
দরবেশকে হারিয়ে অসহায় হাতেম
গতবছরের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার পতনের পর ২৪ আগস্ট এক চিঠিতে আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর সেলিম ওসমানের এক চিঠিতে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনে (বিকেএমইএ) ঝুট ব্যবসায়ী হাতেমকে সভাপতি করার নির্দেশ দেন। এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর ঝুট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাতেম সারাদেশে ব্যাপক তোপের মুখে পড়েন। বিশেষ করে জুলাই আন্দোলন চলাকালীন সময়ে গণভবনে শেখ হাসিনা কাছে গিয়ে হাতেমের দেয়া বক্তব্য এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হাতেমের বিপক্ষ অবস্থান স্পষ্ট হয়। এরই মাঝে ফতুল্লার বিসিক এলাকায় ঝুট বন্টন, সেলিম ওসমানের প্রেসক্রিপশনে নানামুখী কার্যক্রম নিয়ে অক্টোবরে হাতেমকে স্বৈরাচারের দোসর আখ্যা দিয়ে পদত্যাগ করেন বিকেএমইএ’র দুই সদস্য। এই পুরো ঘটনা সামলানোর জন্য হাতেম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন সদ্য সাময়িক অব্যহতি প্রাপ্ত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্যসচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে। সালমান এফ রহমানকে আওয়ামী লীগের সময়কালীন দরবেশ বলা হতো।
৫ আগস্টের পর নানা মুখী বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে বর্তমান সময়ের দরবেশ বলে কঠাক্ষ করা হচ্ছে। হাতেমের সকল বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে সঙ্গ দেন এই তানভীর। সূত্র জানিয়েছে, তানভীরকে সচিবালয়ে নিয়ে যাওয়া, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া, হাতেমের পক্ষে সাফাই গাওয়া, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ব্যবসায়ীদের দেয়া অভিযোগের বিরুদ্ধে যাতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয় সেব্যাপারে অযাচিত হস্তক্ষেপ করা এমনকি হাতেমের বিষয়টি যাতে চেপে যাওয়া হয় সবকিছু নিয়ে দৌঁড়ঝাপ করেন এই গাজী সালাউদ্দিন তানভীর। যার বদৌলতে হাতেম এই সময় পর্যন্ত বিকেএমইএতে টিকে থাকেন। এবং সর্বোপরি আরেকটি লোক দেখানো নির্বাচনের মাধ্যমে বিকেএমইএর নেতৃত্বে থাকছেন বলে জানিয়েছে সূত্র। তবে জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্যসচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে দল থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। সোমবার (২১ এপ্রিল) দলটির যুগ্ম সদস্যসচিব (দপ্তর) সালেহ উদ্দিন সিফাতের সই করা এক চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়, ১১ই মার্চ জাতীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে আপনার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক নিয়োগে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এর পাঠ্যবই ছাপার কাগজে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠে এসেছে। এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় শৃঙ্খলা কমিটির প্রধানের নিকট আগামী সাত দিনের মধ্যে লিখিতভাবে যথাযথ ব্যাখ্যা প্রদান করতে এবং আপনাকে কেন দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে না জানতে চেয়ে কারণ দর্শানোর জন্য আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম ও সদস্যসচিব আখতার হোসেন নির্দেশ প্রদান করেছেন। এতে আরও বলা হয়, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা রক্ষার্থে প্রদত্ত পূর্ববর্তী মৌখিক সতর্কতা অমান্যের প্রেক্ষিতে শৃঙ্খলা কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত আপনাকে দলের সকল দায়িত্ব ও কার্যক্রম থেকে আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম ও সদস্যসচিব জনাব আখতার হোসেনের নির্দেশক্রমে অব্যাহতি প্রদান করা হলো।
সূত্র জানায়, এনসিপি গঠনের আগে থেকেই গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠে। এ নিয়ে দলের সর্বশেষ বৈঠকেও আলোচনা হয়। তানভীর সচিবালয়ে প্রবেশ করছেন এমন একটি ছবি নিয়ে সোমবারও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা হয়। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) থেকে অব্যাহতি পাওয়া গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার তদবির বাণিজ্যের অভিযোগ উঠে। জেলা প্রশাসক নিয়োগে প্রভাব বিস্তার এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে কেনাকাটায় কমিশন বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে তানভীরের বিরুদ্ধে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এনসিপি থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে তাকে। দল থেকে তার বিরুদ্ধে ঘটনা তদন্তের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। এদিকে সালাউদ্দিন তানভীরের অপকর্ম গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’তে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। এত স্পর্শকাতর অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পরও তানভীরকে এখনো কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না- এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। একইসঙ্গে তানভীরকে আইনের আওতায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুর্নীতিতে জড়িত ক্যাডার কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করার দাবি তুলেছেন নেটিজেনরা। ফলে আবারো বিকেএমইএ’র বর্তমান সভাপতির সাথে বর্তমানের দরবেশ হিসেবে খ্যাত গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিও তদন্তের দাবি উঠেছে। কোন কোন সুবিধা নিয়ে হাতেমকে রক্ষার মিশনের নামে তানভীর সেই বিষয়টি বের করার জোর দাবি উঠেছে। শনিবার (২৬ এপ্রিল) এনসিপির যুগ্ম-সদস্য সচিব ও শৃঙ্খলা কমিটির আহ্বায়ক এড.আব্দুল্লাহ আল-আমিন নারায়ণগঞ্জে একটি সমাবেশে যোগ দিয়ে বলেন, ‘৩৬ দিনের রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, দুই হাজার শহীদের রক্তের বিনিময়ে এবং বিশ হাজার আহত ভাইয়ের পঙ্গুত্বের বিনিময়ে আমরা নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। আমরা আশা করেছিলাম এই বাংলাদেশে ফ্যাসিস্টদের বিচার হবে। এই বাংলাদেশে আমরা একটি শান্তিপূর্ণ, সুন্দর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলব। কিন্তু আমরা অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি, জুলাই বিপ্লবের আট মাস পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্টদের বিচারে তেমন কোন দৃশ্যমান কার্যক্রম এখন পর্যন্ত আমরা দেখি নাই। আমরা দেখেছি এই নারায়ণগঞ্জেই নানাভাবে আওয়ামীলীগকে পুনর্বাসন করার চেষ্টা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের দোসরদের বিভিন্ন স্থানে বসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
এনসিপির এই নেতা আরো বলেন, ‘আমরা দেখেছি, এই নারায়ণগঞ্জে যারা ওসমান পরিবারের হয়ে বক্তব্য দিয়েছে, ব্যবসায়িক রাজনীতি করছেন, এই নারায়ণগঞ্জে যারা ব্যবসা বাণিজ্য করে ওসমান পরিবারের আশ্রয়ে ছিলেন এবং জুলাই আন্দোলনের সময় যারা ফ্যাসিস্টদেরকে প্রলোভন এবং উস্কানি দিয়েছেন ছাত্রজনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার জন্য, তারা এখন বিপ্লবের পরে অনেক বড় বিপ্লবী হয়ে গেছেন। বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে তারা আবার ওসমান পরিবারকে পুনর্বাসিত করছেন। আমরা এই ধরনের নারায়ণগঞ্জ দেখতে চাই না। যারা বিগত ১০বছর ওসমান পরিবারের স্পন্সর হয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়িক মহল, বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল, বিভিন্ন সাংবাদিকতার মহল, সুশীল সমাজের নামে বিভিন্ন মহলে অবস্থান নিয়েছিলেন তাদের ব্যাপারে অন্য অবস্থান দেখতে চাই। সেই সাথে ফ্যাসিস্টদের ব্যাপারে সরাসরি প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে ক্লিয়ার করার আহ্বান জানাই।’
এনসিপির নেতা গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে অব্যাহতি দেয়ার পর থেকে হাতেম ভারাক্রান্ত ও অসহায় অবস্থায় পড়েছেন বলে জানিয়েছে সূত্র। তার আশঙ্কা, যদি ৫ আগস্টের পর থেকে হাতেমের সাথে এই তানভীরের কী কী বিষয়ে সংশ্লিষ্টতা তা যদি তদন্তে আসে তাহলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।
এদিকে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) নির্বাচন সামনে রেখে এক অদ্ভুত দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে। এই নির্বাচনে ‘গণতন্ত্র’ রক্ষার নামে একটি সুপরিকল্পিত নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে বলে গুঞ্জন উঠেছে। আর সেই নাটকের প্রধান পরিচালক হিসেবে উঠে এসেছে সংগঠনের বর্তমান সভাপতি, ঝুট ব্যবসায়ী হাতেমের নাম। অভিযোগ উঠেছে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচনের কটূ তকমা এড়াতেই তিনি দাঁড় করিয়েছেন তিনজন কথিত ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী। সূত্র জানিয়েছে, এই তিন প্রার্থীর কেউই প্রকৃত বিরোধিতা করতে মাঠে নামেননি। বরং পেছন থেকে নকশা করা হয়েছে যেন নির্বাচন শুধু মাত্র নামমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার ছায়া নিয়ে সম্পন্ন হয়, যাতে সভাপতি পক্ষ বলতে পারে “দেখুন, প্রতিযোগিতা হয়েছে, ভোট হয়েছে, সবই নিয়ম অনুযায়ী।” কিন্তু ভিতরের খবর বলছে ভিন্ন কথা। স্বতন্ত্র বলে যাদের প্রচার করা হচ্ছে, তাদের মনোনয়নের আড়ালে আছে হাতেমের ছায়া-নির্দেশনা। মূল উদ্দেশ্য, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বদনাম এড়ানো কিন্তু নিজের পছন্দের লোকজনই যাতে জিতে যায়, সেই ব্যাকআপ নিশ্চিত রাখা। আর এই নাটকের মঞ্চস্থের মূল নায়ক হচ্ছেন স্বৈরাচারী সরকার শেখ হাসিনার অন্যতম দোসর, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম সেলিম ওসমান। এই সেলিম ওসমানের নির্দেশেই ঝুট ব্যবসায়ী হাতেম এখনো বিকেএমইএ-তে সভাপতির পদে বহাল আছেন। ব্যবসায়িক সংগঠন যেন ওসমান পরিবারের কুক্ষিগতই থাকে সেজন্য ঝুট ব্যবসায়ী হাতেমকে দিয়ে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য নাটক মঞ্চায়ন করে নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। কেননা, ৩৫টি পদের বিপরীতে তিনজন বাদে সবই হাতেমের প্যানেলের। আর এরমধ্যে সেলিম ওসমান পর্ষদে ছিল ২০ জন।
বিকেএমইএ সংগঠনের সভাপতি হিসেবে ২০১০ সাল থেকে বিনা নির্বাচনে দায়িত্বে ছিলেন সাবেক সাংসদ সেলিম ওসমান। তার সঙ্গে দীর্ঘ ১১ বছর ধরে সহসভাপতির দায়িত্ব পালন শেষে ২০২১ সাল থেকে নির্বাহী সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন ওসমান পরিবারের শীর্ষ সহযোগী হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ হাতেম। ৫ আগস্টের পর ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেলিম ওসমান আত্মগোপনে চলে যাওয়ার পর তাঁর নির্দেশে সংগঠনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন মোহাম্মদ হাতেম। এক্ষেত্রে খোদ সেলিম ওসমান ২০২৪ সালের ২৪ আগস্ট চিঠি দিয়ে ব্যবসায়ীদের চিঠি দিয়ে সভাপতি হিসেবে হাতেমকে গ্রহণ করতে নির্দেশনা দেন। এরপর হাতেমকে ফ্যাসিস্টদের দোসর উপাধি দিয়ে ওই পর্ষদ থেকে দুজন পদত্যাগ করেন এবং পরবর্তীতে দুইদিনের মাথায় তা প্রত্যাহার করে নেন। এছাড়া ডিসেম্বরে ব্যবসায়ীদের একাংশ হাতেমের বিরুদ্ধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ও উপদেষ্টা বরাবর অভিযোগ দেন। এছাড়া বিকেএমইএ’র ইজিএমএ হাতেমকে নিয়ে অসন্তোষ দেখা দেয়।