Logo
Logo
×

বিশেষ সংবাদ

মতির নাকের ডগায় বিহারী ক্যাম্পে নিত্যপণ্যের মতো বিক্রি হচ্ছে মাদক

Icon

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৩, ০৯:২৮ পিএম

মতির নাকের ডগায় বিহারী ক্যাম্পে নিত্যপণ্যের মতো বিক্রি হচ্ছে মাদক
Swapno

 

সিদ্ধিরগঞ্জে নির্বিঘ্নে নিত্যপণ্যের মতো বিক্রি হচ্ছে হিরোইনসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক। এতে ধ্বংস হচ্ছে যুব সমাজ। জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) ৬ নং ওয়ার্ডে অবস্থিত একটি ক্যাম্প, যার নাম বিহারী ক্যাম্প বা বিহারী পট্টি। প্রায় ১০ হাজারের অধিক মানুষের বসবাস এলাকাটিতে। বাঙালির সংখ্যা নেই সেখানে, যত মানুষই আছে তারা সবাই পাকিস্তানি বংশধর।

 

লোকমুখে বলা হয় সিদ্ধিরগঞ্জের অন্যতম কলঙ্কিত স্থান এটি। কেননা এখানেই মিলে হরেক রকমের সমাজ ধ্বংসের অস্ত্র মাদকদ্রব্য। আর তা বিক্রিও হয় প্রকাশ্যে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর আদমজীস্থ ৬ নং ওয়ার্ডে বিহারী ক্যাম্পটি অবস্থিত হয়। পুরো ক্যাম্প জুড়ে ১১টি সেক্টর রয়েছে। প্রতিটি সেক্টর ইংরেজি অক্ষর দ্বারা আলাদাভাবে ভাগ করা। শুরুতে কামাল নামের একজন নেতৃত্ব দিলেও তার মৃত্যুর পর ক্যাম্পটিকে দীর্ঘ ৩২ বছর যাবৎ নেতৃত্বে দিয়ে আসছে মো: লিয়াকত হোসেন নামক ব্যক্তি। 

 

একসময় ওই এলাকার বাসিন্দাদের কর্ম বলতেই মানুষ জানতো সেলুনের কাজ (নাপিত), কসাই আর নারীদের ক্ষেত্রে নানা ধরনের কাটচুপি অর্থাৎ জামাকাপড়ের ডিজাইন করা। কিন্তু আদমজী ইপিজেড স্থাপনার পর সুফল পান বিহারীরা। বর্তমানে অনেক নারী-পুরুষের কর্মস্থান ইপিজেড। আবার বহু পুরুষ ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা চালিয়েও জীবনযাপন করে যাচ্ছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ক্যাম্পের প্রায় প্রতিটি ঘরের কোনো না কোনো সদস্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে মাদক বিক্রির সঙ্গে সম্পৃক্ত।

 

আদমজী জুটমিল ভেঙে ইপিজেড স্থাপনার পর শিল্প-বাণিজ্যিক এরিয়ায় পরিনত হন গুরুত্বপূর্ণ এ ওয়ার্ডটি। এদিকে জনসম্মুখে রমরমা মাদকের ব্যবসা সচেতন ও শিক্ষিত মানুষের জন্যে অস্বস্তিকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাউন্সিলর অফিসের সুত্র বলছে, ২০ হাজার ভোটার রয়েছে পুরো ৬ নং ওয়ার্ডে। তার ভেতর বিহারীদের নির্দিষ্ট ভোটার সংখ্যা জানা নেই তাদের। 

 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বিহারী ক্যাম্পটি দুই ভাগে বিভক্ত। ৩ নম্বর পুকুরটির এপার আর ওপার মিলিয়ে সব বিহারিদের বসবাস। একপাশের নাম '৩ নম্বর টিন পট্টি' এবং তার বিপরীত দিকের নাম সিমুল পাড়া চেয়ারম্যান অফিস। পুরো এলাকাজুড়ে প্রায় ২৫'শ পরিবার থাকেন। কিন্তু সেখানে ঘুরলে দেখা মেলে ভয়ংকর দৃশ্যের। 

 

দীর্ঘ ১ মাসের অধিক সময়ের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিহারি ক্যাম্পের দুটি আলাদা-আলাদা সারির মাদক কারবারিদের ভয়ানক কর্মকান্ড। ওইখানকার প্রতিটি অলিগলি জমজমাট থাকে কারবারিদের বেচা কেনায়। শুধু পুরুষই নন ঘরের নারীরাও বিক্রিতে ব্যস্ত সময় পার করে। এক কথায় মুড়ি-মোয়ার মতোই চলে মাদকের বেচাকেনা। টাকা নিয়ে হাত বাড়ালে মুহূর্তেই মেলে হিরোইন-ইয়াবা-গাঁজা। বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে, সেখানকার সেলুনের দোকানগুলোই মাদক ব্যবসার নিরাপদ স্থান। অনুসন্ধান করে চিহ্নিত কিছু মাদক চোরাকারবারিদের নাম-পরিচয় জানা সম্ভব হয়েছে। 

 

বিহারী ক্যাম্পের '৩ নম্বর টিন পট্টি' এরিয়া জুড়ে মাদকের বেচাকেনায় যারা সরব থাকে ওই ব্যক্তিরা হলো: নাহিদ! এই ব্যবসায়ী ' ৩ নাম্বার পট্টি' এরিয়ার বস হিসেবে পরিচিত মূখ। মাদক ব্যবসায়ীদের শীর্ষে তিনি। একাধিকবার প্রশাসনের কাছে আটক/গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে এলাকার বাহিরে পলাতক রয়েছে। তবে তার সাম্রাজ্যের নতুন বস হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে ইব্রাল নামক আরেক ব্যক্তি।

 

এবার আসা যাক অন্যান্য ব্যবসায়ীর পরিচয় ও মাদকের বিবরণে।

'৩ নম্বর টিন পট্টি' যে আইটেমের মাদক বিক্রি হয়: মরণনেশা হিরোইন বিক্রেতার তালিকায় রয়েছে- খলিলের ছেলে মুরাদ, ফকিরার ছেলে ছনু, আজাদ, স্বামীর নাম শুক্কুর আর স্ত্রী হিরা দুজন মিলেমিশে হিরোইনের সাথে গাঁজাও বিক্রি করে, রহিমের ছেলে রাজ (গাঁজা+হিরোইন), মুরাদ ও মুন্নার ছেলে দিপা।

 

গাঁজা বিক্রেতার নাম : রসুলের ছেলে ইয়ামিন, চাটাই (নারী), দুখুনি (নারী), নাদিম, গফুর ভান্ডারীর ছেলে মোস্তফা, বাবুর ছেলে হিরা, ভানছুয়ার জসিম। ইয়াবা বিক্রেতা: স্বপন, হানিফ সব ধরনের মাদক বিক্রিতে আছে, বোতলার ছেলে আজগরি, বাবুর ছেলে জুম্মন ও আসমা (নারী)।

 

এবার আসি সিমুলপাড়া চেয়ারম্যান অফিস সংলগ্নের তালিকায়: হিরোইন বিক্রিতে যারা আছেন- হালিম মাস্টারের ছেলে তাসলিম, খুরশিদদের ছেলে শামীম, খাটিয়া গুড্ডু (হিরোইন+ ইয়াবা, আকরাম, মুসলিমের ছেলে ধাপালি আজগর, সিমবাদ ও তার মা, আলো (নারী) হিরোইন+ ইয়াবা), মানিকের ছেলে হিরা, নাদিমের ছেলে রাজ, মুন্নার ছেলে সওদাগর, ইউনুসের ছেলে কিরণ, বিল্লালের ছেলে আল আমীন (হিরোইন+ ইয়াবা), মোস্তফার ছেলে টন, মানসুরের ছেলে আরমান, আলমগীরের ছেলে রকি, গদিয়ালী (নারী)।

 

ইয়াবায় রয়েছে: হাসানের ছেলে বুদ্ধু, গাঁজা বিক্রেতার তালিকা- রাজু, নাদিম, সব ধরনের আইটেমে রয়েছে, স্বপন-২ এবং ক্যারিংম্যান হিসেবে : শামীম, সুরুজ। দীর্ঘদিনের অনুসন্ধান শেষে কিছুসংখ্যক মাদক কারবারির নাম পরিচয় জানা সম্ভব হয়েছে। তবে এর বাহিরেও রয়েছে আরো বহুজন।

 

স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, এলাকাটিকে মাদকের হটস্পট হিসেবে গন্য করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী র‌্যাব-১১ ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশের কার্যালয়ের অল্প কিছু অদুরে অবস্থিত এলাকাতে এ রমরমা ব্যবসা দিব্যি পরিচালনা করে আসছে এসব কারবারিরা। 

 

প্রতিবেদক ছদ্মবেশে কথা বললে আতঙ্কিত রূপে আশপাশের কয়েকজন মানুষ বলেন, বিহারি ক্যাম্পকে হিরোইন আর গাঁজার রাজ্য বলা চলে। দিবারাত্রি দূরদূরান্ত থেকে ক্রেতারা এসে তাদের চাহিদা মতো সংগ্রহ করে স্থান ত্যাগ করে। প্রতিবাদ তো দূরে থাক মুখ খুললেই ভয়ানক হামলার শিকার হতে হয়। 

 

একসময়কার ওই এলাকার মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত থাকা এক বিহারী ব্যক্তির সাথে কথা বলার চেষ্টা করে ঢাকা টাইমসের প্রতিবেদক, তবে তিনি নাম প্রকাশ না করা শর্ত দিয়ে কথা বলতে রাজি হন। জানিয়েছেন, পুরো বিহারি ক্যাম্পের টিন পট্টি এরিয়ায় মাদকের মজমা বেশি হয়। ২'শ ঘর আছেন সেখানে। এমনও পরিবার রয়েছে মা-বাবা, ছেলে-মেয়েও মিলেমিশে ব্যবসা করেন।

 

প্রশাসনের অভিযানের তৎপরতা সম্পর্ক জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিশের কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা অভিযানের চিন্তাভাবনা করলেও তাদের সোর্সদের বরাতে এলাকায় খবর চলে যেতো। দু'একজন ধরা খেলেও জামিনে এসে ফের আগের মতোই। এ পেশা ছাড়লেন কেনো? জবাবে বলে, তার পরিবারের কোনো কিছুর অভাব নেই। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে চলতে গিয়ে জড়িয়ে যান মাদকের মতো অপরাধ জগতে। তবে গতবছর পরিবারের কাছে কসম কেটে ছেড়ে দেয় এসব। তার যেকটা মামলা রয়েছে সেগুলোর সবগুলোতেই জামিনে আছেন বলেও জানান তিনি। 

 

সমাজসেবক ও সিনিয়র সাংবাদিকরা বলেছেন, প্রশাসনের সঠিক দৃষ্টিতেই মাদক নির্মূল সম্ভব। কিন্তু উল্লেখযোগ্য তেমন অভিযান চোখে পড়ে না তাদের। 

 

বিহারী ক্যাম্পের চেয়রাম্যানের দায়িত্বে থাকা মো: লিয়াকত হোসেনর সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, মাদকের কারবারিদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ খোদ নিজেই। ৩ নম্বর পুকুর পাড়ের দিকে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেশি। বিশেষ করে 'পি' সেক্টরে। তবে সিমুলপাড়ার পাশে তেমন নেই। ওইখানের বাসিন্দারা মাদকে ঝুঁকছে কেন?

 

এমন প্রশ্নে তিনি বলে, তার ধারণা অভাবের তাড়নায় এমন হয়। অন্যান্য কর্ম করলে ৫ থেকে ৬'শ টাকা পায়, আর মাদকে তার দিগুণ লাভবান হন। পুলিশের তাৎপরতা সম্পর্কে বলেন, পুলিশ মাঝে সাঝে এসে আটক করে নিয়ে যায়। কিন্তু ৪-৫ দিনের ব্যবধানে ফের চলে আসে তারা। তবে এ বছরে বড় ধরনের কোনো মাদকের অভিযান দেয়া হয়নি। চেয়ারম্যান নিজে বহুবার অনেককে মাদকসহ হাতে নাতে ধরে মারধরও করেছেন বলে জানিয়েছেন। 

 

নূরউদ্দিন নামের নারায়ণগঞ্জের এক সমাজকর্মী জানান, মাদক হচ্ছে সমাজ ধ্বংসের মূল অস্ত্র। মাদক তো যে কেউ বিক্রি করতে পারে না। মাদক বিক্রি করতে সাপোর্টের প্রয়োজন হয়। কারবারিরা বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দু'একটা ছবি তুলে সেগুলোকে ব্যানার, ফেস্টুনে পরিনত করেই মাদক ব্যবসা পরিচালনা করেন।

 

আমাদের নারায়ণগঞ্জ ৪ আসনের সাংসদ একে এম শামীম ওসমান সাহেবও মাদক নির্মূলের চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু তা হয়ে উঠছে না কয়েকজন সুবিধাবাদীদের জন্যে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সংখ্যক অসাধু কর্মকর্তারা যেনো দেখেও না দেখার মতো করে কাজ করে যাচ্ছে। তারা যদি সঠিকভাবে নির্মূল করতে চান তাহলে মাদকই থাকবে না।

 

নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সহ-সভাপতি ও সিনিয়র সাংবাদিক বিল্লাল হোসেন রবিন বলেন, বিহারী (অবাঙালী) ক্যাম্প অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ একটি এলাকা। ক্যাম্পের অধিবাসীদের মধ্যে বেশির ভাগই ভালো। তবে একটি চিহ্নিত গ্রুপ অপরাধের সাথে জড়িত রয়েছে বছরের পর বছর ধরে। এই গ্রুপটির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস করে না। গ্রুপটি ক্যাম্পের বিভিন্ন মহল্লা ও অলি-গলিতে দিন-রাত মাদক বিক্রি করে এবং করায়। তারা মাদক বিক্রি করে রাতারাতি প্রচুর টাকার মালিক বনে গেছে। 

 

এই গ্রুপটির সাথে যুক্ত হয়েছে কিছু বাঙালী মাদক ব্যবসায়ীও। রয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের কিছু সোর্স। তাছাড়া বিহারী ক্যাম্প মাদক কেনা বেচার নিরাপদ জোন হওয়ায় এবং প্রশাসনের উদাসীনতায় মাদক বিক্রেতার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাই এখনই ক্যাম্পের চিহ্নিত এই মাদক ব্যবসায়ীদের নির্মূল না করলে আশেপাশের এলাকাযর নিরাপত্তা ব্যবস্থা এক সময় হুমকির মুখে পড়বে। যদিও ক্যাম্পের দায়িত্বশীলদের অনেকেই চান তাদের ক্যাম্প মাদকমুক্ত হোক। কিন্ত কে রুখবে এই মাদক ব্যবসায়ীদের, এটাই প্রশ্ন।

 

নারায়ণগঞ্জ ডিবি পুলিশের ইনচার্জ (ওসি) আল মামুন বলেন, আমাদের মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। রিকোবারিসহ যেসব মাদক কারবারিকে আটক করি তাদের আদালতে সোপর্দ করা হয়। অন্যথায় কারো সঙ্গে কোনো আলামত না পেলে তাকে তো আটক করে আদালতে পাঠানো আমাদের আইনে নেই। তবে কোনো ব্যক্তি মাদকসহ গ্রেপ্তারের পর যদি জড়িত থাকা অন্য কারো নাম বলে তাহলে তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়।

 

নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক-সার্কেল) এস.এম জহিরুল ইসলাম জানান, মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। অতি শীঘ্রই ওই এলাকার মাদক কারবারিদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এস.এ/জেসি

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher
ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন