Logo
Logo
×

শিল্প ও সাহিত্য

জালালউদ্দিন রুমি’র একগুচ্ছ কবিতা

Icon

প্রকাশ: ১৬ মে ২০১৮, ০৪:৩০ এএম

Swapno

সাহিত্য ডেস্ক(যুগের চিন্তা ২৪): ইয়েটস, এলিয়ট, নেরুদা, উইলিয়াম কালোর্স কিংবা অ্যাশবেরি নয়, পশ্চিমা বিশ্বে এখনো জালাল উদ্দিন রুমি নামের এক দরবেশ-কবি সবচেয়ে বেশি পঠিত ও জনপ্রিয়। এটির একটি কারণ হতে পারে- ভোগবাদি মানুষের বস্তু নির্ভর জীবনের প্রতি অপার মায়ায় ভাঙ্গন ধরার সাথে সাথে, মানুষ কিছুটা মিস্ট্রিসিজম বা অতিন্দ্রীয়বাদের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে।

 

রুমি সর্বতোভাবেই একজন মিস্ট্রিক্যাল(অতীন্দ্রিয়বাদি- সমাধিস্থ, ধ্যান অবস্থায়, সৃস্টিকর্তার সাথে প্রত্যক্ষ সংযোগস্থাপনে ইচ্ছাকারি ব্যক্তি) কবি। তিনি ১২০৭ সালে আফগানিস্তানের বালাখে জন্ম গ্রহণ করেন। তার কবিতার মূল স্বর সুফি ভাবধারার- যেখানে মানুষের আত্মা স্বর্গীয় সত্তার সাথে মিলনে পাগল, আত্মহারা। তার কবিতার বীজ ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ ‘কোরান’ আর নবী মোহাম্মদ(সাঃ) এর আদর্শের উপর গড়ে উঠলেও, তার গভীর সাত্ত্বিকতা, মানবিক আর্তি, আর সৃষ্টির সৃষ্টিকর্তা সেই ‘পরম’কে সম্পূর্ণ নিরাসক্ত প্রেম দিয়ে বোঝা আর উপলদ্ধ করার জন্য তিনি ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের বাঁধা অতিক্রম করতে পেরেছেন। হয়েছেন সকল মানুষের ভালোবাসা আর প্রেমের গুরু। কথিত আছে মারা যাওয়ার পর তার শেষকৃত্য চল্লিশ দিন পর্যন্ত পালিত হয়েছিল, আর সেখানে মুসলিম, ঈহুদি, খ্রিস্টান ধর্মের লোক ছাড়াও অন্যান্য জাতির প্রচুর লোকজন হাজির হয়েছিল। রুমির জীবনের বড় একটি ঘটনা হলো ভ্রামণিক, ফকির-দরবেশ শামস আল দীনের সাথে তার সাক্ষাৎ।

 

শামস ছিল উন্মাদ ধরণের আধ্যাত্মিক পুরুষ, সমাজ সংসার, নিয়ম -কানুন দ্রোহী। কিন্তু তার ছিল একটি বিশাল হৃদয় যা সৃস্টিকর্তার প্রতি সদা নিবেদিত, উৎসর্গকারী। এই সাক্ষাৎ না হওয়া পর্যন্ত রুমি ছিল ইসলামিক আইন কানুন, ফিকাহ শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ একজন শিক্ষক। একদিন রুমি শামস-এর ভেতর একটা ‘স্বর্গীয় উপস্থিতি’ টের পেলেন। তার শামসের সাথে এই সাক্ষাৎ, আর ‘ডিভাইনলি শামস’ এর হঠাৎ আবিষ্কার, রুমির ভেতরের গুপ্ত আধ্যাত্মিকতা আর খোদার প্রতি পরম নিবেদনকে জাগিয়ে তোলে। ঠিক এই সময়েই তিনি তার অ্যাকাডেমিক জীবন তথা শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে দিয়ে দরবেশ-জীবনে পা বাড়ান আর মিস্টিক্যাল কবিতা লেখা শুরু করেন। রুমির কবিতায় অনেক বিষয়-আশয়ের দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু যে বিষয়টির জন্য রুমি জগৎ বিখ্যাত সেটি হল মানুষের আত্মার সাথে ডিভাইন এর মিলন। তার কবিতায় রুমি প্রেম, মদ, মদে মদ্যপ থাকা- এসবের কথা বারবার উল্লেখ করেছেন যা ইসলামের দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এখানে তার এই মদ আক্ষরিক অর্থে কোনো মদ নয়, এটি খোদার প্রতি, সৃষ্টিকর্তার প্রতি তার পরম ভালোবাসা, আত্মসমর্পণ তথা তার সাথে লীন হয়ে যাওয়ার এক পরম উপলদ্ধিকেই বোঝায়। রুমি ‘দীওয়ান’ এ বলেছেন ‘সুফিরা মোহাম্মদের দিকে ঝুঁকে থাকে, যেমন ঝুঁকেছিল আবু বকর।’ তিনি সংগীত, কবিতা আর চক্রাকার নৃত্যের তালে তালে ধ্যান করা মাধ্যমে খোদার কাছে পৌঁছানোর উপায় মনে করতেন। তিনি তার বিশেষ সংগীতে এমনভাবে মনোযোগ করার কথা বলতেন যে তার ভেতর দিয়ে একইসাথে আত্মার ধ্বংস আর পূর্নজন্ম লাভ হয়। তিনি কবিতা আর গদ্যের অনেকগুলো গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারমধ্যে ‘দীওয়ান’, ‘মাসনাভী’, ‘মাকাতীব’, ‘মাজালীশ’ এবং ‘ফীহে মা ফীহে’ উল্লেখযোগ্য। তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো ‘মাসনাভী’। এটি বিশ্বে একটি অনন্য সূফী গ্রন্থ হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। ‘মাসনাভী’ রুমির বিশ্ববিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। ৪০ হাজার লাইনের এই গ্রন্থ রচনা করতে সময় লাগে ২২ বছর।

 

জালালউদ্দিন রুমি’র একগুচ্ছ কবিতা যে আমাকে পৃথিবীতে পাঠালো

 

সারাদিন আমি এটি নিয়ে ভাবি, রাতে এটি ঠোঁটে আওরাই আমি কোথা থেকে এসেছি আর আমাকে কী করতে হবে? আমার কোনো ধারণাই নেই। এ আমি নিশ্চিত- আমার আত্মা অন্য কোথাও থেকে আর আমি ওখানেই শেষ হতে চাই। এই পাগলামি শরু অন্য কোনো সরাইখানায় আমি যখন ফিরে আসি এই জায়গায় আমি তখন তুমুল প্রশান্ত। এর মধ্যেই আমি যেন অন্য মহাদেশের কোনো পাখি এই পাখির দেশে বসে আছি। আসছে সে দিন যেদিন আমি উড়াল দেবো কিন্তু আমার কানে এটি কে? এখন যে আমার কণ্ঠ শুনে! কে সে যে কথা বলছে আমরাই মুখে? কে আমার চোখ দিয়ে দেখছে? আত্মা কী? আমি প্রশ্ন না করে থামতে পারি না। যদি আমি এক ফোঁটা জবাব পরীক্ষা করে দেখতে পেতাম তাহলে আমি এই কারাগার মুক্ত করে দিতাম পাগলদেরকে। আমি নিজে নিজে এখানে আসিনি আর আমি সেভাবে বাঁচতেও পারবো না। যে আমাকে এখানে এনেছে তাকে আমাকে নিয়ে যেতে হবে বাড়ি। এই কবিতা। আমি কখনো জানিনা আমি কী বলতে চাই আমি এটি পরিকল্পনাও করি না আমি যখন এর বলার বাইরে থাকি তখন খুব চুপ হয়ে পড়ি আর কোনো কথাও বলি না।

 

পাথর হয়ে মরি

 

আমি পাথর হয়ে মরি আবার গাছ হয়ে জন্মাই গাছ হয়ে মরি আবার পশু হয়ে জাগি, পশু হয়ে মরি আবার মানুষ হয়ে জন্মাই তাহলে ভয় কীসের? কীবা হারাবার আছে মৃত্যুতে?

 

পাখির গান

 

আমার কামনার আগুনে পাখির গান আনে শান্তি। আমি তাদের মতোই আত্মহারা, কিন্তু আমার বলার কিছুই নেই। হে চিরন্তন আত্মা, আমার মধ্য দিয়ে তুমি কিছু গান শিখে নাও।

 

দৃশ্যের পেছনে

 

এটি কি তোমার মুখমণ্ডল যে বাগানকে সাজায়? এটি কি তোমার সুঘ্রাণ যে বাগানকে পাগল করে? এটি কী তোমার প্রাণ যে এই ছোট ঝরনাকে করেছে নদী অথবা শরাব? শত সহস্্র জন তোমাকে খুঁজে বেড়ায় আর মরে যায় এই বাগানে অথচ তুমি লুকিয়ে আছ দৃশ্যের পেছনে। কিন্তু এই ব্যথা তাদের নেই যারা আসে আশিক হয়ে। তখন তোমাকে পাওয়া যায় সহজে তুমি থাকো এই বাতাসে আর শরাবের নদীতে।

 

গোধুলি সন্ধ্যায়

 

গোধুলি সন্ধ্যায় চাঁদ ওঠে আকাশে, একসময় পৃথিবীতে নামে আর আমার দিকে চায়। চিল যেমন পাখির বাচ্চা শিকার করে দ্রুত উড়ে তেমনি এই চাঁদ আমাকে চুরি করে আকাশে ধায়। আমি আমার দিকে তাকাই, আমাকে আর খুজেঁ না পাই! আমার শরীর এক মিহি প্রাণ হয়ে মিশে যায় চাঁদে। নয়টি গোলক হারিয়ে যায় অই সোনালি চাঁদে আমার আমি হারিয়ে যাই এই মায়াবী সমুদ্রে।

 

মুহূর্তের সুখ

 

আমি আর তুমি বসে আছি বারান্দায় দেখতে দুই, আসলে এক, তুমি আর আমি। আমরা পান করি জীবনের জল এখানে বাগানের সুন্দর নিয়ে বসে আছি দুজনে তুমি আর আমি। আর পাখিরা গাইছে নক্ষত্রমণ্ডলী আমাদেরকে দেখছে আজ আমরা তাদের দেখাব এক পাতলা বাঁকা চাঁদ হতে কেমন লাগে! তুমি আর আমি আমিশূণ্য, বসে আছি এক হয়ে উদাসীন অলস বিচারের কাছে, আমি আর তুমি। স্বর্গের টিয়া মিছরি কামর দিচ্ছে যখন আমরা হেসে উঠছি, তুমি আর আমি।

 

আসো, আসো তুমি যেই হউনা কেন

 

মুসাফির, নামাজি, সন্যাসী কিছুই ব্যাপার না। আমাদের এই ক্যারাভান নিরাশার নয়, আসো যদিও তোমার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হয়েছে হাজারবার আসো, আবারো, আসো আসো।

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher
ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন