Logo
Logo
×

বিশেষ সংবাদ

ত্বকী হত্যা : স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে যা বলেছিল ভ্রমর

Icon

প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০২০, ০২:৫৫ এএম

ত্বকী হত্যা : স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে যা বলেছিল ভ্রমর
Swapno

যুগের চিন্তা রিপোর্ট :মেধাবী শিক্ষার্থী তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকান্ডের সাথে ওসমান পরিবার যে জড়িত তা এই মামলার আসামি ইউসুফ হোসেন লিটনের পর শওকত সুলতান ওরফে ভ্রমর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তথ্য দেয়। তাতে ওসমান পরিবারের সম্পৃক্ততার স্পষ্ট প্রমাণ উঠে আসে।

 

হত্যাকান্ডের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা সুলতান শওকত ভ্রমর ২০১৩ সালের ১২ নভেম্বর আদালতে যে জবানবন্দি প্রদান করেন তাতে সে ঘটনার আদ্যোপান্ত তুলে ধরে। 

 

জবানবন্দিতে ভ্রমর উল্লেখ করে, নারাযণগঞ্জ-৫ আসনের তৎকালীন সাংসদ নাসিম ওসমানের একমাত্র ছেলে আজমিরী ওসমানের নেতৃত্বে তারই অফিসে (শহরের কলেজ রোড এলাকার অবস্থিত উইনার ফ্যাশনে) ত্বকীকে নৃশংসভবে হত্যা করা হয়।

 

এরআগে ইউসুফ হোসেন লিটন ত্বকী হত্যাকান্ডের ঘটনায় একই আদালতে গত ২৯ জুলাই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। লিটনের স্বীকারোক্তিতে সুলতান শওকত ভ্রমরের নাম ছিল।

 

ভ্রমর  ২০১৩ সালের ১২ নভেম্বর সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কেএম মহিউদ্দিনের আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া বক্তব্যে তার স্বীকারোক্তি প্রদান করে। এরআগে ১১ নভেম্বর গভীর রাতে তাকে নারাায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-১১’র সদস্যরা।

 


স্বীকারোক্তিতে ভ্রমর বলেছে, ২০১৩ সালের ৬ মার্চ বিকেলে সে তার ছেলে সুলতান নাঈম (৭) এর অসুস্থতার খবর জানাতে আজমিরী ওসমানের অফিস উইনার ফ্যাশনে যায়। অফিসে প্রবেশের পর ভ্রমর দেখতে পায় বড় ভাই কাজল, শিপন, জেকিসহ কয়েকজন পুল খেলছে। ওই সময় ভ্রমর বড় ভাইদের পুল খেলা দেখে।

 

কিছুক্ষণ পর অফিসের সিসি ক্যামেরায় দেখেন রাজীব ও কালাম আজমিরী ওসমানের এক্স ফিলডার গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। তারপর অন্যদের সঙ্গে অনেকক্ষণ পুল খেলে। রাত সাড়ে ৯টার দিকে ত্বকীকে নিয়ে রাজীব, কালাম, মামুন এবং ইউসুফ হোসেন লিটন (আগে স্বীকারোক্তি দিয়েছিল) অফিসে প্রবেশ করে।

 

রাজীব ও কালাম ত্বকীকে আজমেরীর রুমে নিয়ে যায়। দেড় ঘন্টা পর কাজল ভ্রমরকে বলে, চলতো দেখি কাকে নিয়ে এসেছে।এই বলে ভ্রমরকে কাজল আজমেরীর পাশের রুমে নিযে যায়। ওই রুমে বসে ভ্রমর ও কাজল আজমেরীর গলায় চিৎকার-চেঁচামেচি ও গালিগালাজের শব্দ শুনতে পায়। রাত ১২টার দিকে আজমেরী তার রুমের থাই গ্লাস খুলে বেরিয়ে আসে। 

 

দরজা খোলার পর ভ্রমর দেখে আজমেরীর রুমের মধ্যে কালাম, লিটন, রাজীব ও মামুন দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং ত্বকীর চোখ বাধা লাশ মেঝেতে পড়ে আছে। দরজা খুলে বের হয়ে আজমেরী ওসমান কাজলকে উদ্দেশ্য করে বলেন সবশেষ। তোরা যেখানে পারিস লাশটি ফেলে দিয়ে আয়। লিটন, রাজীব, কালাম যখন ত্বকীর লাশ বের করে নিয়ে যাচ্ছিল ওই সময় আজমেরী ওসমান বলে, ভ্রমরকে নিয়ে যা। তখন ভ্রমর লাশ ফেলতে যেতে না চাইলে আজমিরী ওসমান পিস্তল দিয়ে অফিসে থাকা শোকেজে ২টি গুলি করলে ভ্রমর লাশ ফেলতে সঙ্গে যেতে রাজী হয়।

 


লাশটি লিটন, রাজীব, কালাম ও মামুন মিলে এক্স ফিলডার গাড়ির ব্যাকডালায় ভরে। গাড়িটি চালক জমশেদ চালিয়ে শহরের চারারগোপ নিয়ে যায়। ভ্রমর গাড়িতে চালকের পাশের সিটি বসা ছিল। রাত দেড়টায় চারারগোপ গিযে থামলে ভ্রমর গাড়িটি পাহারা দেয় আর রাজীব, লিটন, মামুন ও কালাম বস্তাবন্দি ত্বকীর লাশ নিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর ঘাটের দিকে যায়। ১৫-২০ মিনিট পর ওরা ৪ জনে মিলে খালি হাতে ফিরে এসে গাড়িতে ওঠে। তারপর সবাই আবার আজমিরীর অফিসে যায়। সেখান থেকে পরে যে যার মতো চলে যায়।’

 


প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ৬ মার্চ বাসা থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হয় ত্বকী। ৮ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদীল পাড় থেকে তার লাশ উদ্ধারের পর সেদিন রাতেই ত্বকীর বাবা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি অজ্ঞাতজনদের আসামি করে থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। পরে রাব্বি তৎকালীন সাবেক এমপি শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমানসহ ৭জনকে অভিযুক্ত করে একটি অবগতি পত্র দিয়েছিল পুলিশ সুপারের কাছে।

 

মামলার এজাহার ও অবগতিপত্রে লিটনের নাম ছিলনা। ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বির আবেদনে হাইকোর্টের আদেশের প্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে নারায়ণগঞ্জের মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যা মামলাটি ওই বছরের ২০ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে র‌্যাব এর কাছে হস্তান্তর করে সদর মডেল থানা পুলিশ।

 

এরআগে মামলাটি পুলিশ তদন্ত করছিল। রফিউর রাব্বির অবগতিপত্রে থাকা জেলা যুবলীগের বহিষ্কৃত প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক জহিরুল ইসলাম পারভেজ ওরফে ক্যাঙ্গারু পারভেজ গত ৬ জুলাই ঢাকার গুলশান এলাকা থেকে নিখোঁজ হন।

 


২০১৩ সালের ১৫ জুন সন্ধ্যায় প্রশাসনের লোক পরিচয় দিয়ে ৭-৮ জন পোশাকধারী নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি নাসিম ওসমানের একমাত্র ছেলে আজমিরী ওসমানের ঘনিষ্ট সহযোগী সুলতান শওকত ভ্রমরকে তুলে নিয়ে গেছে বলে তার পরিবারের লোকজন দাবি করেন।

 

সেদিন রাতেই এ ব্যাপারে ভ্রমরের স্ত্রী তানিয়া আক্তার বাদী হয়ে কেরানীগঞ্জ থানায় একটি জিডি করেন। মূলত এরপর থেকেই ভ্রমর নিখোঁজ ছিল।  ২০১৩ সালের ১২ নভেম্বর তাকে রূপগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। পরে ওইদিন সন্ধ্যায় এই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ভ্রমরের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী কিলিং মিশনে ভ্রমরসহ ১১ জন ছিল।

 

কিন্তু এই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার পর ১৬ দিন পর অর্থাৎ ২৮ নভেম্বর ভ্রমর তার জবানবন্দি প্রত্যাহারের জন্য আদালতে আবেদন করেন। গত বছরের ২০ মার্চ উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে আত্মগোপনে যান ভ্রমর। বর্তমানে একটি সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ভ্রমর দেশের বাইরে অবস্থান করছে।     


কে এই ভ্রমর :

মেধাবী কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার ঘটনায় আসামি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়া শওকত সুলতান ওরফে ভ্রমর বিক্রমপুরের দোকাছি গ্রামের সম্ভান্ত হাওলাদার পরিবারের সন্তান হলেও ছোটবেলা থেকেই সে বখে যায় বলে তার পরিবারসূত্রে জানা গিয়েছিল। ভ্রমরের পরিবারের নারায়ণগঞ্জ শহরে কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে।

 

ভ্রমরের পিতা মরহুম সোহরাব হোসেন বায়তুল মোকাররমের স্টীল কিং প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন। মা মিতা হোসেন জাতীয় পার্টি নেত্রী। ভ্রমর সোহরাব হোসেনের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর ঘরের ছেলে। বড়টির নাম ডলার ও ছোট ছেলে ভ্রমর। সোহরাব হোসেন বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের মামাতো ভাই।

 

নারায়ণগঞ্জের করিম মার্কেট, নয়ামাটি ও চেম্বার রোডে ভ্রমরদের বেশ কয়েকটি বাড়ি রয়েছে। প্রতিমাসে সে কয়েক লাখ টাকা শুধু বাড়ি ভাড়া থেকেই পেত। গাড়ি, বাড়ি, সম্পদ কোন কিছুরই অভাব ছিলনা ভ্রমরের। বাস স্ট্যান্ডে রেলী ব্রাদার্সের উল্টো দিকে অবস্থিত ডিভি (ডলার-ভ্রমর) প্লাজার মালিকও এ দুইভাই। সেসময় সেখানে ভ্রমর সেবা রেস্তোরা নামে একটি রেস্টুরেন্ট নির্মাণ করলেও তা না চলায় উঠে যায়।

 


ভ্রমরকে চেনে এমন ব্যক্তিরা জানিয়েছে, ভ্রমরের কোন ব্যবসার প্রয়োজন পড়তোনা। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তার ছোট সংসার ছিল। মাসে ভাড়া পেত কয়েক লাখ টাকা। বিগত ১৯৯৬-২০০১ সালে শামীম ওসমান যখন এমপি হিসেবে এ শহরে দ মুন্ডের ভাগ্যবিধাতা, তখন ভ্রমর জুট সন্ত্রাসী হিসেবে নাম লেখায় এবং চিহ্নিত সন্ত্রাসী হাজী রিপনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে।

 

মহাজোট সরকারের আমলেও ভ্রমর হাজী রিপনের শিষ্য ছিল। এবং ত্বকী হত্যার মাত্র দুই বছর আগে হাজী রিপনের নেতৃত্বে সাবেক জাতীয় ফুটবলার আজমত উল্লাহ খন্দকারের উপর হামলায় অংশগ্রহণ করে। পরবর্তীতে হাজী রিপনকে ত্যাগ করে আজমেরী ওসমানের অনুগত হয় এবং আজমেরী ওসমানের পক্ষে শহরের নয়মাটি ও করিম মার্কেট এলাকায় জুট সন্ত্রাসের নেতৃত্ব গ্রহণ করে।

 


নগরের বিশিষ্টজনেরা ত্বকী হত্যার পরপরই মতামত দিয়েছিলো, ভ্রমর ত্বকী হত্যার কিলিং মিশনের একজন সদস্য। আদালতে দেয়া  স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে সে ত্বকী হত্যার ব্যাপারের বিশদ বর্ণনা দিলেও নিজেকে সম্পৃক্ত করেনি। এবং হত্যার পর লাশ গুম করার কাজে অংশ নিলেও তা সে স্বেচ্ছায় নেয়নি বলে জানিয়েছে।

 

আজমেরী ওসমানের দীর্ঘদিনের সহযোগী হিেেসব সে স্বেচ্ছায় এ কাজে এগিয়ে এলেও মেষ মুহুর্ত্বে নিেেজক রক্ষায় পিস্তলের মুখে লাশ পাচারে অংশ নেয়ার কথা স্বীকার করেছে। তবে ছোটবেলা থেকেই ভ্রমর ছিলো আলো-আঁধারের জগতের বাসিন্দা।  

 

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher
ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন