
নতুন আসন বিন্যাস বন্দরের অস্তিত্বে আঘাত
নারায়ণগঞ্জ শহরের উৎপত্তি, সমৃদ্ধি এবং বিশ্বের দরবারে খ্যতি প্রাপ্তিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে বন্দর উপজেলা। অথচ আজ নারায়ণগঞ্জ জেলার সেই ঐতিহাসিক বন্দর উপজেলাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। একটি সেতুর অভাবে যুগের পর যুগ ধরে আর্তনাদ করছে বন্দরের প্রায় ৬ লাখ বাসিন্দা। জনসাধারণের সহজ ও ভোগান্তিমুক্ত যাতায়াতের জন্য একটি পরিচ্ছন্ন ও জঞ্জালমুক্ত রাস্তার অভাবে ধুকে ধুকে জীবনযাপন করছে বন্দরবাসী।
এসব গুরুত্বপূর্ণ সুবিধাগুলো থেকে দূরে থাকার কারণে আধুনিক অনেক সেবা থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে তারা। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আধুনিক চিকিৎসা সেবা, দ্রুতগতির নেট সেবা এবং আধুনিক পরিবহন সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসের স্বর্ণযুগের অধ্যায়ে থাকা বন্দরবাসী। আর এসবের মূল কারণ হলো প্রভাবশালী শহরবাসীর অপরাজনীতির শিকার হওয়া এবং স্থানীয় কিছু অসাধু ব্যক্তির ক্ষমতা ও আর্থিক লিপ্সায় রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হওয়া। বলা যায় দীর্ঘদিন উপরের সারির স্থানীয় জনপ্রতিনিধিত্বের অভাবে এই বিষয়টি আরও কন্টকপূর্ণ হয়ে উঠে। এখন তাদের উপর মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে যোগ হচ্ছে নতুন করে আসন বিন্যাসের মাধ্যমে বন্দরকে দ্বিখন্ডিত করা। যার ফলে এই প্রথম ব্যাপকভাবে ফুঁসে উঠেছে বন্দরবাসী।
সমগ্র নারায়ণগঞ্জ জেলাকে যে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে বর্তমানে সেগুলো উপজেলা হিসেবে পরিচিত। এগুলো হলো নারায়ণগঞ্জ সদর, বন্দর, সোনারগাঁও, রূপগঞ্জ এবং আড়াইহাজার। বিভিন্ন ইতিহাস ঘেটে, বিশ্লেষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই ৫টি উপজেলার মধ্যে যে তিনটি উপজেলা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ঐতিহাসিক স্বীকৃতি পেয়েছে তা হলো নারায়ণগঞ্জ সদর, বন্দর এবং সোনারগাঁও। আর এই তিনটি উপজেলাই তিন দিকে নদী দ্বারা বেষ্টিত। এরমধ্যে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার পশ্চিমে বুড়িগঙ্গা, দক্ষিণে ধলেশ্বরী এবং পূব দিকে শীতলক্ষ্যা।
বন্দর উপজেলার পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা, দক্ষিণে ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যা এবং পূব দিকে ব্রহ্মপুত্র নদ। এবং সোনারগাঁও উপজেলার পশ্চিমে ব্রহ্মপুত্র, দক্ষিণে ধলেশ্বরী এবং পূর্ব দিকে মেঘনা নদী। আর এই সবগুলো উপজেলারই উত্তরদিকে স্থলভূমি। এরমধ্যে শত শত বছর ধরে বিশ্বের বাজারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যে ভূমিকা রাখাসহ বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের সহজ যোগাযোগেও ভূমিকা রেখেছে এই তিনটি উপজেলার এই নদী পথগুলো। আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য এবং মালামাল সরবরাহের জন্য নারায়ণগঞ্জের নদী বন্দরই ছিল ঢাকার প্রবেশ পথ। আর যে নদী বন্দরকে কেন্দ্র করে এতকিছু, তাকে কেন্দ্র করেই এই বন্দর নামের উৎপত্তি। যা নারায়ণগঞ্জের একটি পুরানো শহর ও ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
সংসদীয় নির্বাচনের আসন হিসেবে নারায়ণগঞ্জের ৫টি আসনের মধ্যে পুরো বন্দর উপজেলাই ছিল নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের অন্তর্ভূক্ত। যার সাথে সম্পৃক্ত ছিল শহরের কিছু এলাকা। যদিও দীর্ঘ একটা সময় এই আসনের প্রতিনিধি হিসেবে বন্দর উপজেলার সাংসদ নির্বাচিত হতে পারেনি, একই সাথে যদিও এখানকার মানুষের ভাগ্যের চাকা তুলনামূলকভাবে তেমন একটা উন্নতি ঘটেনি, কিন্তু ভোটের জোরে হলেও এখানকার মানুষের অন্তত কথা বলার মতো একটি শক্ত অবস্থান ছিল।
তবে এবারের নতুন আসন বিন্যাস যদি কার্যকর হয় তাহলে এখানকার মানুষের সেই অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়া হবে বলে বন্দরবাসীর দাবি। এত বছর বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন চাপের মুখে যদিও বন্দরের মানুষ কোন বিষয় নিয়ে একমত পোষণ করে আওয়াজ তুলতে পারেনি, কিন্তু বন্দরকে ভেঙ্গে দুটি আসনে বিভক্ত করার প্রস্তাবের বিষয় নিয়ে এরই মধ্যে ফুঁসে উঠেছে। এরই মধ্যে সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাসের অংশ হিসেবে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সীমানা পরিবর্তনের প্রস্তাবের আপত্তি জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট আবুল কলাম, জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের মনোনীত প্রার্থী মাওলানা মাঈনুদ্দিন আহমেদ এবং দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট সুলতান মাহমুদ মাখন। ঢাকা শেরে বাংলা নগরের নির্বাচন কমিশনের সচিবালয় গিয়ে এ বিষয়ে তারা তাদের বক্তব্য এবং যোক্তিকতা তুলে ধরেছেন।
বন্দর আসনকে দ্বিখন্ডিত না করার দাবি জানিয়ে তিনটি প্রস্তাব দেন বন্দরের বিভিন্ন পেশার মানুষ। প্রথমত, আগের অবস্থানে ফিরে যেতে হবে, অর্থাৎ পরিবর্তন করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, বন্দরকে আলাদা একটি আসনে পরিণত করা, তৃতীয়ত, প্রয়োজনে কাঁচপুর ইউনিয়নকে সংযুক্ত করে সতন্ত্র আসন হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, সাংবাদিক সংগঠন,
সমাজ কল্যাণ সংগঠনসহ স্থানীয় বিভিন্ন পেশার মানুষের উদ্যোগে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মানববন্ধন, বিক্ষোভমিছিল ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বন্দরবাসীর দাবির কথা ব্যক্ত করে উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন দপ্তরে এবং জেলা প্রশাসক ও জেলা নির্বাচন কমিশনের কাছে স্মারকলিপিও প্রদান করা হয়। বন্দরের বিভিন্ন স্তরের মানুষ আরও জানায় তাদের দাবি আদায় না হলে তারা সড়ক অবরোধসহ বড় ধরণের কর্মসূচি করতে বাধ্য হবেন বলে।
উল্লেখ্য, এর আগে পুরো বন্দরের সাথে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার আলীরটেক ও গোগনগর ইউনিয়নসহ শহরের কিছু অংশ মিলে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সীমানা ছিল। কিন্তু আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে গত ৩০ জুলাই নির্বাচন কমিশনের প্রকাশ করা সীমানা পুনরায় নির্ধারণের খসড়া তালিকায় তাতে বন্দরকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। সেই তালিকায় নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনকে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন হিসেবে দেখানো হয়েছে যেখানে বন্দরের ৯টি ওয়ার্ডও যুক্ত হয়েছে। অন্যদিকে বন্দরে যে পাঁচটি ইউনিয়ন পরিষদ আছে সেগুলোকে সোনারগাঁয়ের নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। যা বন্দরবাসীর অস্তিত্বকে কেটে দুই ভাগ করা হচ্ছে বলে বন্দরবাসীর দাবি।