মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রার্থীদের মুখোমুখি হতে হবে নতুন এলাকার ভোটারদের
সীমানা চূড়ান্ত নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
লিমন দেওয়ান
প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
সীমানা চূড়ান্ত নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
নারায়ণগঞ্জের তিনটি সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নিধারনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক মহলে মিশ্র প্রতক্রিয়া শুরু হয়েছে। বর্তমানে রাজনৈতিক কিছু নেতৃবৃন্দ স্বাগত জানাচ্ছেন আবার অনেকেই নির্বাচন কমিশনারের সিদ্ধান্তকে নিয়ে তুলছেন নানা প্রশ্ন যাকে ঘিরে নারায়ণগঞ্জ-৩ ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের বেশির নেতাকর্মীরাই অসন্তুষ্ট প্রকাশ করেছেন। আবার অনেকেই নির্বাচন কমিশনারের সিদ্ধান্তে একমত প্রকাশ ও করেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশনের প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে নারায়ণগগঞ্জ ৩, ৪ ও ৫ আসনে সীমানায় পরিবর্তন এসেছে। যা নিয়ে এই ৩টি আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতাকর্মীদের মধ্যে নানা মত প্রকাশ পাওয়া যাচ্ছে।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে যুক্ত হয়েছে সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের দশটি ওয়ার্ড। আগে কেবল সোনারগাঁ উপজেলা এ আসনে যুক্ত ছিল। এদিকে, সিটি কর্পোরেশনের দশটি ওয়ার্ড নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে চলে গেলেও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সদর উপজেলার গোগনগর ও আলীরটেক ইউনিয়ন। এ দু’টি ইউনিয়ন আগে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। অন্যদিকে, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের বাকি ১৭টি ওয়ার্ড এবং বন্দর উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদীয় এলাকা বলে বিবেচিত হবে। এর আগে বন্দরকে ভাগ করে দু’টি আসনÑ নারায়ণগঞ্জ-৩ ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাবের ঘোর বিরোধীতা করেছিলেন স্থানীয় রাজনীতিকরা। তারা নির্বাচন কমিশনে লিখিতও দিয়েছিলেন, অংশ নিয়েছিলেন ইসির ডাকা গণশুনানিতেও। আপত্তির মুখে নির্বাচন কমিশনও তাদের কারিগরি কমিটির সুপারিশ পুনর্বিবেচনা করে। নুতন সীমানা অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ১১ থেকে ২৭ নম্বর ওয়ার্ড এবং বন্দর উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এলাকা হিসেবে বিবেচিত হবে। ইসির কারিগরি কমিটির প্রস্তাবে উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নকে নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের সঙ্গে যুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু এমনটা করা হলে বন্দরবাসীর ভৌগলিক ও প্রশাসনিক জটিলতায় পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। ফলে বিরোধীতা করেছিলেন সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারাও।
তা ছাড়া গত ২৬ আগস্ট শুনানিতে পূর্বের সীমানা বহাল রাখার বিষয়ে নিজেদের যুক্তি ও ব্যাখ্যা তুলে ধরেন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আবুল কালাম, নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রেজাউল করিম, জামায়াত ইসলামীর মহানগর কমিটির সাবেক আমীর মাওলানা মাঈনুদ্দিন আহমাদ, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক মামুন মাহমুদ, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপির সভাপতি আজহারুল ইসলাম মান্নান, মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপু, বন্দর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মুকুল, মহানগর যুবদলের সাবেক সভাপতি ও কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ, মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক কাউন্সিলর আবুল কাউসার আশা, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির সভাপতি মাজেদুল ইসলাম, বিএনপির মহানগর আহবায়ক কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট শরীফুল ইসলাম শিপলু, জেলা যুবদলের সদস্য সচিব মশিউর রহমান রনি, সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালামের কন্যা অ্যাডভোকেট শামসুন নূর বাঁধন। কিন্তু শুনানি শেষে কবে নাগাদ সীমানা জটিলতার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হচ্ছে সে বিষয়ে কোন প্রকার মন্তব্য করেনি নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে তবে গত ২৮আগস্ট ঘোষিত আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপে ১৫ ই সেপ্টেম্বর সংসদীয় ৩০০ আসনের সীমানা চূড়ান্ত করে গেজেট প্রকাশ করার লক্ষ্য ঠিক করা হলে ও গতকাল বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর ) হঠাৎ চূড়ান্ত গেজেট প্রকাশিত হলে তা নিয়ে শুরু হয় হৈ-চৈ তা ছাড়া সময়ের বাহিরে কোন চাপে হঠাৎ নির্বাচন কমিশনার (ইসি) এই গেজেট প্রকাশ করলো তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। তা ছাড়া এই সীমানা চূড়ান্তে এই ৩টি আসন সেখানকার জনগণের প্রত্যাশার বাহিরে বলছে অনেকেই, আবার অন্যদিকে অনেক বিএনপি নেতাকর্মী ইসির সিদ্ধান্তে স্বাগত জানিয়েছেন। যার ফলে বিএনপির এই ৩ টি আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের নানান মন্তব্য তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সাংসদ সদস্য ও নারায়ণগঞ্জ ৩ ও ৪ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী আলহাজ¦ মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন যুগের চিন্তাকে বলেন, নির্বাচন কমিশনার সীমানা পূর্নবিন্যাস করে যেটার সাথে যেটা যুক্ত করুক না কেন আমি নারায়ণগঞ্জ-৪ ও নারায়ণগঞ্জ-৩ দুটি আসনেই বিএনপি থেকে মনোনয়ন চাইবো। দল এই দুটি আসনের যে আসনে দায়িত্ব দিবে সেখানেই দায়িত্ব পালন করতে আমি প্রস্তুত রয়েছি।
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী অধ্যাপক মামুন মাহমুদ যুগের চিন্তাকে বলেন, আজকে নির্বাচন কমিশনার যে সীমানা পূর্ণবিন্যাসের চূড়ান্ত গেজেট প্রকাশ করেছে সেটা কিন্তু এর আগে যে খসড়া প্রস্তাব করা হলো সেখানে এভাবে সাজানো ছিলো না। আর বর্তমানে যে সীমানা পূর্ণবিন্যাস হয়েছে সেখানে সিদ্ধিরগঞ্জবাসীর প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। সিদ্ধিরগঞ্জের মানুষ শীতলক্ষ্যা নদী পাড় হয়ে ওই পাড়ে যেতে আগ্রহী নয়। এখনো আমরা গেজেট হাতে পাইনি সেটা হাতে পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী এড. সাখাওয়াত হোসেন খান যুগের চিন্তাকে বলেন, সীমানা পুর্নবিন্যাসের যে গেজেট প্রকাশ হয়েছে। সেখানে বন্দর উপজেলাকে ৫ আসন থেকে আলাদা না করায় আমরা আনন্দিত। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের বিগত দিনের দুটি ইউনিয়ন গোগনগর ও আলীরটেক ইউনিয়ন আমরা নারায়ণগঞ্জ -৫ আসনের সাথেই চাই, এটা ৫ আসনে যুক্ত করলে ৫ আসনের জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে বলে আমি আশা রাখছি।
মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী এড. আবু আল ইউসুফ খান টিপু যুগের চিন্তাকে বলেন, আমরা আমাদের দলীয় হাইকমান্ডের সাথে যোগাযোগ করে আগামী পদক্ষেপ নিবো।
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী মাসুকুল রাজীব যুগের চিন্তাকে বলেন, নির্বাচন কমিশনারের এই সিদ্ধান্ত অনেকের হতাশার কারণ হয়ে দাড়িঁয়েছে। যারা গত ১৭ বছর আন্দোলন সংগ্রাম করে রাজনীতি করেছে তাদের চিন্তা-ভাবনা ছিলো এক রকম এখন হচ্ছে আরেক রকম। সব পুরোই উলট-পালট আমার মনে হয় না এটা কেউ ভালোভাবে নিবে। কারণ এই সীমানা পূর্নবিন্যাস কারো প্রত্যাশা মতো হয়নি।
ফতুল্লা থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী আলহাজ¦ শাহ আলম যুগের চিন্তাকে বলেন, নির্বাচন কমিশানের সিদ্ধান্তে আমি আগে ও একমত ছিলাম, এখনো একমত রয়েছি। তিনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটা সঠিক ও গ্রহণযোগ্য।
সোনারগাঁও উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী আজহারুল ইসলাম মান্নান যুগের চিন্তাকে বলেন, নির্বাচন কমিশনার সাধারণ ৪ লাখ ভোটের একটি আসন নির্ধারণ করেন। সেই ক্ষেত্রে আমাদের সোনারগাঁওয়ে ৩ লাখ ৭০ হাজার ভোটার ও যে থানা নতুন যোগ করেছে সিদ্ধিগঞ্জ সেখানে ভোট আড়াই লাখ। তাহলে ভোট হয় ৬ লাখ ২০ হাজার তাহলে নির্বাচন কমিশনারের সেই হিসাব অনুযায়ী কোন দিক দিয়েই মিললো না।
তিনি বলেন, আমরা এখনো গেজেট প্রকাশের বিষয়ে একমত নয়। কারণ গত ২৬ আগষ্ট শুনানীর দিন আমাদের একটা তারিখ ধার্য করে দেওয়া হলো আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর গেজেট ঘোষণা হবে। কিন্তু তারা আগেই তার প্রকাশ করে দিয়েছে। তা ছাড়া খড়সাতে ও এই সীমানা ছিলো না। আমাদের মনে হচ্ছে এটা কোন গুজব কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক কিছুই পাওয়া যায়। আমরা যে পর্যন্ত গেজেট হাতে না পাই সেই পর্যন্ত কিছুই বলতে পারছি না। গেজেট হাতে পেলে আমরা কি করবো সেই পদক্ষেপ নিবো।
জেলা যুবদলের সদস্য সচিব ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী মশিউর রহমান রনি যুগের চিন্তাকে বলেন, আমি নির্বাচনের শুনানীর দিন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন শুধুমাত্র ফতুল্লা থানা ও সদর থানার দুটি ইউনিয়ন এলাকা নিয়ে গঠন করার কথা বলেছিলাম। যেখানে থাকবে ফতুল্লা, এনায়েতনগর, বক্তাবলী, কাশীপুর, কুতুবপুর, গোগনগর ও আলীরটেক। সেদিন আমি আমার এলাকাবাসীর স্বার্থে ভালোভাবে শুনানী করার জন্য আইনজীবীও নিয়োগ করেছিলেন। নির্বাচন কমিশন আমার শুনানী গ্রহণ করে আমার শুনানীর পক্ষেই রায় দিয়েছেন।
বন্দরকে অবিভক্ত রাখার সিদ্ধান্তে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ মহানগরের সভাপতি মুফতি মাসুম বিল্লাহ। তবে সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ১০টি ওয়ার্ডকে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে বাদ দিয়ে নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে যুক্ত করার সিদ্ধান্তে ‘নাখোশ’ বলে জানান তিনি। মাসুম বিল্লাহ বলেন, “সিদ্ধিরগঞ্জকে ভেঙে তিন আসনের সঙ্গে যুক্ত করা ঠিক হয়নি। এখন আর সিদ্ধান্ত পাল্টানোর সুযোগ নেই। কিন্তু এতে ক্ষোভ প্রকাশ করছি।”
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর ও সাবেক যুবদল নেতা মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ ইসির প্রজ্ঞাপনের নারায়ণগঞ্জ অংশটি তুলে ধরে লিখেছেন, “বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনে শুনানি করে জয়ী হয়েছি। বন্দর উপজেলা নারায়ণগঞ্জ-৫ এ থাকলো।”
মহানগর বিএনপির সদস্য অ্যাডভোকেট শরীফুল ইসলাম শিপলু লিখেছেন, “নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে বন্দরকে অবিভক্ত রাখার আন্দোলনে যেসব রাজনৈতিক নেতাদের পাশে পাইনি তাদেরকেও ধন্যবাদ।”


