
স্টাফ রিপোর্টার (যুগের চিন্তা ২৪) : নারায়ণগঞ্জ ‘বঙ্গবন্ধু ও কবি নজরুল’ স্মৃতিবিজড়িত’ উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, নারায়ণগঞ্জের সাথে কাজী নজরুল ইসলামের আত্মিক সম্পর্ক ছিল। ১৯৭২ সালে কবিকে আমাদের দেশে আনার জন্য তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বঙ্গবন্ধু টেলিফোন করেছিলেন। পরে নারায়ণগঞ্জের সন্তান, বর্তমান সাংসদ শামীম ওসমানের চাচা এবং তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক মোস্তফা সারোয়ারকে পাঠিয়েছিলেন। ওই সময় তাঁর নেতৃত্বে কবিকে ঢাকায় আনা হয়েছিল। নারায়ণগঞ্জের শামসুজ্জোহা সাহেব বঙ্গবন্ধুর খুব ঘনিষ্ট সহচর ছিলেন। বঙ্গবন্ধু নারায়ণগঞ্জে অনেকবার এসেছিলে। আওয়ামী লীগ গঠনের পূর্বেও নারায়ণগঞ্জে মিটিং হয়েছিল। তাই ‘নারায়ণগঞ্জ বঙ্গবন্ধু ও কবি নজরুল এর অত্যন্ত স্মৃতিবিজড়িত।’
বৃহস্পতিবার (২৪ আক্টোবর ) সকাল সাড়ে ১০ টায় চাষাঢ়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কবি নজরুল ইনস্টিটিউট এর উদ্যোগে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় তিন দিনব্যাপী জাতীয় নজরুল সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন।
জেলা প্রশাসক মো.জসিম উদ্দিনের সভাপতিত্বে তিনদিনব্যাপী সম্মেলনের শুভ উদ্বোধন করেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটটের ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারম্যান জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানে প্রধান আতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন-নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনের সাংসাদ এ কে এম শামীম ওসমান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন-ভারতের আসানসোলের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক সাথী গুহ, সরকারি তোলারাম কলেজের অধ্যক্ষ বেলা রানী সিংহ, নারায়ণগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ বেদৌরা বিনতে হাবীব, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি নারায়ণগঞ্জের সভাপতি চন্দন শীল এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মেহেদি ইমরান সিদ্দিকী।
সহকারী কমিশনার মৌসুমী মান্নান ও মো. সাইদুজ্জামান হিমুর সঞ্চালনায় -আনুষ্ঠানে ‘জাতীয় কবি এবং জাতির পিতা’ শীর্ষক আলোচনায় মুখ্য আলোচক হিসেবে ছিলেন, কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের অতিরিক্ত সচিব নির্বাহী পরিচালক মো.আব্দুর রাজ্জাক ভূঞা। আলোচক হিসেবে ছিলেন, নজরুল ও চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ, নারায়ণগঞ্জ কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রুমন রেজা।
জাতীয় কবি এবং জাতির পিতা শীর্ষক আলোচনা করতে গিয়ে বক্তারা বলেন, বিশ শতকের ঘুমিয়ে থাকা বাঙালীকে সাহিত্যে-কাব্যে-গানে জাগ্রত করেেেছন নজরুর। আর বঙ্গবন্ধুও আমাদের জাগ্রত করেছেন তারঁ ৭ মার্চের ঐতিহাসি ভাষণের মাধ্যমে। তাই নজরুল ও বঙ্গবন্ধু মুক্তিকামী চেতনার ধারক।
বক্তারা বলেন, তাদের চেতনায় অদৃশ্য মিল রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বৃতি দিয়ে বক্তারা বলেন-‘নজরুল এবং বঙ্গবন্ধু একই সম্মেলনে।’ কাজী নজরুল ইসলাম ও বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী চেতনা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বঙ্গবন্ধুর চেতনা সমৃদ্ধ করার ব্যাপারে নজরুলের অবদান রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু ও কাজী নজরুল ইসলাম সর্ম্পকে বলতে গিয়ে বক্তারা বলেন, স্বাধীনতার পর ভারতের আসানসোলে কবির দুরবস্থা দেখে বঙ্গবন্ধু কবিকে বাংলাদেশে আনার কথা ভাবলেন। সে মোতাবেক ১৯৭২ সালে কবিকে বাংলাদেশে এনে তাকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিলেন। কবিকে ধানমন্ডির একটি সুসজ্জিত বাড়ি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। যেটি এখন নজরুল ইনস্টিটিউট সেখানে তখন সবুজে ঘেরা ছিল। বাড়িতে সবুজ ঘাসের বৃহৎ লন ছিল। কবির সম্মানে সে বাড়িতে প্রতিদিন জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হতো। এবং বিউগল বা করুণ সুরে মাধ্যমে তা নামানো হতো। পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রে বা রাষ্ট্র প্রধান কোনো কবিকে এমন সম্মান দিয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই, যেটা বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতীয়ং কবি কাজী নজরুল ইসলামকে দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ও কবি নজরুলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বক্তারা আরও বলেন, কবিকে দেয়া হয়েছিল ধানমন্ডির ২৮ নম্বরের বাড়িটি এবং বঙ্গবন্ধু থাকতেন তাঁর ৩২ নম্বর বাড়িতে। তিনি প্রায়ই কবিকে দেখতে যেতেন। ১৯৭৫ সালের দিকে বঙ্গবন্ধু একদিন গিয়ে দেখলেন কবি খুব অসুস্থ এবং তাঁর যতœ ঠিকমতো হচ্ছেনা। বঙ্গবন্ধু সাথে সাথে কবিকে তাঁর জিপে করে তৎকালিন পিজি হাসপাতালে নিয়ে আসেন এবং তৎকালীন হাসপাতালের পরিচালককে তার সার্বিক দেখাশুনার দায়িত্ব প্রদান করেন।
কবির জন্ম ও মৃত্যুর স্থানের কথা উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম হয়েছিল ভারতের আসানসোলে এবং মৃত্য হয়েছিল বাংলাদেশের ঢাকায়। তাঁর জন্ম ও মৃত্যু দিয়ে দুটি দেশকে বেঁধে দিয়েছে। বর্তমানে আমরা রং, ধর্ম ও বর্ণ নিয়ে ভাগ হতে হতে ছোট হয়ে আসছি। নজরুলকে কেন্দ্র করে আমরা নতুন পৃথিবী গড়তে পারি। উনি আমাদের পথ দেখিয়েছেন সাম্যের, বিদ্রোহের। তাঁর বিদ্রোহী কবিতা ১০০ টি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। যা পৃথিবির ইতিহাসে বিরল।
কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার রূপক অর্থ আছে উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, নজরুল তার কবিতার মধ্যে লিখেছেন-‘বিশ্ব জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয়ে পুরে’। বর্তমানে আমরা মেবাইল ফোনের মাধ্যমে পৃথিবীকে হাতের মুঠোয়ে নিয়ে আসছি যা কবি তার কবিতায় বলেছে। ‘হাউই চড়ে চায় যেতে কে চন্দ্রলোকের অচিন পুরেঃ’ কবিতার এ লাইর দিয়ে কবি মহাকাশ ভ্রমণের কথা বলেছেন। বর্তমানে আমাদের বঙ্গবন্ধু কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়েছি।
বক্তারা বলেন, বাঙালী মুষলমানদের মধ্যে প্রথম চিত্র পরিচালক ছিলেন নজরুল। সাংবাদিকতায়, চলচ্চিত্রে, বেতারে নাটকে তিনি কাজ করেছেন সামানতালে। তার গানের সংখ্যা ৩হাজার ১৭৪ টি, উপন্যাস লিখেছেন ৩ টি, নাটক লিখেছেন সবমিলিয়ে ১০৬ টি, ২২ টি- এর মতো চলচ্চিত্রে তিনি কাজ করেছে। তাঁর ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ এই গানের প্রায় ৭০-৮০ হাজার পোস্টার হয়েছিল তখনকার সময়।
নারায়ণগঞ্জের সাথে কাজী নজরুল ইসলামের আত্মিক সম্পর্ক উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, নারায়ণগঞ্জের একজন প্রখ্যাত কবি বেনজির আহম্মেদের একটি বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯৩৩ সালেন আগস্টে নারায়ণগঞ্জে আসার জন্য এখানকার গানের শিল্পীদের কবি ছিঠিও লিখেছিলেন। তাঁর সাথে আরও অনেকেরই সেদিন আসার কথা ছিল। কিন্তু কেনো এক দুর্ভাগ্যক্রমে কবির আসা হয়নি।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে প্রধান অতিথি শামীম ওসমান বলেন, কাজী নজুরুল ইসলাম এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কেনো প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট ছিলনা। কিন্তু তারা প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত ছিল। তাই সার্টিফিকেট যত থাকুক তোমরাও তাঁদের মতো প্রকৃত শিক্ষিত হও, প্রকৃত মানুষ হও এবং মানবিক হও। কাজী নজরুল ইসলাম সাম্যের গান গেয়েছেন। আমাদের চেতনায় আমরা কাজী নজরুল ইসলামের আদর্শ ধারণ করবো।
অনুষ্ঠানের শুরুতে অতিথিদের উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়া হয়। স্বাগত বক্তব্য রাখেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের সচিব ও জাতীয় নজরুল সম্মেলনের প্রকল্প পরিচালক মো.আব্দুর রহিম। উদ্বোধনী সঙ্গীত কাজী নজরুল ইসলামের “মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম, মোরা ঝর্ণার মত চঞ্চল।/ মোরা বিধাতার মত নির্ভয়, মোরা প্রকৃতির মত সচ্ছল।।” পরিবেশন করেন জেলা শিল্প কলা একাডেমির শিল্পীরা । সবশেষে অতিথিদের হাতে অনুষ্ঠানের সম্মাননা স্মারক তুলে দেওয়া হয় ।
এর আগে জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিনের নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে একটি বর্ণাঢ্য র্যালি অনুষ্ঠিত হয়। র্যালিটি নারায়ণগঞ্জ সরকারি গণগ্রন্থাগার থেকে শুরু হয়ে বঙ্গবন্ধু সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে চাষাঢ়া কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে অনুষ্ঠানস্থলে এসে শেষ হয়।
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা শুরু হওয়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করবেন সম্মানিত কবি কাজী রোজী এবং রেজাউদ্দীন স্টালিন। সঙগীত পরিবেশন করবেন খায়রুল আনাম শাকিল, কমি হাসান খান, সঞ্জয় কবিরাজ, শায়েস্তা কাদের মুন্নি, শারমিন সুলতানাসহ স্থানীয় শিল্পীবৃন্দ। নিত্যালোক সাংস্কতিক কেন্দ্রের শিল্পীরা পরিবেশন করবেন নৃত্য।
প্রকল্প পরিচালক আব্দুর রহিম জানান, ‘নজরুলের অপ্রচলিত গানের সুর সংগ্রহ, স্বরলিপি প্রণয়ন, সংরক্ষণ, প্রচার এবং নবীন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধকরণ’-শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ‘জাতীয় নজরুল সম্মেলন’ এর আয়োজন করা হয়েছে। সম্মেলনে পাঁচ দিনব্যাপি নজরুল সংগীতের প্রশিক্ষণ, নজরুলের জীবনীভিত্তিক তথ্যচিত্র প্রদর্শনী, আলোচনাসভা, বইমেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সম্মেলনে নারায়ণগঞ্জের ১০টি স্কুল ও কলেজের বাঁছাই করা শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করছে।
জাতীয় নজরুল সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন শুক্রবার (২৫ অক্টোবর) বিকেল ৩টায় জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিনের সভাপতিত্বে সরকারি তোলারাম কলেজে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো.নিজাম উদ্দিন।