
ইট কংক্রিটের শহরে খেলার মাঠ অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। নারায়ণগঞ্জ ও তার আশেপাশের এলাকায় যে কয়টি খেলার মাঠ রয়েছে তা প্রায় হাতেগোনা। এরই মাঝে ফতুল্লায় একটি মাঠ দখলের উৎসবে মেতেছে ব্যবসায়ীরা। খেলার মাঠের মাঝখানে খুঁটি গেড়ে অস্থায়ী দোকানও বসিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ।
এছাড়া ইট বালু ও মাটি রেখে দীর্ঘ মেয়াদে মাঠ দখলেরও অভিযোগও উঠছে একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। প্রকাশ্য দিবালোকে মাঠ দখল করে রাখার এমন চিত্র নিত্যদিনের হলেও শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের বিষয়ে যেন কারওই কোন ভাবনা নেই।বলছিলাম নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় অবস্থিত ডিআইটি মাঠের কথা। বিশাল এই মাঠ পুরো ফতুল্লায় আলোচিত বিভিন্ন কারনে। এই মাঠেই প্রতি বছর কোরবানির পশুর হাট, বৈশাখী মেলার আসর বসে। এছাড়া সপ্তাহের মঙ্গলবারে হাট বসে আসছে বহু বছর জুড়ে। নির্বাচনী জনসভাতেও ডিআইটি মাঠ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে অন্যতম পছন্দের স্থান। কিন্তু খেলার মাঠ হিসেবে যার পরিচিতি সেই খেলাটাই এখন হারিয়ে যেতে বসেছে মাঠ থেকে। তার বদলে যায়গা হয়েছে সপ্তাহজুড়ে বসা অবৈধ দোকান ও বিভিন্ন নির্মান সামগ্রী রাখার স্থান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানী উন্নয়ন কতৃপক্ষের পূর্ব নাম ছিল ঢাকা ই¤প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট যা সংক্ষেপে ডিআইটি হিসেবে পরিচিত ছিল। ফতুল্লার প্রবীন বাসিন্দাদের মতে সেই সংস্থার তরফ থেকেই এই মাঠটি কোন একটি প্রকল্পের জন্য নির্ধারন করা হয়েছিলো। পরবর্তীতে স্বাধীনতার পর মাঠের নিয়ন্ত্রণ জেলা প্রশাসন নিয়ে নেয়। বর্তমানে উপজেলা প্রশাসনের অধীনে এই মাঠে সাপ্তাহিক হাটের জন্য বাৎসরিক ইজারা ডাকা হয়।
সরেজমিনে শুক্রবার বিকেলে ডিআইটি মাঠে প্রবেশ করতেই দেখা মেলে মাঠের পূর্ব দিকে ৫/৬ জন কিশোর ক্রিকেট ব্যাট বল নিয়ে খেলছে। মাঠের পশ্চিম পাশের অর্ধেকের বেশী স্থান হকারদের দখলে রয়েছে। সপ্তাহে মঙ্গলবার হাট বসানোর অনুমতি থাকলেও শুক্রবার তাদের রমরমা ব্যবসা চলছে। হাট চলছে কিনা জানতে চাইলে খেলার মাঠে থাকা এক কিশোর বলে উঠে, ‘এরা ডেইলিই বহে। আর পশুপাখি মঙ্গলবার পাওন যাইব। আপনে ৩/৪ দিন পরে আইয়েন। ঐদিন হাট বইব’। মাঠে প্রায় ৩৬ টি দোকানের অস্তিত্ব মিললো। এর কোনটিরই শুক্রবার ব্যবসা করার কথা নয়। নিজেদের হকার বলে পরিচয় দিলেও মাঠে বাঁশের খুঁটি গেড়ে মোটামুটি স্থায়ী করেছেন নিজেদের দোকান। মাঠের ঠিক মাঝখানে বসানো হয়েছে চটপটি ফুচার দোকান। কোন গাড়িতে করে বিক্রি করছেন না, প্যান্ডেল টানিয়ে চেয়ার বসিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন অনায়াসে। মাঠের বিভিন্ন অংশে ভাঙ্গা চৌকি, বর্জ্য পোড়ানো ছাই, ইট বালুর স্তপ এবং মাটির একটি বড় ঢিবি। দোকানিদের কাছে জানতে চাওয়া হলো কে দিয়েছে এভাবে ব্যবসা করার অনুমতি? জবাবে একজন কাপড় বিক্রেতা বলেন, বাজার কমিটির কাছে অনুমতি নিয়া আমরা বসছি। ডেইলি ১০০ টাকা কইরা দেয়া লাগে। হাটবারেও আসি, অন্যান্য দিনেও আসি। কেউ সেই বাজার কমিটি তা জানতে চাইলে ফতুল্লা লঞ্চ ঘাটের বিপরীত দিকে অবস্থিত দোকানের দিকে যাবার পরামর্শ দেন। সেখানে জাকির নামে এক ব্যক্তির কাছে সব জানা যাবে বলে জানিয়ে দেন। বেশ কিছু সময় ধরে খোঁজাখুঁজির পর হদিস মেলে জাকিরের। তবে তিনি বাজার কমিটির কিছুই নন। বরং মাঠ দখল করে ব্যবসা চালানোর নেতৃত্ব স্থানীয় একজন বলে পরিচয় মিললো।
তিনি জানান, এইখানে বাজার কমিটি বলতে কিছু নাই। হাটের বাৎসরিক ইজারার টাকা অনেক বাড়ছে। এজন্য হাটের লোকজন আমাগো সবসময় বসার অনুমতি দিসে। আগে শুধু মঙ্গলবার বসতো সবাই, এখন শুক্রবার সহ প্রায়ই বসে। এইটা উপর থেকে অনুমতি নেয়া আছে। তবে মাঠে খেলতে আসা কিশোরদের কাছে মাঠের এমন চিত্র মোটেও পছন্দ না।
অষ্টম শ্রেনীর ছাত্র রাকিব জানায়, মাঠে এদের (দোকান) জন্য খেলা যায়না। বল উড়ে এসে গায়ে লাগলে চিল্লাচিল্লি করে। খেলতে গেলে তো বল লাগবেই। এরা খেলতে দেয়না ঠিকমত। আর বাঁশের গর্তে পা মচকে যায়। আমরা বাধ্য হইয়া নদীর ঐপাড়ে বসুন্ধরায় গিয়া খেলি।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হয় নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদা বারিকের সাথে। তবে তার মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোনকল রিসিভ করেননি। চার দেয়ালের মাঝে আবদ্ধ শিশু কিশোরেরা যখন মাঠের অভাবে মোবাইলে নিজেদের অভ্যস্ত করে নিতে বাধ্য হয়েছে তখন রাষ্ট্র এর থেকে উত্তরণে পথ খুঁজছে নিত্যদিন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নিজে শিশুদের জন্য খেলার মাঠ তৈরীর নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু দায়িত্বরত কর্তাব্যক্তিদের অবহেলা আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা না ভাবার কারনে এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠ। এখনই দখলদারিত্বের লাগাম টেনে না ধরলে অচিরেই ডিআইটি মাঠ কেবল ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে আগামীতে।