নানা আয়োজনে জাতীয় পাট দিবস পালন করবে পাটশিল্প পল্লী না.গঞ্জ
প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০১৮, ১০:৩৩ এএম
স্টাফ রিপোর্টার (যুগের চিন্তা ২৪ ডটকম) : অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের রপ্তানি বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে ‘সোনালী আশেঁর সোনার দেশ, পাট পণ্যের বাংলাদেশ’- এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে দ্বিতীয়বারের মত সারা বাংলাদেশের ন্যায়ও জাতীয় পাট দিবস পালন করবে নারায়ণগঞ্জ জেলা পাট অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ জুট এসোসিয়েশন। এ পাট দিবস উপলক্ষ্যে র্যালী ও আলোচনার সভার আয়োজন করেছে পাট অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ জেলা।
৬ মার্চ (মঙ্গলবার) সকাল ১০টায় জেলা প্রশসাকের কার্যালয়ে সামনে থেকে র্যালীর আয়োজন করা হয়েছে। র্যালী শেষে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ জুট এসোসিয়েশন এ দিনটিকে কেন্দ্র করে আলোকসজ্জায় সজ্জ্বিত করেছে। উল্লেখ্য, প্রাচ্যের ড্যান্ডি নারায়ণগঞ্জ বাংলাদেশের অর্থনৈতির কেন্দ্রবিন্দু। বাংলাদেশের অন্যতম নদীবন্দর নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বেশ প্রসারিত এই নারায়ণগঞ্জ নগরী। ১৭৬৬ সাল থেকে শুরু হয় নারায়ণগঞ্জের অগ্রযাত্রা ।
১৭৬৬ সালে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা বিকন লাল পান্ডে ( বেণুর ঠাকুর বা লক্ষ্মীনারায়ণ ঠাকুর নামে ও পরিচিত)। তিনিই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিকট থেকে এ অঞ্চলের মালিকানা গ্রহণ করেন। নারায়ণের সেবার ব্যয়ভার বহনের জন্য একটি দলিলের মাধ্যমে শীতলক্ষা নদীর তীরে অবস্থিত মার্কেটকে দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করেন। তাই পরবর্তীকালে এ স্থানের নাম হয় নারায়ণগঞ্জ। ১৯৮৪ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলায় উন্নীত করা হয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতিক শিল্প সোনালী আঁশ পাট ছিল এক সময় বিশ্বখ্যাত। পৃথিবীর বৃহত্তম পাটকল আদমজি জুট মিলস নারায়ণগঞ্জ শহরে অবস্থিত হওয়ায় সে সময় পাট শিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল নারায়ণগঞ্জ। ঐ সময় পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানের বাংলাদেশ) এর উন্নতমানের পাট ব্যবহার করে আদমজী পাটকলে চট, কার্পেটসহ বিভিন্ন প্রকার পাটজাত দ্রব্য উৎপাদন করা হত।
তবে আদমজী পাটকল স্থাপনের পূর্ব থেকেই এ অঞ্চল পাট ব্যবসার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। তথ্য অনুসারে জানা যায়, ১৮৫০ সালে এই বন্দর থেকে ৩ কোটি গজ চট বস্ত্র ইউরোপ, আমেরিকায় রফতানি করে। তখন ১০০ চট বস্ত্রের মূল্যে ছিল ৭ টাকা। আর এ সকল পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি হতো চীন, ভারত, কানাডা, আমেরিকা,থাইল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।
এ সময় আদমজী জুট মিল হয় পৃথিবীর অন্যতম জুট মিল এবং এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ কারখানা। ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশে) ২য় পাট কল (প্রথমটি পাটকল ছিল বাওয়া পাট কল) আদমজী জুট মিল্স প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের অন্যতম ধনাঢ্য আদমজী পরিবারের তিন ভাই এ. ওয়াহেদ আদমজী, জাকারিয়া আদমজী ও গুল মোহাম্মদ আদমজী যৌথভাবে এ আদমজী জুটমিল প্রতিষ্ঠা করেন। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যার তীরে সিদ্ধিরগঞ্জের সুমিলপাড়ায় ২৯৭ একর জমির ওপর এ আদমজী জুট মিল গড়ে ওঠে।
১৯৫১ সালের ১২ ডিসেম্বরে ১৭০০ হেসিয়ান ও ১০০০ সেকিং লুম দিয়ে এই মিলের উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়। ওই সময় এই মিলের উৎপাদন থেকে প্রতি বছর প্রায় ৬০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো। ১৯৫১ সালের ১২ ডিসেম্বর যাত্রা শুরুর পর পরই আদমজী জুট মিলস লি. শেয়ার ছেড়ে বিনিয়োগ উন্নীত করা হয় প্রায় ৭ কোটি টাকার উপরে।
সে সময় মিলে ৩ হাজার ৩০০টি তাঁতকল বসানো হয় । দেশ স্বাধীনের আগ পর্যন্ত ( ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ) মিলটিতে প্রায় ২৪ হাজার ৯১৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক চাকরি করতেন। আদমজী জুটমিলটি সে সময়ই ব্যাক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে রুপান্তর হয়। যথাযথ পরিচালনা ও উৎপাদন মুখী হওয়ার ফলে তাদের লাভের পরিমান ছিল কোটি টাকা। সোনালী আশঁ পাটের জন্যই নারায়ণগঞ্জকে (স্কটল্যান্ডের ডান্ডির নামানুসারে) প্রাচ্যের ডান্ডি নামকরণ করা হয়।
কিন্তু ১৯৭০ এর দশকে প¬াস্টিক ও পলিথিন পাটতন্তুর বিকল্প হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এ আদমজী পাট কলের স্বর্ণযুগের অবসান হয়। ১৯৭৪ সালের ২৬ মার্চ রাষ্ট্রপতির আদেশবলে দেশের অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আদমজী জুট মিলকেও জাতীয়করণ করে এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলাদেশ জুট করপোরেশনকে (বিজেএমসি)।
১৯৮০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি লোকসানের সম্মুখীন হয় সাড়ে ১২০০ কোটি টাকা। সে সময় সরকার মিলটি বন্ধ করার উদ্যোগ নিলেও শ্রমিকদের বাধার উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত বন্ধ করতে পারেনি। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালের ৩০ জুন আদমজী জুট মিলটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়। এভাবেই আদমজী জুট মিলের সাথে সাথে সমাপ্তি হয় নারায়ণগঞ্জের বিশ্বখ্যাত পাট ব্যবসায়ের। তবে এখনও নারায়ণগঞ্জে বেশ কিছু সংখ্যক পাট বেলিং জুটপ্রেস রয়েছে।
বর্তমানে পুনরায় পাট শিল্পকে দেশের অর্থনৈতিক খাতে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছে সরকার। সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ জুট জিইও- টেক্সটাইলের অগ্রাধিকারভিত্তিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনাকারী সকল মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে। পাট পণ্যের ব্যবহার ও বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সরকার ‘জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারের (জেডিপিসি) মাধ্যমে নতুন নতুন পাটজাত বহুমুখী পণ্য উদ্ভাবন, বিভিন্ন মেলায় প্রদর্শন ও বিপণনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
ফলে পাটের অভ্যন্তরীণ ব্যবহার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কাঁচা পাটের চাহিদা ও মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমে পাটের গুরুত্ব বিবেচনায় পাট ও পাটজাত পণ্যের বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটসমূহের পাঠ্যক্রমভূক্ত করার জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। ইতিমধ্যে পাটচাষের উন্নয়ন,প্রসার,গবেষনা,
স্থানীয় ও আন্তজার্তিক বাজার চাহিদার সাথে সংগতি রেখে পাট ও পাটজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি,পাট চাষের জন্য ভূমি ব্যবহারের পরিকল্পনা,বহুমুখী পাটজাতপণ্যের গবেষণা, পাটচাষে উদ্বুদ্ধ করা, পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি, পাট ও পাটপণ্যের বাজার সম্প্রসারনে প্রয়োজনীয় প্রনোদনা ও পুরস্কার বিষয়ে কার্যক্রম গ্রহণের নিমিত্ত পাট আইন-২০১৭ প্রণয়ন করা হয়েছে।
এ আগে পাটপণ্যের অভ্যন্তরীন ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৭ টি পণ্যে মোড়কীকরণের জন্য পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০ ও পণ্যে পাটজাত বাধ্যতামূলক ব্যবহার বিধিমালা-২০১৩ আইন যা পাট অধিদপ্তরের সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে শতভাগ কার্যকর করা হয়েছে। এ বছর মে মাসে পাটশিল্পের দ্রুত বিকাশ এবং সম্প্রসারণের লক্ষ্যে পাটশিল্প পলি¬ গড়ে তোলার জন্য পাট উৎপাদনভিত্তিক এলাকা ও সম্ভাব্যতা যাচাই করণের জন্য সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
মূলত পাটের ব্যাগ, জুতাসহ বৈচিত্রময় পাটজাত পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে এই পাটশিল্প পল¬ী স্থাপনকরাই এ কমিটি গঠনের লক্ষ্যে। এখান থেকে পণ্য রপ্তানিরও ব্যবস্থা করা হবে। প্রাথমিকভাবে এমন ২১ জেলায় পাটশিল্প পলি¬ তৈরি করার সুপারিশ করা হয়েছে কমিটি থেকে। কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, ঢাকা জেলায় সবচেয়ে বেশি ২৬৬ জন পাটপণ্যের উদ্যোক্তা আছে।
ঢাকাসহ এমন আটটি জেলা আছে। অন্য জেলাগুলো হলো চট্টগ্রাম, রংপুর, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, খুলনা, জামালপুর ও নারায়ণগঞ্জ। নারায়ণগঞ্জ জেলায় বছরে দুই লাখ বেলের বেশি পাট উৎপাদন হওয়ায় এবং অন্তত ১০ জনের বেশি পাটজাত পণ্যের উদ্যোক্তা রয়েছে। তাই পাটশিল্প পল্লীর জন্য প্রাথমিকভাবে নারায়ণগঞ্জকে বাছাই করা হয়েছে।


