Logo
Logo
×

জনদুর্ভোগ

বায়ু দূষণে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

Icon

আবু সুফিয়ান

প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২২, ০৭:২৮ পিএম

বায়ু দূষণে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি
Swapno

 

# শহরের বাতাসে ক্যাডমিয়াম বেশি ২০০ গুণ
# সিসার মাত্রা দ্বিগুণ ও ক্রোমিয়াম বেশি তিনগুণ

 

নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন কারণে দূষিত হচ্ছে বাতাস। যার কারণে কমছে বাতাসের অক্সিজেনের মাত্রা। আর এ কারণে বাড়ছে সাধারণ মানুষের মাঝে বিভিন্ন রোগের প্রকোপ। হুমকির মধ্যে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন সড়কে ধুলাবালির দূষণে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। প্রতিদিনই ধুলার দূষণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন রাস্তায় চলাচলকারীরা। বর্তমানে আবহাওয়া শুষ্কতার কারণে যানচলাচলের সঙ্গে প্রচণ্ড পরিমাণে ধুলাবালি ছড়িয়ে নানা রোগের আক্রান্ত হচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষ। এমনকি আবাসস্থলও বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। সড়কের ধুলা-দূষণ মানুষের বাড়তি সমস্যায় ফেলছে।

 

এ থেকে পরিত্রাণ পেতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরদারি কামনা করছেন নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষ। দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ অন্যতম। এই শহরের পরিবেশ বেশি অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠেছে। রাস্তায় নামলেই মনে হয় রাস্তাগুলোতে যেন ধুলার রাজত্ব। রাস্তায় খোঁড়াখুড়ি আর বিভিন্ন নির্মানযজ্ঞের কাজ থেকেই এই ধুলাবালির সৃষ্টি। এছাড়াও যানবাহনের কালো ধোঁয়া, ইটভাটার কালো ধোঁয়া প্রভৃতি বায়ুতে মিশে অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠেছে নারায়ণগঞ্জের বাতাস।

 

সরকারি তোলারাম কলেজের শিক্ষার্থী মামুন মিয়া বলেন, বর্তমানে পুরো নারায়ণগঞ্জ ধুলাবালির নগরীতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে সাইনবোর্ড থেকে চাষাড়া সড়ক, পঞ্চবটি থেকে চাষাড়া সড়ক, পঞ্চবটি মুন্সীগঞ্জ সড়ক, পঞ্চবটি থেকে পোস্তগোলা সড়কসহ আরও কয়েকটি সড়কে ধুলাবালি এত বেশি যে, দেখে মনে হবে কুয়াশায় ঢাকা। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে স্কুলগামী শিশু ও পথচারীদের। ধুলাবালি থেকে রেহাই পায় না সড়কের পাশে থাকা বিভিন্ন স্থাপনাসহ দোকানপাট। সড়কের পাশে থাকা সবুজ পাতাগুলোও ধূসর হয়ে গেছে।

 

নারায়ণগঞ্জ কলেজের শিক্ষার্থী মো. রাকিব বলেন, ধুলার কারণে রাস্তায় হাঁটা যায় না। আবার মাস্ক ছাড়া বাসা থেকে বের হলে হাঁচির সমস্যা দেখা দেয়। তাই জরুরি ক্লাস বা কাজ না থাকলে বাসা থেকেই বের হন না। সাধারনত শীতের সময়টাতেই এই সমস্যাটা বেশি দেখা যায়। যদিও এবারে শীতের অনেকটা আগ থেকেই এ সমস্যাটা শুরু হয়েছে। ধূলিকণা রাস্তায় বেশি থাকায় প্রতিনিয়ত দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে এই শহরের বাসিন্দারা। ফলে শহর জুড়েই দেখা দিচ্ছে অ্যাজমা, সিওপিডি, এআরআই এর মতো বিভিন্ন রোগের প্রকোপ। আর এর শিকার বেশি হচ্ছে শিশু ও বয়স্ক মানুষেরা।

 

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূষণের শিকার দরিদ্র নারী ও শিশুরা ব্যাপকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে। কারণ তাদের বেশিরভাগই দূষিত এলাকায় বসবাস করেন, যেখানে সীসা দূষণেরও ঝুঁকি রয়েছে এর ফলে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশে এবং স্নায়ুবিক ক্ষতি হতে পারে। মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান লরেন্স বের্কলি ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি বলছে, রাসায়নিক মিশ্রণ আছে, এমন দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে থাকলে চোখ, নাক বা গলার সংক্রমণ বা ক্ষতির কারণ হতে পারে। সেই সঙ্গে ফুসফুসের নানা জটিলতা, যেমন ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়া, মাথাব্যথা, অ্যাজমা এবং নানাবিধ অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দিতে পারে।

 

বায়ু দূষণের সঙ্গে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক দেখতে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন বায়ু দূষণের মধ্যে থাকলে বা এরকম পরিবেশে কাজ করলে ফুসফুসের ক্যান্সার এবং হৃদরোগের দেখা দিতে পারে। এমনকি সেটা মস্তিষ্ক, লিভার বা কিডনির দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাও তৈরি করতে পারে। শীতকালে প্রতিবছরই ধুলা বেড়ে যায়। ধুলা দূষণে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, এলার্জি, চর্মরোগসহ নানা জটিল রোগব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ধুলা দূষণে জনদুর্ভোগের পাশাপাশি একদিকে যেমন স্বাস্থ্যগত সমস্যা হচ্ছে, তেমনি পরিবেশেরও ক্ষতি হচ্ছে।

 

নারায়ণগঞ্জ জেলায় বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি আর যানবাহন চলাচলের সময় ধুলা-বালি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় ধুলা দূষণের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় অবিলম্বে ধুলা দূষণ বন্ধে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে এখনি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বাতাসের গুণগত মান নির্ভর করে বায়ুতে ভাসমান সূক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণ (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম-১০) এবং অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণের (পিএম ২.৫) ওপর। এগুলো পরিমাপ করা হয় প্রতি ঘনমিটারে মাইক্রোগ্রাম এককে।

 

পিএম ২.৫, পিএম ১০ ছাড়াও সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ও গ্রাউন্ড লেভেল ওজনে সৃষ্ট বায়ু দূষণ বিবেচনা করে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বা একিউআই তৈরি হয়। একিউআই নম্বর যত বাড়তে থাকে, বায়ুমান তত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, বাতাসের একিউআই মাত্রা শূন্য থেকে ৫০ পিপিএম হলে তাকে 'সবুজ' বা 'স্বাস্থ্যকর' বায়ু বলা হয়। একিউআই মাত্রা ৫১ থেকে ১০০ পিপিএম হলে তাকে 'মধ্যম' বায়ু বলা হয়, যা মানুষের জন্য তেমন ক্ষতিকর নয়। মাত্রা ১০১ থেকে ১৫০ পিপিএম হলে সেই বায়ুকে 'সতর্কতামূলক' বায়ু বলা হয়, যা মানুষের জন্য মৃদু ক্ষতিকর।

 

একিউআই মাত্রা ১৫১ থেকে ২০০ পিপিএম হলে তা 'অস্বাস্থ্যকর' শ্রেণিতে বিবেচনা করা হয়। ২০১ থেকে ৩০০ পিপিএম একিউআই মাত্রার বাতাসকে 'খুবই অস্বাস্থ্যকর' এবং ৩০১ থেকে ৫০০ পিপিএম মাত্রার বাতাসকে 'চরম অস্বাস্থ্যকর' বলে চিহ্নিত করা হয়। সাম্প্রতিক কালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ২.৫ মাইক্রোমিটার আকৃতির ভাসমান বস্তুকণা নারায়ণগঞ্জে ৯৪.০৫। যার সহনীয় পরিমাণ হচ্ছে, ৫০ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনফুট। উপরন্তু নারায়ণগঞ্জের বাতাসে ক্যাডমিয়াম প্রায় ২০০ গুণ বেশি, নিকেল ও সিসার মাত্রা প্রায় দ্বিগুণ ও ক্রোমিয়াম প্রায় ৩ গুণের বেশি।

 

শীতকালের কারণে বাতাসে ধুলাবালির পরিমাণ বেশি হওয়ায় শ্বাসকষ্টজনিত রোগসহ বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শীত ও ঠাণ্ডাজনিত কারণে বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। তাই নারায়ণগঞ্জের চিকিৎসকদের পরামর্শ, ধুলাবালি থেকে পরিত্রাণ পেতে সবাইকে অবশ্যই মাস্ক পরিধান করতে হবে। রাস্তার ধুলাবালির কারণে শিশু ও বয়স্কদের ফুসফুস এবং শ্বাসনালিতে সংক্রমণ দেখা দেয়। এ ছাড়া যক্ষ্ণা, ব্রঙ্কাইটিস, চোখের সমস্যা, বদহজম, অ্যালার্জিসহ ভাইরাসজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

 

দীর্ঘদিন ধুলাবালির পরিবেশে থাকার ফলে একপর্যায়ে ক্যান্সার, এমনকি কিডনিতেও সমস্যা হতে পারে। অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুদের এ ধুলাবালি থেকে আরও বেশি দূরে থাকা উচিত। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নির্মল বায়ু আইন প্রবর্তন ও পরিবেশ আদালত কার্যকর করার পাশাপাশি এ বিষয়ে কঠোর হতে হবে এবং বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এছাড়া বায়ু দূষণ রোধে যে আইনগুলোর খসড়া তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোকে দ্রুত পাশ করা এবং আইনের প্রয়োগ জরুরি।

এস.এ/জেসি

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher
ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন