হার্লে-ডেভিডসনের আদলে বাইক বানালেন হীরা

সাবিত আল হাসান
প্রকাশ: ০৫ জানুয়ারি ২০২১, ০৭:১০ পিএম

বাংলাদেশের সড়কে হার্লে-ডেভিডসন! প্রথম দেখায় চমকে উঠবেন অনেকেই। একটু খেয়াল করে তাকালেই স্পষ্ট হবে পুরো বিষয়টি। আমেরিকান আইকনিক মোটরসাইকেল কোম্পানি হার্লে-ডেভিডসনের আদলে দেশেই তৈরী করা হয়েছে ইলেকট্রনিক বাইক। টানা ২ বছরের প্রচেষ্টায় সম্পূর্ন নিজ হাতে তৈরী করে রীতিমত তাক লাগিয়ে দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ এলাকার যুবক আফজাল হীরা।
হার্লে-ডেভিডসনের যাত্রা শুরু হয়েছিলো দুই বন্ধুর প্রচেষ্টায়। উইলিয়াম এস. হার্লে এবং আর্থার ডেভিডসন মিলে মোটরসাইকেল বানাবার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেখান থেকেই আজকের এই কোম্পানি। বিশ্বের লাখো যুবকের মত নারায়ণগঞ্জের হীরারও আকর্ষণ ছিল হার্লে-ডেভিডসনের উৎপাদিত মোটরসাইকেলের প্রতি। কিন্তু সেই পরিমাণ অর্থ এবং বাংলাদেশে কোম্পানিটির ব্যবসা পরিচালনার অনুমোদন না থাকায় নিজেই মোটরসাইকেল বানাবার সিদ্ধান্ত নেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত হার্লে-ডেভিডসন কোম্পানির আয়রন ৮৮৩ বিএস ৬ মডেলের আদলে বাইকটি বানানোর চেষ্টা করেন। পুরোপুরি অবয়ব না হলেও বাহ্যিক দর্শনে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য।
মোটরসাইকেলের নির্মাতা আফজাল হীরা (৩৪) জানান, আমি প্রথমে তেলে চালিত মোটরসাইকেল নির্মান করার পরিকল্পনা করি। পরে দেখলাম ইলেকট্রিক বাইক অনেক বেশী পরিবেশ বান্ধব ও জ্বালানি সাশ্রয়ী। এই চিন্তা করে আমি আমার গাড়িটি ইলেকট্রিকে রূপ দেয়া শুরু করি। বর্তমানে ৪টি ব্যাটারি স্থাপন করে আমি প্রায় ১১০ কিলোমিটার মাইলেজ পাচ্ছি। তাছাড়া বাইকটি ঘন্টায় ৬০ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে, যা দেশীয় প্রযুক্তি হিসেবে যথেষ্ট। আমি ব্যক্তিগত ভাবে প্রকৃতি প্রেমী হওয়ায় ইলেকট্রিক বাইকে আমার আগ্রহ জন্মায়।
বাইক নির্মানের চিন্তা কিভাবে এলো তা জানতে চাইলে হীরা বলেন, একদিন কম্পিউটারে মোটরসাইকেলের বেশ কিছু ছবি দেখতে দেখতে হার্লে-ডেভিডসনের একটি বাইক আমার চোখে পরে। খুব ইচ্ছা হলো এমন একটি বাইক কেনার। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তা সম্ভব নয়। তারপর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম নিজেই এমন একটি বাইক বানাবো। আমার ২টি ডিজাইন মাথায় ছিল। একটি হচ্ছে হার্লে-ডেভিডসন আয়রন ৮৮৩ বিএস ৬, অপরটি ঘোস্ট রাইডার সিনেমার মোটরসাইকেলটি। এরপর ইউটিউব থেকে টিউটোরিয়াল নিয়ে আমি মোটরসাইকেলটি তৈরীর কাজে হাত দেই। ধীরে ধীরে পার্টস বানানো, সার্কিট বোর্ড তৈরী, লোহার পাত কাটা, ওয়েল্ডিং করা, মোটর বসানো সহ সবকিছুই নিজের হাতে করি। গাড়ির সামনের লুকিংটা ঘোস্ট রাইডার সিনেমার মত আর পুরো ডিজাইনটা হার্লে-ডেভিডসনের আদলে আনার চেষ্টা করেছি।
তবে শুরুটা খুব সহজ ছিল না তার জন্য। প্রথমে কেউ কেউ উৎসাহ দিলেও বাইক তৈরীতে দীর্ঘ সময় লাগায় মাঝে অনেকেই এই পরিকল্পনা বাদ দিতে বলেন। তার বাবাও প্রথমদিকে বিষয়টি গুরুত্ব দেননি। অর্থের অপচয় ভেবে আশেপাশের লোকজন নিরুৎসাহিত করেছেন বেশ কয়েকবার। কিন্তু কোন কিছুতেই দমেননি হীরা। মাঝে একবার হতাশ হয়ে গেলেও তার এলাকার বন্ধু সজল ও হানিফ এসে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিলে পূর্নউদ্যোমে কাজে নেমে পরেন হীরা। আর ২ বছর পর ২০১৯ সালের জুন মাসে যখন বাইকটি এলাকায় নামে তখন প্রশংসার বানী পেয়েছেন প্রচুর।
মোটরসাইকেলটি বর্তমানে ৮ ঘন্টায় ফুল চার্জ হয়। একবার চার্জ পূর্ন হলে ১১০ কিলোমিটার চলতে সক্ষম। ২ জন আরোহী হলে মাইলেজ কিছুটা কমবে। ঘন্টায় ৬০ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারবে বাইকটি। প্রায় ২ বছর ধরে বানানো এই মোটরসাইকেল তৈরীতে আফজাল হীরার খরচ হয়েছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। ইতোমধ্যে বেশকিছু অর্ডারও এসেছে তার কাছে। বাইক তৈরীর পারিশ্রমিক সহ সেসব দেড়লাখ টাকা মূল্য নির্ধারন করলেও নতুন কোন বাইকের কাজে এখনও হাত দেননি।
ব্যক্তিজীবনে আফজাল হীরার ইলেকট্রিক বা অটোমোবাইল নিয়ে কোন কাজের অভিজ্ঞতাই ছিল না। মোটরসাইকেল তৈরীর পূর্বে নিজেদের বেকারী ব্যবসা পরিচালনাই ছিল প্রধান কাজ। শুধুমাত্র আগ্রহ আর অটুট মনোবল আফজালকে শূন্য থেকে সাফল্য এনে দিয়েছে। মাধ্যমিক সম্পন্ন করা এই যুবকের বর্তমান ইচ্ছা, তার নকশা ও উদ্ভাবনী দক্ষতা নিয়ে দেশীয় মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারক কোম্পানির সাথে যুক্ত হয়ে দেশে ইলেকট্রিক বাইকের বিপ্লব ঘটনো।
আফজাল হীরার গর্বিত বাবা আহমদ আলী ব্যাপারী (৭০) বলেন, আমি তো প্রথমে ছেলেকে বাইক কিনে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওর ইচ্ছা নিজেই বানাবে। আমাদের বেকারীর গোডাউনে বসে একা একাই বানাতে লাগলো। আমরাও আর্থিকভাবে সহায়তা করলাম। দেড়-দুই বছর কাজ শেষে যখন গাড়ি নামালো তখন পুরো এলাকায় আলোড়ন তৈরী হয়। আমি আমার ছেলের কাজে গর্বিত। আমার একটাই চাওয়া, আমার ছেলেকে যেন বড় বড় কোম্পানি তাদের কাছে নিয়ে এই গাড়ি বাজারজাত করতে পারে।
মোটরসাইকেল নিয়ে পরবর্তী লক্ষ্য কি তা জানতে চাইলে আফজাল হীরা বলেন, আমার ইচ্ছা আমি পরিবেশ বান্ধব মোটরসাইকেল তৈরী করবো। আমি চাই দেশীয় যেসকল কোম্পানি মোটরসাইকেল বাজারজাত করে তাদের সাথে কাজ করে দেশের মানুষকে কম টাকায় বাইক চড়ার সুযোগ করে দিতে। হার্লে-ডেভিডসনের যেসব মডেল আমাদের পছন্দ তা ক্রয়ের সাধ্য আমাদের নেই। আমরা ইলেকট্রিক বাইক তৈরী করে সেই স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। যদি তারা এগিয়ে আসে তাহলে অনেক কম টাকায় এই মোটরসাইকেল বাজারে নামতে পারবে।