মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৩ ১৪৩১   ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫

শারদীয় পূজোর স্মৃতির পাতায় একাল সেকাল 

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০১:২৮ পিএম, ৭ অক্টোবর ২০১৯ সোমবার

শারদীয় পূজোর স্মৃতির পাতায় একাল সেকাল নিয়ে বলেছেন রণজিৎ মোদক। আর তা কালো অক্ষরে বন্দী করেছেন রাকিব চৌধুরী শিশির
বর্ষা শেষে ভাদ্রে ভর করে আসে শরৎ ঋতু। চারদিকে শুভ্র কাশফুলের সটান দাঁড়িয়ে থাকা, শিউলী ফুলের মৌ মৌ ঘ্রাণ নিয়ে শুরু হত পুজোর প্রস্তুতি।

 

সবেমাত্র পা দিয়েছি কৈশোরে। তাই বলে দায়িত্ব কম ছিল না আয়োজনে। দুই তিন মাইল হেটে প্রতীমা তৈরীর মাটি আনার মধ্যে দিয়ে শুরু। ফুল তোলা, মণ্ডপ সাজাতেও ব্যস্ত থাকতাম। রঙিন কাগজ কেটে নকশা (ঝালট), নিশান তৈরি কত কী কাজ। 


সব সারতাম মহা আনন্দে। মনে তখন একটাই ঢোল বাজতো ‘দুর্গা পূজা আসছে’- কথাগুলো একটানে বললেন সাংবাদিক ও শিক্ষক রণজিৎ মোদক। বললেন, সে সময়ে পূজা উৎসব ছিল এক রকম এখন আরেক রকম। যদি সম্ভব হত তবে স্মৃতি জড়ানো সুখময় সেই দিনে ফিরে যেতেও রাজি তিনি।


রণজিৎ মোদকের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী থানাধীন নারান্দিয়া গ্রামে। এখানে তাদের ও তার পিসীর বাড়িতে দুর্গা পূজা হত। তখন পুজোতে আজকের মত জ্বলমলে লাইটিং ছিল না, ছিল না বড় স্পীকারে বাজানো কড়া সাউন্ডের গান বাজনা। তাই বলে কমতি ছিল না আনন্দের। সারা বাড়ি আচ্ছাদন থাকত লাল, সবুজ, হলুদ, নীল রঙে। রাঙা কাগজ কেটে তৈরি হত ঝালট, নিশান। যা আঠা লাগিয়ে রশিতে আটকে দেয়া হত। রাতের অন্ধকার ভেদ করতে জোগাড় করা হত হ্যাজেক লাইট আর মোমবাতি লাগানো কাঁচের ঝাড়বাতি। পুজোয় ফুল তোলার দায়িত্বটা পুরোপুুরি ছিল কিশোরদের উপর। এর পরিবর্তে আমরা পেতাম বাড়তি প্রসাদ।

 

পূজোর আনন্দ বাড়িয়ে দিত নতুন জামা কাপড়। বাজার থেকে কাপড় কিনে রামলাল দর্জির দোকানে তৈরি করতে দেয়া হত পূজার ১৫/২০ দিন আগে। এরপর থেকে প্রতিদিন গিয়ে একবার খবর নিতাম দর্জির দোকানে। পোশাক হল? দর্জি আজ না কাল দিব বলে পূজো পর্যন্ত ঠেকিয়ে দিত। বড্ড রাগ হত দর্জির উপর, তাকে শায়েস্তা করতে কত কুটবুদ্ধি আঁটটাম। যখন নতুন জামা হাতে পেতাম তখন সব ভুলে যেতাম। সামান্য টাকায় তৈরি করা ওই জামা আপনাআপনি নিয়ে যেত আনন্দ ভূবনে। এতে মিশানো ছিল বাবা-মা’য়ের স্নেহ জড়ানো আর্শীবাদ। এখন ছোটরা অনেক টাকায় কেনা জামায় সেই আনন্দ পায় না।


আমাদের পাশের গ্রাম দৌলতপুর তালুকদার বাড়ি ছিল আমার বড় বোন যোগমায়া দিদির শশুর বাড়ি। পূজায় ওই বাড়িতে মহিষ বলি হত। আমরা পাঁচ ভাই দিদি-জামাই বাবুর কাছ থেকে উপঢৌকন হিসেবে পেতাম নতুন জামা কাপড়। একবার দিদির বাড়ি থেকে আমাদেরকে ধুতি আর পাঞ্জাবী দেয়। ছোট বয়সে ধুতি পরা কি কঠিন কর্ম তা হাড়ে হাড়ে টের পাই। ধুতির কাচা দিতে গিয়ে দেখি কোচা বড় হয়ে গেছে।


প্রতীমা দর্শন না করলে কী যেন মিস হয়ে যাবে এমন ধারণা থেকেই সবাই দল বেঁধে বিভিন্ন মণ্ডপে যেতাম। এ সময় কার পোশাক কেমন তা নিয়ে চলত আলোচনা। বিকেলে বেড়িয়ে রাত হয়ে গেলেও তখন কোন চিন্তার ভর করেনি বাবা মায়ের মুখে। এখন প্রতীমা দর্শনে যাওয়া মানে রীতিমত মল্লযুদ্ধে অংশ নেয়া। প্রশাসন সজাগ থাকার পরেও নিরাপত্তা নিয়ে মনে একটু সংশয় থেকেই যায়। 


আগে পুজো মানে মেলা হবেই। দৌলতপুর গ্রামে দশমী তিথিতে মেলা বসত। এই প্রতিনিধিকে রণজিৎ মোদক বলেন, তিন দিনের এই মেলার স্মৃতি হাতড়েই কেটে গেছে তিন কাল। এখনো চোখে ভাসে মেলায় বিক্রি করা মিঠাইয়ের জিলাপী, খই উখরা, বাতাসার স্বাদের কথা। নাগরদোলায় চড়ে মাটি থেকে আকাশপানে ছুটে যাওয়া আবার মাটিতে ফেরা। তখন ঢাকাকে দেখতাম বাইস্কোপে। মেলা থেকে কেনা ছোট ঢোল বাজাতাম আর বেলুন লাগানো বাঁশিতে ফুঁক দিয়ে জানান দিতাম আমরা বাড়ি আসছি।


এখন পুজো মণ্ডপের জায়গা কমতে কমতে এতই কমে গেছে যে মেলা আয়োজন স্বপ্নের বিষয়। বাড়ি বাড়ি নিমন্ত্রণ ছিল তখন খুব সহজ বিষয়। এখন এসব উঠে গেছে বললেই চলে। তবে গ্রামে হয়তো এখনো এর রেশ আছে। পূজোর বিভিন্ন কাজে সাথে ছিল অনেক সঙ্গী। যাদের মধ্যে বিপ্র দাস তালুকদার, রফিকুল ইসলাম রতন, কালাচাঁন বুল্কু, পদ হরি, চৈতন্য, অমলেশ, ফণিভূষণ, মিহির, দীলিপ, হারান, খরান, আজহারুল ইসলাম মজনু, সত্য, ব্রজ গোপাল, গুতু। এদের মধ্যে অনেকেই এখন এ ধরায় নেই।


১৯৭৮ সালে জীবন জীবিকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা রণজিৎ মোদক দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ কোন্ডার পারজোয়ার ব্রাহ্মনগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ে দীর্ঘ ৩৮ বছর সহকারী শিক্ষক পদে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি ফতুল্লা রিপোর্টার্স ক্লাবের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনসহ বহু সংগঠনকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতার সাথে জড়িত আছেন। বর্তমানে সকাল বার্তা প্রতিদিন’র সহকারী সম্পাদক। সেই সাথে ফতুল্লা রিপোর্টার্স ক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। 


ব্যক্তি জীবনে তিনি দুই কণ্যা, এক পুত্র সন্তানের জনক রণজিৎ মোদক স্ব স্ত্রীক থাকেন ফতুল্লায়। এই প্রতিনিধির সাথে আলাপকালে সংসার জীবনে সুখী এই মানুষটি জানান, জীবনের তেমন কোন চাওয়া পাওয়া নেই। শুধু মাঝে মধ্যে মনে হয় একবার যদি আবার কৈশোরে ফিরতে পারতাম। যদিও আবারও বাবা-মায়ের কাছে শত আব্দারের সেই বয়স পেতাম। বড় ভাই, দিদিদের আদর শাসনে মিশ্রিত সুখময় এক জীবন!