
শ্রীকৃষ্ণ পৃথিবীকে কলুষ মুক্ত করতে কংস, জরাসন্ধ ও শিশুপালসহ বিভিন্ন অত্যাচারিত রাজাদের ধ্বংস করেন এবং ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বাপরের যুগের সন্ধিক্ষণে রোহনী নক্ষত্রের অষ্টমী তিথিতে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটেছিল এই মাটির ধরাধামে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত লীলাকে কেন্দ্র করেই জন্মাষ্টমী উৎসব। ওই সময় অসুররূপী রাজশক্তির দাপটে পৃথিবী হয়ে ওঠে ম্রিয়মাণ, ধর্ম ও ধার্মিকেরা অসহায় সংকটাপন্ন অবস্থায় নিক্ষিপ্ত হন।
অসহায় বসুমতি পরিত্রাণের জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মার পরামর্শে দেবতারা সবাই মিলে যান দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করতে। সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের যুগসন্ধিক্ষণে তারা সকলে বিষ্ণুর বন্দনা করেন। স্বয়ং ব্রহ্মা মগ্ন হন কঠোর তপস্যায়।
ধরণীর দুঃখ-দুর্দশায় ব্যথিত হয়ে দেবতাদের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি দেবতাদের অভয়বাণী শোনান এই বলে যে, তিনি অচিরেই মানবরূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হবেন দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানরূপে শঙ্খ, চক্র, গদাপদ্মধারী শ্রীকৃষ্ণ নামে। ভগবান বিষ্ণু দেবতাদের নির্দেশ দিলেন এই ধরাধামে তার লীলার সহচর হওয়ার প্রয়োজনে এই ধরণীতে জন্ম নেয়ার জন্য। ভগবান বিষ্ণুর নির্দেশমতো দেবতারা তাদের স্ব স্ব পত্নীসহ ভগবানের কাক্সিক্ষত কর্মে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে যদুকুলে বিভিন্ন পরিবারে জন্ম নিতে থাকেন। এভাবে ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য দেবতাদের মর্তলোকে অবতরণ।
বসুদেব দেখলেন, শিশুটির চারহাতে শঙ্খ, চক্র, গদা এবং পদ্ম ধারণ করে আছেন। নানা রকম মহামূল্য মনি-রত্ন খচিত সমস্ত অলংকার তাঁর দেহে শোভা পাচ্ছে। তিনি বুঝতে পারলেন জগতের মঙ্গলার্থে পূর্ণব্রহ্ম নারায়ণই জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের ঘরে। বসুদেব করজোড়ে প্রণাম করে তাঁর বন্দনা শুরু করলেন। বসুদেবের বন্দনার পর দেবকী প্রার্থনা শুরু করলেন এবং প্রার্থনা শেষে একজন সাধারণ শিশুর রূপ ধারণ করতে বললেন শ্রীকৃষ্ণকে।
একজন সাধারণ শিশুর রূপ ধারণ করে শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “আমি জানি, আপনারা আমাকে নিয়ে অত্যন্ত শঙ্কিত এবং কংসের ভয়ে ভীত। তাই আমাকে এখান থেকে গোকুলে নিয়ে চলুন। সেখানে নন্দ এবং যশোদার ঘরে একটি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। আমাকে ওখানে রেখে তাকে এখানে নিয়ে আসুন।”
শ্রীকৃষ্ণের কথা শুনে বসুদেব সূতিকাগার থেকে শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। গোকুলে নন্দ এবং যশোদার সন্তানরূপে যিনি জন্মগ্রহণ করেছেন তিনি হলেন ভগবানের অন্তরঙ্গ শক্তি যোগমায়া। যোগমায়ার প্রভাবে কংসের প্রাসাদে প্রহরীরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। কারাগারের দরজা আপনা আপনি খুলে গেল। সে রাত ছিল ঘোর অন্ধকার। কিন্তু যখন বসুদেব তার শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে বাইরে এলেন তখন সবকিছু দিনের আলোর মত দেখতে পেলেন।
আর ঠিক সেই সময় গভীর বজ্রনিনাদের সঙ্গে সঙ্গে প্রবল বর্ষণ হতে শুরু হল। বসুদেব যখন শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে বৃষ্টির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন ভগবান শেষসর্পরূপ ধারণ করে বসুদেবের মাথার উপরে ফণা বিস্তার করলেন। বসুদেব যমুনা তীরে এসে দেখলেন যমুনার জল প্রচণ্ড গর্জন করতে করতে ছুটে চলেছে। কিন্তু এই ভয়ংকর রূপ সত্ত্বেও যমুনা বসুদেবকে যাবার পথ করে দিলেন।
এভাবে বসুদেব যমুনা পার হয়ে অপর পাড়ে গোকুলে নন্দ মহারাজের ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সেখানে তিনি দেখলেন সমস্ত গোপগোপীরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। সেই সুযোগে তিনি নিঃশব্দে যশোদার ঘরে প্রবেশ করে শ্রীকৃষ্ণকে সেখানে রেখে যশোদার সদ্যজাত শিশুকন্যাকে নিয়ে কংসের কারাগারে ফিরে এলেন। নিঃশব্দে দেবকীর কোলে শিশুকন্যাটিকে রাখলেন। তিনি নিজেকে নিজে শৃংখলিত করলেন যাতে কংস বুঝতে না পারে যে ইতিমধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে।
সনাতনী সমাজে শ্রীকৃষ্ণের শ্রেষ্ঠ অবদান শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলায় পুতনাবধ, দাম বন্ধন লীলা, কালীয়দমন, গোবর্ধন ধারণ প্রভৃতি কার্যের মধ্যে তাঁর অলৌকিক শক্তির পরিচয় মেলে। এ ছাড়া মুষ্টিক ও চানুর নামক দুই মল্ল যোদ্ধার নিধন, কংস বধ, অকাসুর বধ, শিশু পাল বধ প্রভৃতি ঘটনার মধ্য দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বরিক শক্তির প্রকাশ লক্ষ করা গেছে। তবে কুরুক্ষেত্রে সমরাঙ্গণে যুদ্ধবিমুখ হতোদ্যম অর্জুনকে তিনি যুদ্ধকর্মে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ভগবান বলে পরিচয় দিয়েছেন।
সনাতনী সম্প্রদায়ের অমূল্য সম্পদ মহাভারত, গীতা, ভাগ্বত ও বৈষ্ণবীয় পুরাণসমূহে শ্রীকৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত এবং ভক্তদের নিবিড় সাধনার পরম পুরুষোত্তম হিসেবে তিনি পূজিত।
লেখক: তারাপদ আচার্য্য, সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ। এন. হুসেইন রনী /জেসি