জেলায়। স্থানীয় নয় বলে দুঃস্থ খাদিজা বেগম সরকারি কোন ত্রাণ পাননি। বাড়ি মালিক তার ঘর ভাড়া মাফ করে দিয়েছে। কিছু ত্রাণও দিয়েছিল। সেই ত্রাণে কিছু দিন একবেলা আধাপেটা খেয়েছেন। এরই মধ্যে শুরু হল পবিত্র রমজান মাস।
রমজানের কোন সামগ্রী কেউ তাকে দেয়নি। পঞ্চাশোর্ধ এই মহিলা এখন ভিক্ষে করতে নেমেছে। সে কোনদিন ভিক্ষা করেনি। ইটভাঙ্গার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। করোনা সংকটে বেঁচে থাকার তাগিদে দ্বারে দ্বারে হাত পাতছেন। শুধু একজন খাদিজা বেগম নন গাইবান্ধা বাজার এলাকায় এমন শতাধিক নির্মাণ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। চেয়ে চিন্তে খাবার যোগার করতে হচ্ছে।
এদের কেহ রাজমিস্ত্রী, রাজ জোগালি, রড মিস্ত্রী, ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রী, ফিটিং মিস্ত্রী ও টাইলস এর কাজ করেন। নির্মাণ শ্রমিকরা এখন বেকার। ঘরে খাবার নেই। কোন ত্রাণও তারা পাচ্ছেনা। নারায়ণগঞ্জের মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত ও খেটে খাওয়া মানুষ ভাল নেই। ঘরে খাবার নেই।
চলছে রমজান মাস। ইফতার ও সেহেরীর কোনও আয়োজন থাকছেনা। অনেক কষ্টে রোজা রাখছেন। রোজা চলে আসায় খেটে খাওয়া পরিবারের মানুষজন আপাতত উপোষ করা থেকে বেঁচে গেছেন ! নইলে এমনিতেই উপোষ থাকতে হত। এ সকল পরিবারের ছোট সদস্যরা ইফতারের সময় কাঁদে। কয়টা খেজুর ও ইফতার খেতে চায়।
পরিবারের কর্তা ছোট শিশুদের চাহিদা পূরণ করতে না পারার বেদনায় কুকরে যায়। বলে ‘বাবা দুই দিন পর খেজুর আনবো।’ কি নিদারুন অভাব চলছে প্রতিটি খেটে খাওয়া পরিবারে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ত্রাণ দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। অথচ খেটে খাওয়া মানুষগুলো ত্রাণ বন্টনে অনিয়মের কারণে এক ফোটা ত্রাণও পাচ্ছেন না। সে খবর কেউ রাখছেন না।
শহরের দেওভোগ, বাবুরাইল, বৌবাজার, পাইকপাড়া, নিতাইগঞ্জ, তামাকপট্টি, ঋৃষিপাড়া, শহীদনগর, ফেরাজিকান্দা, ইসদাইর, উত্তর চাষাড়া, খানপুর, মাসদাইর, গাবতলী, আফাজনগর, মাসদাইর গুদারাঘাট, পশ্চিম মাসদাইর, বারৈভোগ, আদর্শনগর, পশ্চিম দেওভোগ পানির ট্যাংকী, মাদ্রাসার শেষমাথা, বেপারীপাড়া, তাঁতীপাড়া, বাবুরাইল, ভূঁইয়াপাড়া, বউবাজার, পশ্চিম নগর, লিচুবাগান, আমবাগান, বাংলাবাজার, দেওয়ান বাড়ি, খিলমার্কেট, গলাচিপা, রূপার বাড়ি, দাতা সড়ক, দেওভোগ পাক্কা রোড, নন্দিপাড়া, গোয়ালপাড়া ও আশপাশ এলাকা ঘুরে খেটে খাওয়া মানুষের দুর্দশার কথা জানাগেছে। তাছাড়া এ সকল এলাকায় ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়হীনতার অভিযোগ দিনে দিনে জোরালো হচ্ছে।
সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণি (ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ছোট চাকরি, বেকার, টিউশনি করে জীবনযাপনকারী ) লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ নিতে না পারায় নিদারুণ কষ্টে পড়ে গেছেন। রিক্সাচালক, পরিবহন শ্রমিকদেরও একই দশা। অথচ প্রতিদিন নগরীতে ত্রাণ বিতরণের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।
অধিকাংশ গ্রামে এখনো ত্রাণ বিতরণ শুরু না হলেও খোঁজ নিয়ে জানাগেছে শহর এবং শহরতলী পর্যায়ের চিত্র একই। যারা ত্রাণ পাচ্ছেন তারা প্রতিদিন পাচ্ছেন; যারা পাচ্ছেন না তারা কোথাও পাচ্ছেন না।
করোনাভাইরাস মানুষের জীবন এবং জীবিকা উভয় দিকেই হুমকিতে ফেলে দিয়েছে। শুধুই হুমকি নয়। তার আঘাত-অভিঘাতগুলো পড়ছে একের পর এক। উলট-পালট হয়ে যাচ্ছে বেশিরভাগ মানুষের জীবনযাত্রা। পরিবার-পরিজনের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চোখে অন্ধকার। কাজ নেই। খাবার নেই। এ ধরনের পরিবারের সংখ্যা অগণিত। দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে অসহায়-দুস্থ নর-নারী, শিশু-বৃদ্ধের মিছিল। দুঃখী মানুষের কাতার বাড়ছেই।
টানা ছুটি, লকডাউন, শাটডাউনে সামাজিক বিচ্ছিন্নতায় সবকিছুই বন্ধ। কাজকর্ম এবং আয়-রোজগার হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক পরিবারের ৫ থেকে ৬ লাখ মানুষ। দিন এনে দিনে খাওয়া লোক, দিনমজুর, ঠেলাগাড়ি-ভ্যান চালক, রিকশা চালক, হকার. কুলি, ঘাট শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক বা রাজমিস্ত্রি, জেলে-মাঝি-মাল্লা, ক্ষুদ্র দোকানি ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প শ্রমিক-কারিগর, গৃহকর্মী, ভাসমান হকার, হাফিজে কোরআনসহ আলেম-ওলামা, খন্ডকালীন চাকরি, পেশা, টিউশনিতে থাকা শিক্ষার্থী, নাপিত বা নরসুন্দর, পোলট্রি ও ডেইরি খামারী-শ্রমিক, রফতানিমুখী শাক-সবজি চাষী, টুপি, নকশি ও সৌখিন পণ্যদ্রব্য তৈরিকারক থেকে শুরু করে বর্তমান পরিস্থিতির শিকার হয়ে দেশের আয়-রুজিহারা মানুষজনের শ্রেণি-পেশার সংখ্যা হিসাব শেষ করা যাবে না। গার্মেন্ট কারখানাগুলো সীমিত আকারে চালু হলেও অধিকাংশ বন্ধ ঘোষণায় অসংখ্য শ্রমিক বাড়িঘরে। তারাও আপাতত কর্মহীন।
করোনা-কারণে অনেকেরই পরিবারে দুবেলা দুমুঠো খাবার জুটছে না। চুলা জ্বলেনা এমন পরিবারও কী কম? অল্পস্বল্প ক্ষুদ্র পুঁজি কারো জমা থাকলেও ইতোমধ্যে ভেঙে খেয়ে তাও নিঃশেষ। বাঁচার উপায় কী?
এক আধ-পেট খেয়ে না খেয়ে চাপাকান্নায় গুমড়ে মরছে লাখো পরিবার। লোকলজ্জায় অনেকেই দুঃখ-যাতনার কথা মুখ ফুটে বলতেও পারেন না। জঠর জ্বালাও সইবার নয়! মাহে রমজানে পরিবার-পরিজন নিয়ে ওদের দুঃসহ দুঃখ-কষ্ট মর্মবেদনা অবর্ণনীয়।
পর্যবেক্ষক মহলের মতে, বাংলাদেশ যেসব পরিচয়ে পৃথিবীর বুকে অনন্য বৈশিষ্ট্য ধারণ করে তার অন্যতম হচ্ছে শান্তি-সম্প্রীতি, অতিথিপরায়ণতা, প্রতিবেশী ও গরীব আত্মীয়, এতিমের হক আদায়ে অত্যধিক স্পর্শকাতর যত্মশীলতা। দরিদ্র প্রতিবেশী উপোস ঘরে বসে কাঁদছে, আর স্বচ্ছল প্রতিবেশী নির্বিকার তা দেখছে বাংলাদেশে তা কী করে ভাবা যায়?
করোনা-কারণে লাখো মানুষ আজ জীবিকাহারা। তারা অসহায়। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে নিজের কিছুটা খাবার-দাবার, অর্থকড়ি ভাগাভাগি করে নেবে- এই তো বাংলাদেশের ছবি প্রতিচ্ছবি। এই তো দেশ-জাতির গর্বের ঐতিহ্য। কিন্তু হচ্ছে কই !
তাছাড়া মাহে রমজানের এ সময়ই অসহায়দের মুখে হাসি ফোটানোর সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। রোজায় দান-সাদকা, সাহায্য-সহায়তা বিলিয়ে দেয়ার বিনিময়ে আল্লাহ একটি দানের বিন্দু-কণাকে সত্তর সহস্র গুণে উন্নীত করেই সওয়াব উপহার দিয়ে থাকেন।
জাকাত যাদের উপর ফরজ এই রমজান মাসই তা আদায়ের উপযুক্ত সময়। জাকাতের উৎস থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা জোগানো অনায়াসেই সম্ভব। আর সম্ভব অসহায় মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয়া।
করোনাকালে চারপাশে সমাজের দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত বঞ্চিত অসহায়দের পাশে দাঁড়ানের প্রসঙ্গে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে কথা হয়। আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী সংগঠনের সভাপতি আলহাজ্ব নুরউদ্দিন আহমেদ বললেন, সরকারের একার চেষ্টায় এই মহাদুর্যোগে মানুষের মুখে দুবেলা খাবার তুলে দেয়া নিশ্চিত নয়। দেশের স্বচ্ছল ভাগ্যবান শ্রেণির নাগরিকবৃন্দ দান-সাহায্য সহায়তার উদার মন নিয়ে একযোগে এগিয়ে এলে মানুষ কেউ অভূক্ত থাকবে না। খেয়ে-পরে বাঁচবে।
নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান বলেন, করোনা-সঙ্কটকালে সমাজের অসহায় মানুষের খাদ্যসহ জরুরি ত্রাণে সরকারি-বেসরকারি উভয় উদ্যোগে জোরালো তৎপরতা প্রয়োজন। আমাদের দেশে দান-সাহায্য সহায়তার যে বলিষ্ঠ ঐতিহ্য তা ধারণ ও লালন করে সবারই উদারমনে অসহায়-দুঃখী মানুষের পাশে থাকতে হবে।
তাদের বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব সবারই। এরজন্য স্বচ্ছল জনগোষ্ঠিকে আরো এগিয়ে আসা উচিৎ। মাহে রমজানে জাকাত আদায়ে সবাই যদি তৎপর হন তাই হবে বড় আশার কথা। তাহলে অসহায় মানুষের কষ্টভার অনেকটাই লাঘব হবে।