
আজ (রোববার) আর্ন্তজাতিক মা-দিবস। বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে লক্ষ কোটি মানুষের অনাবিল ভালবাসায় সিক্ত হয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে। মাকে নিয়ে অনেক বিখ্যাত গান, কবিতা ও কালজয়ী উপন্যাস যেমন রচিত হয়েছে তেমনি ভাবে নির্মিত হয়েছে বিক্ষ্যাত চলচিত্রও। অনেক রত্নাগর্ভা মায়ের বিক্ষ্যাত সন্তানরাও মাকে নিয়ে তাদের হাদয় নিংড়ানো ভাষায় মূল্যবাব মন্তব্য ও করেছেন।
মানুষের অভিধানে মায়ের চেয়ে সুমধুর আরেকটি শব্দ আছে কিনা আমার জানা নেই। ১৯১২ সালে আনা বিভয় জাভিসকে মাদারডে’-র প্রবর্তক হিসেবে মনে করা হয়। ১৯১৪ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডড্রো-উইলসন প্রথমে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মে’ মাসের দ্বিতীয় রোববারকে ন্যাশনাল মাদার’ডে ঘোষনা করেন। আজ আমার স্মৃতির অ্যালবাম-এ আমার করুনাময়ী মমতাময়ী মায়ের মুখচ্ছবিটি বার বার ভেসে উঠছে।
কবির ভাষায় “মধুর আমার মায়ের হাসি/মুক্তা হয়ে ঝরে/মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে। আমার মা লালবানু। গায়ের রং র্ফসা, হালকা পাতলা গড়ন সাহসী-তীক্ষ্র বুদ্ধিমতী, দূরদর্শী ও একজন স্পষ্ঠভাষী সংসার সচেতন নারী ছিলেন। মা আমাকে কয়েকবার তার জীবনের দুঃখ দহণের দোঁহা গুলো চোঁখের জলে ভাসিয়ে আমাকে শুনিয়ে ছিলেন।
আমার মায়েরা চারবোন-চার ভাই। বোনদের মধ্যে মা সবার ছোট। তার সবার বড় বোনটি অর্থাৎ আমার বড় খালা নলুয়া পাড়ার বিখ্যাত শহর আলী সরদারের স্ত্রী। আমার দাদা গোগন নগরের বিখ্যাত মোল্লা পরিবারের সদস্য। এলাকার একজন জোতদার ও মাতবর হিসেবে তার খ্যাতি ছিল। বুড়িগঙ্গা নদীর প্রায় মধ্যখানে তার বিরাট বাড়িছিল।
তার একমাত্র পুত্র সন্তান অর্থাৎ আমার বাবার জন্য শহরে একটি বনেদী পরিবারের মেয়েকে তার পুত্র বধু হিসেবে খোঁজা হচ্ছিল। ঘটনাক্রমে নলুয়া পাড়ার শহর আলী সরদারের ছোট শ্যালিকা অর্থাৎ আমার মাকে দেখে তার খুবই পছন্দ হয়। কিন্তু মায়ের অভিভাবক শহর আলী সরদার বিয়েতে একটি অদ্ভূত শর্তজুড়ে দিয়ে বললেন, আমার শ্যালিকা গ্রামে থাকতে পারবেনা সেখানে বিজলী বাতি নেই।
ভগ্নহাদয়ে দাদা ফিরে আসার উদ্যোগ নিলে শহর আলী সরদার দাদাকে ডেকে একান্তে বললেন। মাতবর সাব, ছেলেটাকে গর-জামাই হিসেবে এখানে রেখে দিন। দাদা অনেকটা বিস্থিত বয়ে বললেন, এটা কি বলছেন সরদার সাব! আমার বিরাট বাড়ি-খ্যাত-খামারে ১৫/২০ জন মুনি-কামলা কাজ করে অনেক মহিলাও বাড়িতে কাজ করে বৌ মাকে তো কোন কাজ করতে হবেনা।
উল্লেখ্য, সে সময়ে বনেদী পরিবারের সন্তানরা শ্বশুর বাড়িতে ঘর-জামাই থাকাটা অনেকটা অপমান জনক বলে মনে করতেন। বিয়ের পর বাবা নলুয়া পাড়ায় আমার নানী বাড়িতেই বসত গড়লেন।
এখানেই আমরা ভাই- বোন মিলে আট জনের জন্ম হয়। আমার পিতা পিয়ার আলী মোল্লা কিছুটা সংসার বিমুখ সুফীবাদে অক্রান্ত মানুষ ছিলেন। দাদার রেখে যাওয়া অনেক জমি জিরাত তিনি বিক্রি করে করে সংসার নির্বাহ করতেন। আমার দেয়া মতে বাড়ি থেকে মসজিদ এবং মসজিদ থেকে বাড়ি ছিল তার বিচরণ মাত্র। মন খারাপ হলে মসজিদে বসে উচ্চস্বরে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। ফলে মাকে এত গুলো সন্তান নিয়ে সংসার নামক বিরাট বোস্তাটি একাই সামাল দিতে হলো।
স্বাভাবিক ভাবে যে বয়সে একজন ছেলে বা মেয়ে চতুর্থ শ্রেনিতে পড়ে অথচ সে বয়সে আমার বর্ণ পরিচয় ঘটেনি। সারাদিনে আমি দশটা কথাও বলতামনা। মানুষের সাথে কথা বলা, বা মেশার চেয়ে কোলাহল যুক্ত উদার আকাশ, আর প্রকৃতির একাকিত্ব আমাকে যথেষ্ট সাচ্ছন্দ্য ও আনন্দময় করে রাখতো। আমাকে নিয়ে আমার পরিবার আত্নীয় স্বজন ও পাড়াপ্রতি বেশী তেমন কোন চিন্তা বা দুঃচিন্ত ছিলনা।
একমাত্র আমার স্নেহময়ী মা ছাড়া। আমি ছিলাম মাতৃভক্ত এক নির্বোধ বালক। আমাদের সমাজ সংসারে দুষ্ট ছেলে ও নির্বোধ ছেলেদের প্রতি মায়েদের যথেষ্ট খেয়াল রাখতে হতো। একই ভাবে তারা কিছুটা উদিগ্ন ও থাকতেন। দুষ্টু ছেলেটা কোথায় কখন কি করে বসে, আর নির্বোধ ছেলেটা কখন বাড়ি ফেরে সারাটা দিন কোথায় ছিল, কি খেয়েছে এমন হাজারটা চিন্তা আমার মাকে আতঙ্কিত ও চিন্তাগ্রস্ত করে রাখত। বলতে দ্বিধা নেই আমি ছিলাম দ্বিতীয়টি অথাৎ মায়ের নির্বোধ ছেলে।
আমার মামাতো খালাতো ভাই বোনদের মধ্যে যারা আমার সমবয়সী ছিল সকলি সন্ধ্যায় তারা যখন বিদ্র্যাজনের জন্য পড়তে বসত ঘটনাক্রমে আমি সেখানে উপস্থিত থাকলে খালা বা মামানিরা আমাকে অনেকটা তাচ্ছিলোর ভাষা সেখান থেকে চলে যেতে বলতেন। বলতেন তুমিতো লেখাপড়া কিছুই করনা যাও আমার ছেলে এখন পড়তে বসবে। মানুষের তাচ্ছিলোর ভাষাটা এখনও যেমন তখনও আমার র্স্পশব্দাতর মনটিকে বেদনাহত করত।
এদৃশ্য গুলো আমার মার অন্তরভেদী দৃষ্টি ও পর্যবেক্ষনের বাইরে ছিলনা। আমার মা তার বড় দু’ ছেলেকে আত্মীয়-স্বজনদের চরম অসহযোগীতা ও বিরাট প্রতিকূল পরিবেশে কিভাবে ব্যবসায়ী হিসেবে গড়ে তোলে ছিলেন যে দু”সহ কষ্ট ও বেদনা মহিত দিন গুলোর কথা তিনি আমাকে শুনিয়ে ছিলেন। কিন্তু মা কেন জানি আমাকে ব্যবসা-পাতি থেকে দূরে রেখে একান্ত লেখাপড়ার দিকে ঠেলে দিয়ে ছিলেন।
একদিন মা আমার বড় মেজো ভাই মহিউদিন (মাহি)কে বললেন, তুমি ওকে তোমার দোকানে পাশে বসিয়ে লেখা পড়া শিখাও। ভাই এতে খুব খুশি হলেন। দেখতে নায়ক মূলভ চেহারার আমার এই ভাইটিকে আমরা খুব ভয় পেতাম। একদিন শুভক্ষনে সকালে একটি আদর্শলিপি একটি ধারাপাত ও একটি ইংরেজী বর্ণ সালার বই নিয়ে তৎকালীন শীতলক্ষ্যা পুল সংলগ্ন তার দোকানে হাজির হলাম।
এক মাসের মধ্যে বাংলা, ইংরেজী ও ধাবাপাত পড়ে শেষ করলাম। পরে ভাই আমাকে বাল্যশিক্ষা নামক একটি বই পড়তে দিলেন। এভাবে আমি এক বছরের মধ্যে চতুর্থ শ্রেনীর পাঠ্য বই গুলো পড়ে শেষ করলাম। সে সময় পড়ার নেশায় এতটাই বিভোর হয়ে পড়েছিলাম যে, ঈদের দিনেও আমি বই নিয়ে দোকানে হাজির হলে ভাই বললেন। যাও, আজ ঈদ পড়তে হবে না। পরবর্তীতে ভাই বলতেন, ওকে একবার পড়া বলে দিলে দ্বিতীয় বার বলতে হতোনা।
একদিন মা পাশের বাড়ির লজিং মাষ্টার আঃ রউফকে আমাকে নিয়ে জয়গোবিন্দ হাই স্কুলে পঞ্চম শ্রেনীতে ভর্তি করে দেয়ার জন্য বললেন। এক শুভদিনে রউফ স্যারের সাথে স্কুলে হাজির হলাম। সে সময় সহকারী হেড মাষ্টার শাশাঙ্ক বাবু আমার বাংলা, ইংরেজী ও অংক পরীক্ষা নিলেন। ঠিক আছে- এখন প্রাইমারী স্কুলের সাটিফিকেট দিন।
রউফ স্যার বললেন ওতো প্রাইমারী স্কুলে পড়েনি বাড়িতে পড়েছে। চিন্তিত শংকর বাবু আমাকে নিয়ে যে সময়ের জাদরেল হেড মাষ্টার ডি.সি বর্ধনের রুমে ঢুকলেন। সবকিছু শুনে হেড মাষ্টার বললেন, প্রাইমারী স্কুলের সার্টিফিকেট না থাকায় ওকে পঞ্চম শ্রেনীতে নয় চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি করা যাবে। ওর অভিভাবকের অনুমতি নিয়ে আগামীকাল ভর্তি করব বলে রউফ স্যার আমাকে নিয়ে চলে এলেন।মার অনুমতি নিয়ে চতুর্থ শ্রেনীতেই আমি ভর্তি হলাম।
প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বলেছেন মায়ের হাসির চেয়ে সুন্দর কোন গোলাপ নেই, মায়ের দেখিয়ে দেয়া পথের চেয়ে মসৃণ কোন পথনেই। আমি সব কিছুর জন্য মায়ের কাছে ঋণী। তিনি আরো বলছেন, আমি যা কিছু পেয়েছি,
যা কিছু হয়েছি এবং যা হতে আশা করি তার জন্য আমি আমার মায়ের কাছে ঋণী। একই ভাবে আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন বলেছেন, আমার শিক্ষা বুদ্ধিসত্তা ব্যক্তিত্ব নৈতিকতা ও সফলতার জন্য আমি আমার মায়ের কাছে ঋণি।” বিখ্যাত আর্চবন্ড থমসন বলেছেন, মায়ের কোলের চেয়ে নরম কোন মখমলের কাপড় নেই।
১৯৬৭ সালে আমি মেট্রিক পরীক্ষায় অবর্তীন হলাম। আমার ঘনিষ্ঠ আত্নীয়দের মধ্যে আমার বড় খালার বড় নাতি নারায়ণগঞ্জের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ খোকা মহিউদ্দিনের ছোট ভাই ডিপটি, তার বড় বোনের ছেলে জিল্লুর ও আমার অপর খালাতো ভাই,
মামাতো ভাইসহ মোট আটজন পরীক্ষায় অংশগ্রহন করলাম। পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলে আমি ও আমার বড় লোক দুই আত্নীয় সহ চার জন উর্ত্তীণ হলাম। আমার সেই মামাতো ও খালাতো ভাইদের কেও পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হতে পারলো না। সারা মহল্লা ও পাড়া জুড়ে বিশেষ করে আমাকে নিয়ে বেশ কৌতুহল সৃষ্টি হল সারা দিন একা একা ঘুরে বেড়ানো এই নিবোধ ছেলেটা কখন লেখাপড়া করে পরীক্ষা দিয়েছে একমাত্র আমার মা ছাড়া কারোরই খোজ ছিলনা।
পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হওয়ার গর্বিত খবরটি মা আমার বড় খালা অর্থাৎ খোকা সহিউদ্দিনের নানিকে জানাতে ছুটে গোলো। বড় খালা তখন তার বড় নাতনি জিল্লুর মার বাড়িতে থাকতেন। খবরটি শুনে বড় খালা ও জিল্লুর মা খুব খুশি হলেন। তারা মাকে জিজ্ঞেস করলেন, ওকি কলেজে ভর্তি হবে?
হলে ওকে এখন থেকে জিল্লুরের নিজস্ব গাড়িতে কারে কলেজে যেতে বলো। খবরটি মা আমাকে জানালে আমি কিছুটা সন্ধিত হলাম। যে ছেলেটি বড় লোকের পাশে বসতে অম্বক্তি বোধ করে সে কেমন করে দিনের পর দিন তাদের গাড়িতে চড়ে কলেজে যাবে! বললাম, না মা আমি প্রয়োজনে পায়ে হেটে কলেজে যাব মা আর কিছুই বললেন না।
আমার মা একজন প্রতিবাদী নারী ছিলেন। বিশেষ করে তার ছেলে মেয়েদের সর্ম্পকে কেউ কিছু বললে তিনি পতিবাদে ফেঁটে পড়তেন। বড় খালা ছাড়া আমার অন্যান্য মামা ও খালারা তাকে ভাল চোঁখে দেখতেন না। আরেকটি বিষয় ছিল মাকে এবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে নিজেরা সেই জায়গা দখল করে নেয়া। মা আমার মেঝো বড় ভাইকে প্রায় বলতেন,
তোমরা আমাকে কোন স্বাধীন জায়গায় নিয়ে চলো সেখানে আমি সুস্থ থাকব- পেট ভরে খেতে পারব। ১৯৬৬ সালে শীতলক্ষ্যা কুমুদিনী মাঠের উত্তর-পূর্ব কোনে আমার ভাইয়েরা সাড়ে একুশ শতাংশের একটি ভরাট জমি বাবার নামে ক্রয করলেন। ১৯৬৭ সালের শুরুতে কোন এক সকালে মামাদের সাথে ঝগড়ার সুবাদে সেজো ভাই কয়েকজন মিস্ত্রি লাগিয়ে আমাদের চৌচালা ঘরটি ভেঙ্গে দিনে দিনে সবাইকে নিয়ে নতুন বাড়িতে চলে এলেন। এতে মায়ের মধ্যে মানসিক ভাবে কিছুটা স্বস্থি ফিরে এলেও শারীরিক ভাবে তেমন সুস্থ হলেননা।
মার একটি পুরনো অসুখ ছিল। কেউ বলতেন, পেট ব্যথা, কেউ বলতেন, কলিজা বেদনা, কয়েক মাস পর পর অসুখটি দেখা দিতো। সেসময় মা বুকে বালিশ চেপে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতেন। তার শরীর ক্রমশ-জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আমার মেঝো ভাই সে সময়ের শহরের নামী-দামী ডাক্তার দেখাতেন। এদের মধ্যে সেসময়ের নারায়ণগঞ্জের বিখ্যাত ডাক্তার আবদুস সামাদ খাঁন ও ছিলেন।
তাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হতো। শেষের দিকে তিনি এসেও ভিজিট নিতে চাইতেননা। বলতেন ভিজিট নিয়ে কি হবে অনেক দিন ধরে তাকে চিকিৎসা দিচ্ছি তাকে তো সুস্থ করতে পারলাম না। সে সময়ে দেথে আলট্রসনোগ্রাম মেসিনের অস্তিত্ব ছিলনা।
একদিন কলেজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি অসুস্থ মা ইশারায় আমাকে তার বিছানার কাছে ডেকে নিলেন। আমার গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, তুমি জীবনে ধনী হতে পারবে না। তবে আল্লাহ তোমাকে কখনও অর্থ কষ্টে রাখবেননা। আমি তোমাকে দোয়া করে গেলোম। সব সময আল্লাহর উপর ভরসা রাখবে। কখনও মানুষকে কষ্ট দিবেনা। মিথ্যা বলবেনা বুঝতে পারলাম মার অস্তিস সময় ঘনিয়ে আসছে।
সন্তান ভবিষ্যতে বড় মানুষ হোক বা না হোক, বোবা, অন্ধ বা বিকলঙ্গ, যাই হোকনা কেন মায়ের অকৃত্রিম স্নেহ ভাল বাসার আরশিতে সে সব সময সাত রাজার ধন মানিক রতন। এ জন্যেই ইসলামের মহান নবী (স:) বলেছেন। মায়ের পদতলেই সন্তানের জান্নাত। মার্কিন চিন্তানায়ক রবাট ওয়াকো ইমাসন বলেছেন মানুষের মা তাদের যা বানিয়েছে তারা সেটাই হয়েছে। দেশ কালভেদে পৃথিবীর সব সমাজ সব খানে মায়ের শাশ^ত রূপ প্রায় একই।
১৯৬৯ সাল। দেশ তখন উনসত্তরের গন আন্দোলনে উত্তাল। সরকার নারায়ণগঞ্জসহ সারা দেশে কার্ফু জারী করেছে। এরিমধ্যে আমার মায়ের অসুখটাও বেড়ে মারাক্তক আকার ধারন করে। একদিন মা ব্যথা বেদনায় অচেতন হয়ে পড়লেন। আমার কেন জানি মনে হল মাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।
আমি এ্যাম্বুলেন্স আনার জন্য বাড়ি থেকে উদ্মাদের মতো একাই কার্ফুর মধ্যে তৎকালীন ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের দিকে ছুটলাম। বেলা তখন ১১টা। জন মানব শূন্য রাস্তায় আমি যখন মাছুয়া বাজার এলাকায় উত্তর নলুরার মোড়ে পৌছলাম বন্ধু জহির আমাকে এ ভাবে ছুটতে দেখে আমার সামনে এসে বললো কার্ফুর মধ্যে কোথায় যাচ্ছিস? মা গুরুতর অসুস্থ এ্যামুলেন্স এর জন্য হাসপাতালে যাচ্ছি।
ও কি যেন ভেবে বললো আমি ও যাব চল বলেই আমার সাথে চলতে শুরু করলেন। আমরা যখন তৎকালিন নিতাইগঞ্জ পুল এলাকায় পৌছলাম দেখলাম সামনে মেশিন গান উদ্যত মিলিটারী বোঝাই একটি গাড়ি অনেকটা গা গেশে গাড়িটি চলে গেল। হাসপাতালে কোথায় এ্যাবুলেন্স কি ভাবে আনতে হয় আমি কিছুই জানিনা। তবে বন্ধু জহির সব জানে, তার সাথে আমার পরিচয় ঘনিষ্ঠতা এলাকার বিভিন্ন সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
সে লেখাপড়া তেমন না করলেও ওর একটি প্রাত্যহিক অভ্যাস ছিল প্রতিদিন হাসপাতালে ঘোরাঘুরি করা। কোন রোগীর অবস্থা খারাপ হলে ডাক্তারকে ডেকে আনা ঔষধ-পত্রের ব্যবস্থা করা, খাবারের ব্যবস্থা করা। ফলে হাসপাতালের ডাক্তার নার্স ও ষ্টাফদের সাথে ছিল তার একটি অন্যরকম ঘনিষ্ঠতা। আমরা হাসপাতালে চলে এলাম। জহির হাসপাতালে কত্তর্ব্যরত ডাক্তারের সাথে আলাপ করলে তিনি জানালেন,
এ্যাম্বুলেন্স আছে। কিন্তু কার্ফুর কারনে চালকতো আসেনি। সে বাবুরাইল এলাকায় থাকে। জহির তার কাছে থেকে ঠিকানা নিয়ে আমাকে বললো তুই এখানে থাক আমি আছি বলেই কার্ফুর মধ্যেই বেড়িয়ে গেল। প্রায় অর্ধঘন্টা পর সে ড্রাইবারকে নিয়ে হাজির হলো। এ্যাম্ব্যুলেন্স ছুটে চললো কুমুদিনী মাঠের দিকে। ভেতরে আমি আর জহির।
এ্যাম্বুলেন্সটি যখন কুমুদিবী মাঠের মধ্যখানে সেসময় আমার মামাতো ভাই সালাউদ্দিন এগিয়ে এসে আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে বললো। তোর মা বেঁচে নেই। তিনি আমাকে ধরে বাড়িতে নিয়ে এলেন। চারিদিকে মাতম চলছে। আত্নীয় স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের ভীড় ঠেলে আমার পড়ার টেবিলটিতে এসে বসলাম। বসে বসে ভারতের উর্দ্দু কবি হাসরাত মোহনীর কবিতার ভাষায় চলো।” চুঁপসে চুঁপসে আসু বাহানা” আমার জীবনে এক গভীর শূন্যতায় ঘেরা আঁধার নেমে এলো।
আছরের পর নামাজে জানাজা শেষে মাকে আন্তিম শয়ানে রাখার জন্য পাইক পাড়া বড় কবরস্থানে নিয়ে চললাম। সেখানে তাকে সমাহিত করে তার কবর গাহের পাশে দাড়িয়ে দু’হাত তুলে আল-কুরআনের ভাষায় উচ্চারণ করলাম আল্লাহুম্মা-রাবিবর হাম হুমা কামা-রাব্বাইয়ানী সাগিরা’
হে আমার রব, হে আমার স্রষ্টা তুমি আমার মার পতি আজ এমন ব্যবহার কর যেমনি শিশুকালে তিনি আমার সাথে করেছিলেন। কবরে তার শিয়রের কাছে একটি পলাশের চারা লাগিয়ে মনে মনে আল্লামা কবি ইকবালের কবিতার ভাষায় ওচ্চারণ করলাম।
আকাশ বর্ষণ করুক তোমার কবরে
রহমতের বারিধারা
আলোকময় সবুজ মাটি যেন
এই ঘরকে দেয় পাহারা।
পাদটীকা ঃ একজন মা তার সন্তানের জন্য পৃথিবীতে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে কোন দ্বিধা করেননা। মেডিকেল বিজ্ঞানের ভাষায় একজন মানুষ সর্বোচ্চ ৪৫ ইউনিট পর্যন্ত ব্যথা সহ্য করতে পারেন। কিন্তু একজন মা সন্তান প্রসব কালে ৫৭ ইউনিটের বেশি ব্যথা বেদনা সহ্য করে সন্তান প্রসব করেন। এ ব্যথাযন্ত্রনা এতটাই অসহনীয় যে,
ডাক্তারী বিদ্যায় দেহের ১০টি হাড় এক সাথে ভেঙে যাওয়ার চেয়েও বেশী ব্যথা ও যন্ত্রনাদায়ক। পৃথিবীতে এ যন্ত্রনা-ব্যথা ও কষ্ট একমাত্র মাই সহ্য করতে পারেন। এ জন্যেই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন কুপুত্র যদিবা হয়/ কুমাতা কখনও নয়’।
নোবেল বিজয়ী জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাম তার মৃত্যুর পূবেই এপিটাক লিখেগিয়েছিলেন তাতে আমার যখন মৃত্যু হবে আমার কবরের গায়ে যেন খোদিত থাকে এ ভাবে “এখানে শায়িত আছেন গুন্টার গ্রাম যে তার মাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতো”।
পুনশ্চ ঃ- অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী বাঙ্গালি অর্থনীতিবিদ অর্মত্য সেন বিদেশ থেকে টেলিফোনে এ ‘গর্বিত’ খবরটি তার মাকে জানালে উত্তরে মা তাকে প্রথমে জিজ্ঞেস করেছিলেন বাবা তুমি খেয়েছো? এ হচ্ছে শাশ^ত মায়ের প্রকৃত রূপ। সবশেষে গীতিকার খান আতার ভাষায়” মায়ের মতো আপন কেহ নাইরে/ মা জননী নাইরে যাহার/ ত্রিভূবণে তাহার কেহ নাইরে। লেখক : আইনজীবী / সাংবাদিক।