বন্দরে লীজের জায়গা দখলে চেয়ারম্যানের অভিনব কৌশল

যুগের চিন্তা রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২৩, ০৭:১৮ পিএম

# সওজের সীমানার ভিতর আবারও নির্মাণ হচ্ছে দোকান
# লীজের মালিককে দেখে নেওয়ার হুমকি চেয়ারম্যানের
# প্রয়োজনীয় জায়গা রেখেই এখন দোকান নির্মাণ করছে : ইউপি চেয়ারম্যান
বন্দরে রেলওয়ের জায়গা লিজ নেওয়ার পর সেই জায়গা দখলে নিতে চাইলে জমির লীজ মালিক মো. সোহেলকে বাধা দিচ্ছেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এহসান উদ্দিন। এই বিষয়ে তাকে দেখে নেওয়াসহ প্রাণ নাশের হুমকি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সোহেল।
অন্যদিকে এই ঘটনায় অভিযোগ করতে থানায় গেলে থানা তার অভিযোগ গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ করেন তিনি। ঘটনাটি বন্দর উপজেলার বন্দর ইউনিয়নের নবীগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকার। বিষয়টি তিনি নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য একেএম সেলিম ওসমান ও বন্দর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এমএ রশিদকে অবহিত করেছেন বলে জানান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নবীগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় মদনগঞ্জ-মদনপুর সড়কের দক্ষিণ-পূর্ব কোনের জায়গাটি একসময় মো. সোহেলের বাপ-দাদার নামে ছিল। ১৯৪৪ সালে সরকারের রেলওয়ে বিভাগ অন্যান্য জায়গার সাথে এই জায়গাটিও অধিগ্রহণ করেন। তবে রেল লাইনের এই জায়গার বেশিরভাগ অংশই অব্যবহৃত অবস্থায় ছিল।
তাই ২০১৪ সালে রেলওয়ে বিভাগ থেকে সেই জায়গা থেকে তিন শতাংশ জায়গা লীজ নেন তিনি। কিন্তু সেই জায়গাটি সোহেল যেন দখল করতে না পারে সে জন্য এর প্রবেশ মুখ এহসান উদ্দিন চেয়ারম্যান তার লোকজন দিয়ে দোকান নির্মাণ করে এবং নাজির হোসেন নামের তার চেল্লাকে দিয়ে সেই জায়গার পাশে একটি জায়গা লীজ নেওয়ার একটি কাগজ করেন।
অথচ এখানকার কোন জায়গা এখন নতুন করে রেলওয়ে কোন লীজ দিচ্ছে না বলে রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে। সম্প্রতি সড়ক ও জনপথ বিভাগ এই রাস্তাটি প্রশস্ত করার জন্য দুই পাশের স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দিলে আশার আলো দেখেন সোহেল।
কেননা সওজের মার্কিং অনুযায়ী স্থাপনা ভাঙ্গার পরও বেশ কিছু জায়গা থাকে সোহেলের। ফলে সেখানে সে দোকান নির্মাণ করে জীবিকার একটি গতি করা সম্ভব হবে বলে সেই প্রস্তুতি নিতে থাকেন তিনি। কিন্তু এহসান চেয়ারম্যান অর্থ ও আধিপত্যের মাধ্যমে তাদের সেই চেল্লাদের দিয়ে আবারও দোকান তৈরি করেন বলে জানা যায়।
সরেজমিন পরিদর্শন বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়, রাস্তাটির প্রশস্ত আরও বাড়ানোর জন্য রাস্তার সেন্টার থেকে দুই দিকে সাড়ে ১২ মিটার করে অর্থাৎ ৪১ ফুট জায়গা খালি করার নির্দেশনা দিয়ে রাস্তার উভয় পাশেই মার্কিং করা হয়েছে। লাল দাগ দিয়ে মার্কিং করে কোন জায়গা পর্যন্ত খালি করতে হবে তার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সড়ক ও জনপথ এর লোকজন এসে এখানকার বেশ কিছু দোকানপাট ভেঙে দেয় এবং তা নির্দিষ্ট দূরে নির্মাণ করার নির্দেশ দেন। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী নবীগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের পশ্চিম পাশে অবস্থিত বন্দর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এহসান উদ্দিনের মার্কেটেও এই লাল মার্কিং করা হয়।
কিন্তু সেই মার্কেট ভাঙাতো দূরের কথা সেখানে একটি আচড়ও পড়েনি। স্থানীয় একাধিক সূত্র জানান, চেয়ারম্যান এবং সওজের কিছু অসাধু কর্মকর্তার মধ্যে একটি সমঝোতা হয়। তাই তার মার্কেটটিকে এড়িয়ে যান সওজের মাঠ কর্মীরা।
অন্যদিকে এহসান চেয়ারম্যানের মার্কেটের বরাবর রাস্তার পূর্ব পাশের দোকানপাট যারা তৈরি করেছেন তারাও এহসান চেয়ারম্যানের খুব কাছের লোক। তাই এগুলো ভেঙ্গে দেওয়ার পরও আবার তা সওজের মার্কিং করা সীমানার মধ্যেই নতুন করে তৈরি করছেন।
এই বিষয়ে এহসান চেয়ারম্যান সেসব দোকানের মালিকদের নিয়ে সওজের সাথে একাধিকবার মিলিত হয়েছেন বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। তাই বিষয়টিকে ধামাচাপা দিতে সম্প্রতি একটি ভিডিও সাক্ষাতকারে চেয়ারম্যান এহসান উদ্দিন বলেছেন, অনেক হতদরিদ্র লোক এই সড়কের দুইপাশে দোকানদারী করে পরিবারের ভরণ পোষণ করছেন, তারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
দোকানপাট এরমধ্যেই ভাঙা হয়েছে। যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু ছেড়ে দিয়ে তারা নতুন করে দোকান মেরামত করে নতুন করে ব্যবসা শুরু করার প্লান করছেন এবং অনেকে শুরুও করেছেন। প্রয়োজনের বেশি ভাঙ্গলে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেখা যাবে ৬ মাস পর তারা পুনরায় এখানে দোকানপাট তুলে ব্যবসা করবেন।
তাই তিনি দোকানপাট ভেঙ্গে খালি জায়গা তৈরি না করার পরামর্শ দেন। অর্থাৎ সওজের কতটুকু জায়গা দরকার তা নির্ধারণও তিনি করতে চাচ্ছেন তার বাহিনীর সদস্যদের জন্য। এমনকি মিডিয়ায় প্রকাশের পর একদিন আগে এখানে মাইকিংয়ের মাধ্যমে স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিলেও মাইকিং শেষে তারা যেন তাদের নির্মাণ কাজ চালিয়ে যান এবং দু’একদিন গেলে এসব ঠান্ডা হয়ে যাবে বলে গোপনে তাদের আশ্বস্ত করে যান বলেও বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পাওয়া গেছে।
এই বিষয়ে ভূক্তভোগী মো. সোহেল বলেন, যে জায়গাটি নিয়ে সমস্যা সেই জায়গাটি ছিল আমার বাপ-দাদার। ১৯৪৪ সালে এই জায়গাটি তৎকালীন সরকারের রেলওয়ের বিভাগ অধিগ্রগণ করেন। দীর্ঘদিন যাবত যেহেতু জায়গাটি সরকারের কোন কাজে লাগছে না, তাই আমি ২০১৪ সালে মাননীয় রেলমন্ত্রী বরাবর আবেদন করি, সেখানে আমি এই জায়গাটি এক সময় আমার পূর্ব পুরুষের ছিল উল্লেখ করে বর্তমানে আমাকে এখান থেকে একটি অংশ কিছু করে খাওয়ার জন্য দেওয়ার অনুরোধ জানাই।
সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ প্রথমে একবছরের জন্য আমাকে অনুদান হিসেবে দেয়। পরে তা আমাকে দীর্ঘমেয়াদী লীজ হিসেবে দেয়। তখন থেকেই আমি জায়গার খাজনাপাতি নিয়মিত পরিশোধ করে আসছি। কিন্তু শুরু থেকেই বন্দর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এহসান উদ্দিন আহমেদ আমি যেন এই জায়গা ব্যবহার করতে না পারি সেজন্য বিভিন্ন ফন্দি ফিকির করে আসছে। তার অনুগত লোকজন দিয়ে আমার জায়গার সামনে দিয়ে জোরপূর্বক দখল নিয়ে রেখেছে।
আমি এই বিষয়টি মিমাংসার জন্য তার কাছে অনেকবার গিয়েছি। কিন্তু সে কোন পাত্তা দেয়নি। কিছুদিন আগেও আমি সকল কাগজপত্র নিয়ে তার কাছে গিয়েছি। কিন্তু সে কাগজপত্র দেখতে বা রাখতে রাজি হয়নি। সে আমাকে বলে ‘তুমি যা পারো করো গিয়ে’।
সোহেল আরও জানান, বর্তমানে এহসান চেয়ারম্যান নাজির হোসেন নামের তার এক বিশ্বস্ত লোক দিয়ে সেখানে দোকান নির্মাণ করছে। কিছুদিন আগে আমি যখন সওজ (সড়ক ও জনপথ) এর কার্যালয়ে যাই তখন এহসান চেয়ারম্যান এই নাজির হোসেনসহ তার অনুগত আরও বেশ কয়েকজনকে নিয়ে সেখানে গিয়েছিল। তখন এহসান চেয়ারম্যান আমাকে সকলের সামনে হাত-পা ভেঙে ফেলাসহ প্রাণ নাশের হুমকিও দেয়।
এই বিষয়ে নাজির হোসেন বলেন, সোহেল মিয়া যে তিন শতাংশ জায়গা লীজ এনেছে তা পুকুরের পিছনে। আমরা যেই দাগে এনেছি সে একই জায়গায় এনেছে। সেখানে তার জায়গা আছে। তিনি বলেন, আমাদেরকে সড়ক কর্তৃপক্ষ রাস্থার মাঝখান থেকে ৩০ ফুট জায়গা রেখে কাজ করতে বলেছে, কিন্তু আমরা রাস্তার মাঝখান থেকে ৩৫ ফুট জায়গা রেখে কাজ করতেছি (দোকান নির্মাণ করতেছি)। তাদের যে পর্যন্ত জায়গা লাগে সে পর্যন্ত জায়গা নিবে।
তিনি বলেন, আমি ২০১৮ সালে রেলওয়ের কাছ থেকে এই জায়গা লীজ এনেছি। আমাকে যে জায়গা লীজ দেওয়া হয়েছে তার চৌহদ্দীর বর্ণনা করা আছে। ৬/৭টি দাগ একসাথে মিলে একটি আরএস হয়।
এ বিষয়ে বন্দর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এহসান উদ্দিন বলেন, আমি তাকে বাধা দেওয়ার কে? লীজের কাগজপত্র যদি তার কাছে থাকে, জায়গার মালিক যদি সে হয়, তাহলে আমি বাধা দিব কেন? দেশে আইন আছে, কোর্ট আছে, মামলা মোকদ্দমা আছে সমস্যা কি? আমি কেন তাকে হুমকি দিতে যাবো? এই নবীগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড ছাড়া আর কোন জায়গা নাই? মদনগঞ্জ-মদনপুর সড়কের এতবড় জায়গা, যেখানে সরকারের যতটুকু দরকার সরকার ভাঙ্গতেছে আবার করতেছে।
এখানে আইসা লীজ আনছে। আমি তাকে বলছি কাগজপত্র জমা দে, যদি এরকম হয় আমি দেখবো। সে এসে খোঁচাখুঁচি করতেছে, আজকে থেকে না, পাঁচ বছর আগে থেকেই। কোন কাগজ সে দেখাতে পারে না। বাপ-দাদার সম্পত্তি হলে আমি যেখানে দোকান করছি সেই জায়গাওতো সরকার নিয়ে গেছেগা। যখন দখলে নিয়ে যায় তখনতো আর আমাদের সম্পত্তি থাকে না।
আমি বলছি, সে যে জায়গা লীজ এনেছে তার পেছনে আমাদের সম্পত্তি, তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমরা সেই জায়গা ব্যবহার করবো। যখন সরকারের জায়গা দরকার পড়ে তখন সরকার নিয়ে যাবে। মার্কেট ভাঙ্গার বিষয়ে তিনি বলেন, আমার মার্কেটের উপর ৬/৭ ফুটের একটি চাল ছিল আমি প্রথমেই তা ভেঙ্গে দিয়েছি, এরপর অন্যরা ভাঙ্গছে।
মার্কিয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, মার্কিং করছে ঠিক আছে, কিন্তু রাস্তার যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই নিবে, এখানে ঘাপলামি করতেছে। সরকারী জায়গা যখন লাগবে তখন নিবে। যতটুকু লাগবে ভেঙ্গে দিব, সমস্যা নাই। আমিতো জোরজুলুম করে রাস্তার কাজে বাধা দেইনি।
এখানে দোকানপাট আছে যা দিয়ে তারা সংসার চালায়, এই জায়গা ভেঙ্গে দিলেই কি সবাই খুশি। সরকারে যখন দরকার লাগবে তখন ভেঙ্গে দিব। এখানে কারও কিছু বলার দরকার পড়ে না। এটা চেয়ারম্যানের তাই অনেকের চোখে লাগে। ক্ষমতা আগর-বাগর করার কি সময় আছে এখন! যে চেয়ারম্যানরা ক্ষমতা বা দাপট দিয়ে দখল করে রাখবে।