শনিবার   ২৭ জুলাই ২০২৪   শ্রাবণ ১২ ১৪৩১

চিকিৎসা সেবার মান নিয়ে ক্ষোভ

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশিত: ৮ জুন ২০২৪  

 

 

নারায়ণগঞ্জে চিকিৎসা সেবার মান নিয়ে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এবার সেই আভিযোগটি আরও জোরালোভাবে আলোচনায় উঠে আসে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর গণশুনানির পর। গত বৃহস্পতিবার (৬ জুন) নারায়ণগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে দুর্নীতি দমন কমিশন নারায়ণগঞ্জ এর উদ্যোগে এই গণশুনানির আয়োজন করা হয়।

 

এই আয়োজনে বিভিন্ন সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের বিরুদ্ধে শুনানির জন্য আগে থেকেই বিভিন্ন ভুক্তভোগীর কাছ থেকে তাদের অভিযোগ সংগ্রহ করা হয়। আয়োজনে অভিযোগকারীর সাথে সাথে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকেও উপস্থিত থাকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। দুদকের এই গণশুনানিতে মোট ৫৫টি লিখিত অভিযোগ গ্রহণ করা হয়। 

 

যা ছিল ২৮টি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এর বাইরে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের একটি অভিযোগ ছিল ভূমি অফিসের এক কানুনগোর বিরুদ্ধে। এখানে প্রায় প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই বেশ জোরালো অভিযোগ আসে। যারমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি), সরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসক, বিভিন্ন উপজেলার ভূমি অফিস, তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানীসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। 

 

তবে চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসকদের দুর্নীতির বিষয়ে কড়া সমালোচনা করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক। তিনি বলেন, অন্যান্য অফিসে ৯টা-৫টা অফিস করার পরে সেই বেতনে দিন যায়। অথচ ডাক্তার সাহেবেরা ৯টা-৫টা অফিস করার পরও বাহিরে রোগী দেখার সুযোগ পায়। তারপরও তাদের কেন এত অভাব পড়ে। তারা আবার টেস্টের কথা বলে পয়সা নেয়। গণশুনানিতে হাসপাতালের এম্বুলেন্স সেবার বিড়ম্বনাসহ দালাল চক্রের সক্রিয়তা এবং তার সাথে চিকিৎসকদের কমিশন বাণিজ্যের বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সাথে আলোচনা হয়।

 

এর আগে বিভিন্ন সময় নারায়ণগঞ্জে সরকারী হাসপাতালের এম্বুলেন্স সেবার বিড়ম্বনা নিয়ে মিডিয়ায় বেশ কয়েকবার লেখালেখি হয়। এমনিতেই নারায়ণগঞ্জ খানপুর ৩০০ শয্যা হাসপাতালের এম্বুলেন্স সংখ্যা ছিল ৫টি। পরে রোগীদের বিড়ম্বনা কমাতে স্থানীয় সাংসদ তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি এম্বুলেন্স প্রদান করেন ফলে এম্বুলেন্সের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬টি। তবে এর মধ্যে একটি অকেজো হয়ে পড়ে আছে বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়। 

 

বাকি যে ৫টি  এই এম্বুলেন্স রোগীদের সেবায় ব্যবহার না করে চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা হয় বলে মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদকের প্রশ্ন উত্তরে সেই চিকিৎসক আবার দম্ভোক্তি করে বলেন এই ঘটনাতো এমপিও জানেন। অন্যদিকে যদি কোন সময় সরকারী এম্বুলেন্স যদি পাওয়াও যায় সেগুলোর ভাড়া চাওয়া হয় সরকার নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুন কিংবা তার চেয়েও বেশি। জরুরী মুহুর্তে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার কোন সুযোগ না থাকায় বাধ্য হয়েই বাড়তি টাকা খরচ করে তা ব্যবহার করতে হয় অসহায় রোগীর স্বজনদের।

 

আর দালালদের খপ্পরে পড়ে কত সাধারণ মানুষ যে সর্বশান্ত হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেক রোগী ও তাদের স্বজনদের আহাজারির সংবাদ প্রকাশ হয়েছে নেহাত কম নয়। এসব দালালদের দৌরাত্মের অন্যতম সহায়তাকারী হিসেবে হাসপাতালের ডাক্তার থেকে শুরু করে আয়া পর্যন্ত সর্বস্তরের পেশার লোক জড়িত বলে অভিযোগ সাধারণ মানুষের।

 

একদিকে টিকেট কাউন্টারে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে টিকেট বিলি না করে কাউন্টার কর্মচারীরা বিভিন্ন বাহানায় সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে অস্থির পরিবেশ তৈরি করেন বলে সেবা গ্রহণ করতে আসা সাধারণ মানুষের পক্ষ হতে অভিযোগ আসে। অন্যদিকে কোন ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখে দিলে সেখানে থাকা পিয়ন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের স্টাফরা রোগীদের প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসা নেওয়ার প্রলোভন দেখানো কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে বিভিন্ন পরীক্ষা করানোর জন্য প্ররোচিত করে।

 

আর সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো এসব বিষয়ের সাথে সরাসরি ডাক্তারদের সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ। এসব সরকারী হাসপাতালের অনেক চিকিৎসকই চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের এই হাসপাতালের চিকিৎসা ও যন্ত্রপাতি সম্পর্কে নেগেটিভ ধারণা দিয়ে তার পার্সোনাল চেম্বারে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা নেওয়ার প্রচার চালান বলে একাধিক অভিযোগ আসে। আবার রোগীদের রোগ নির্ণয় করার উছিলায় বিভিন্ন টেস্ট করার উপদেশ দিয়ে ডাক্তররা তাদের চুক্তি করা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের স্লিপ হাতে ধরিয়ে দেন বলেও অভিযোগ আছে। 

 

শুধু তাই নয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেখানে দু’একটি টেস্ট করলেই যথেষ্ট, সেখানে তারা একাধিক টেস্টের কথা উল্লেখ করেন শুধু তাদের কমিশন বৃদ্ধি করার আশায়। আর এতে করে অনেক নিরুপায় পরিবারই তাদের সামর্থ্যরে বাইরে গিয়ে নিজেদের জমানো টাকা কিংবা দামী জিনিসপত্র বিক্রি করে সেই টাকা মেটাতে বাধ্য হয় বলে বিভিন্ন পরিবার থেকে অভিযোগ এসেছে বহুবার। 

 

জানা যায় এসব ডায়গনস্টিক সেন্টারের মালিকদের কাছ থেকে এসব ডাক্তাররা প্রতিটি টেস্টের জন্য কত পার্সেন্ট কমিশন পাবে তার একটি চুক্তি থাকে। আর তাই এসব  ডাক্তার ও হাসপাতাল স্টাফদের সাথে যোগসাজশ করে কখনও হাসপাতালের সরকারী রোগ নির্ণয় যন্ত্রগুলো নষ্ট বলে ঘোষণা করে আবার কখনও এসব সেকশনের লোক ছুটিতে বলে বা লোক নেই বলে ঘোষণা দিয়ে থাকেন বলেও এখন নিত্যদিনের অভিযোগ।

 

দুদকের গণশুনানিতে শহরের খানপুর ৩০০ শয্যা হাসপাতালে সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, পর্যাপ্ত মেশিনপত্র থাকা সত্ত্বেও রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা করার সুযোগ না দেয়া এবং দালালচক্রের প্রভাবসহ কর্তৃপক্ষের অবহেলা করা এবং চিকিৎসা সেবার মান নিয়েও অভিযোগ উঠে। এখানকার অলক কুমার সাহা নামের এক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে হাসপাতালে পরীক্ষা না করিয়ে কমিশনের বিনিময়ে বেসরকারি নিম্নমানের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেয়াসহ স্লিপ প্রদান করার অভিযোগ করেন একজন।

 

সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের সমালোচনা করে দুদকের কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক বলেন, ‘দেশের হাসপাতালগুলোতে একটা কমন সমস্যা আছে। ব্যবসার কারণে হাসপাতালগুলোকে প্রাইভেট সংস্থা বানিয়ে ফেলছে। হাসপাতালগুলো সরকারি সংস্থা, এগুলো যেন প্রাইভেট সংস্থা না হয়। অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তারা নয়টা-পাঁচটা অফিস করে, ওই বেতনেই তাদের দিন যায়। 

 

ডাক্তার সাহেবরা নয়টা-পাঁচটা অফিস করার পরেও অনেক প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে পারে। তারপরও তাদের কেন অভাব পড়ে? তাদের কেন এজেন্সি লাগে, প্রাইভেট ক্লিনিক লাগে, কেন মানুষের কাছ থেকে অহেতুক টেস্টের টাকা নেয়? আপনার সকলে একটু তৎপর হবেন, তাহলে মানুষ সেবা পাবে।’

এই বিভাগের আরো খবর