শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৫ ১৪৩০   ১৯ রমজান ১৪৪৫

লঞ্চডুবির ঘটনায় ৩৪ মরদেহ উদ্ধার

মাহফুজ সিহান

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০২:১৫ পিএম, ৬ এপ্রিল ২০২১ মঙ্গলবার

সকাল হলেই লকডাউন। হাতে টাকা-পয়সা নেই। স্ত্রী আর সাত মাসের সন্তানকে সাথে নিয়ে সম্বন্ধি ইসমাইলের কাছ থেকে টাকা ধার নিতে রোববার দুপুরে মুন্সিগঞ্জের ওগলাকান্দির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন ফল ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন (৫৫)। শনিআখরার গোবিন্দপুরের বাসায় বারো বছরের ছেলে মাহিন আর সাত বছরের মেয়ে মাহিয়াকে বলে গিয়েছিলেন টাকা নিয়ে তিন’ঘন্টার মধ্যেই ফিরে আসবেন। বাবার খোঁজে রোববার রাত ১২ টা থেকে শীতলক্ষ্যার পাড়ে অপেক্ষা করছে ছেলে মাহিন। বাবার দেখা পেয়েছেন সোমবার দুপুর ১টায়, পেয়েছেন মাকেও। তবে এখনো পাওয়া যাচ্ছেনা ছোটবোন মানসুরাকে। বাবা-মায়ের নিথর দেহ দেখে বাকরুদ্ধ মাহিন। শুধু মাহিন নয়, রোববার সন্ধ্যায় শীতলক্ষ্যায় লঞ্চডুবির খবর পেয়ে গোগনগর সৈয়দপুর এলাকার কয়লাঘাট, পাথরঘাট দুইপাড়ে নিহত ও নিখোঁজদের সন্ধানে স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠে সৈয়দপুর কয়লাঘাটের বাতাস।


এদিকে লঞ্চ দুর্ঘটনায় মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত আরো ৫টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এপর্যন্ত মোট ৩৪টি মরদেহ উদ্ধার হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের নারায়ণগঞ্জের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফিন। সোমবার দুপুরে দুর্ঘটনা কবলিত লঞ্চ থেকে ২১টিমরদেহ ও শাহ সিমেন্টের সামনের থেকে ১টি এবং রাতে ৩টি মরদেহসহ সোমবার মরদেহ উদ্ধার করা হয় ২৫টি। রোববার রাতে লঞ্চদুর্ঘটার পরপরই ৫টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়।  


রোববার রাত থেকে কাজ করা বিআইডব্লিউটিএ’র উদ্ধারকারী জাহাজ এমভি ‘প্রত্যয়’ সোমবার দুপুর সোয়া ১২টায় দুর্ঘটনায় নদীতে তলিয়ে যাওয়া লঞ্চটিকে দুপুর শোয়া ১২টার দিকে নদীর তলদেশ থেকে শীতলক্ষ্যার পশ্চিমপাড়ে তুলে আনলে লঞ্চটি থেকে একের পর এক মরদেহ উদ্ধার করে আনেন উদ্ধারকারীরা। একের পর এক লাশ উদ্ধারে স্বজনদের আহাজারীতে যেন বাতাস ভারী হয়ে উঠে।  সোমবার বিকেল পর্যন্ত ২১ জন যাত্রীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সন্ধ্যার পর আরো ৩ জনের মরদেহ উদ্ধার হওয়ার পর মোট মরদেহের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ জনে। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন কয়েকজন। ে গত রোববার (৪ এপ্রিল) সন্ধ্যা ৫ টা ৫৬ মিনিটে ‘সাবিত আল হাসান’ বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়ার মাত্র ১৫ মিনিটের মাথায় নির্মাণাধীন শীতলক্ষ্যা তৃতীয় সেতু (চায়না ব্রীজ) ৬টা ১০মিনিটে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে লঞ্চটি। এসকেএল-থ্রি (এম ০১২৬১৩) নামের একটি কোষ্টার জাহাজ পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে যাত্রীবাহী জাহাজটিকে ২০০ মিটার টেনে নিয়ে যায়। দুর্ঘটনার মাত্র ১০মিনিট পরে কালবৈশাখী ঝড়ের কারণে উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হয়। তবে বিআইডব্লিউটিএ, কোস্টগার্ড,  নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উদ্ধার তৎপরতা বেগবান করা হয়। টানা ১৯ ঘন্টার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সোমবার দুপুরে জাহাজটি উপরে তুলতে সক্ষম হন এবং মরদেহগুলো উদ্ধার করেন তারা। সোমবার দুপুরে লঞ্চটি পানির উপরে তুলে আনার পর নিহতের মরদেহ শীতলক্ষ্যার পশ্চিমপাড়ে সৈয়দপুর কয়লাঘাট থেকে মরদেহ গুলো সনাক্ত হওয়ার পর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর শুরু করে। 


রোববার থেকে টানা সোমবার পর্যন্ত প্রিয়জনের অপেক্ষায় থাকা স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছিলে বাতাস। কারো ভাই, কারো বোন, কারো বাবা, আবার কারো ছেলে মেয়ের গগনবিদারী আহাজারীতে যেন কালো হয়ে উঠছিল আকাশ। আহাজারিতে কেউ কেউ আওড়াচ্ছিলেন শেষবারের স্মৃতিগুলো।  
গতকাল সরেজমিনে নিহত ও নিখোঁজদের পরিবার ও স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তিন ছেলে মেয়ের জননী মহারানী (৩৯) নারায়ণগঞ্জের পাগলায় মেয়ের বাড়ীতে বেড়ানো শেষে বাড়ী ফিরে যাওয়ার পথে লঞ্চ দূর্ঘটনায় পতিত হলে তার ছেলে লালন (১৮) সাঁতরে পাড়ে উঠতে পারলেও মা সেখানেই মারা যান। মুন্সিগঞ্জের দক্ষিণ কেউঘাট এলাকার পারবর্তী রানী দাসের (৫৫) এর মরদেহ শনাক্ত করতে পারলেও স্বামী নারায়ণ চন্দ্র দাসের লাশ এখনো উদ্বার করা সম্ভব হয়নি। রিকীবাজারের কাঠ ব্যবসায়ী শাহে আলম মৃধা (৫৫) এসেছিলেন নারায়ণগঞ্জে। ভয়ে তিনি কখনো লঞ্চে চড়েননা। জীবনের প্রথম লঞ্চে চড়ার অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য তিনি কোন সুযোগ পেলেননা। 

 

সালমা আক্তার বেবী মুন্সিগঞ্জ শাখার সিটি ব্যাংকে চাকরী করতেন।  ক্যান্সার এর চিকিৎসা করতে প্রতি বুধবারের ন্যায় থেরাপী নিতে ঢাকা আসেন। থেরাপি শেষে বন্দরে তার মেয়ের বাড়িতে বেড়ানো শেষে বাড়ী ফেরার জন্য মেয়ে ও মেয়ের জামাই তাদের লঞ্চে উঠিয়ে দেয়। পরে সন্ধ্যায় লঞ্চটি দুর্ঘটনায় পতিত হলে সোলেয়মান ব্যাপারী তার মেয়ের জামাইকে ফোনে বলেন, জামাই লঞ্চতো ডুইব্বা যাইতাছে, আমিতো উঠতে পারতাছিনা।’  মুন্সিগঞ্জের মালপাড়ার রিজভী (২১)। বড় বোনের বাসায় বেড়ানো শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। বাড়ি অবধি পৌঁছতে পারেননি।তাকে নিয়ে যেতে পারবে কিনা তাঁর স্বজনরা জানেননা। এখনো তার লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি যানা যায়।

হাফিজুর রহমান তাঁর স্ত্রী তাহমিনা ও ১১ মাস বয়সী ছেলে আব্দুল্লাহ আল আয়ানকে ডাক্তার দেখানোর জন্য নারায়ণগঞ্জে এসেছিলেন। দুর্ঘটনায় হাফিজুর রহমানের মরদেহ উদ্ধার করা গেলেও এখনো মরদেহ পাওয়া যায়নি তার স্ত্রী তাহমিনা ও তার সন্তানের মরদেহ।  দাদা সাইফুল ইসলাম দেড় বছর বয়সী নাতি ওমর ফারুক আজমেরীকে সাথে নিয়ে তাঁর নানাবাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু যাওয়ার পথেই এই দুর্ঘটনা।দাদা বেঁচে গেছেন, নাতির লাশও খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু নির্বাক নানা সাইফুল ইসলাম। লতা(২৫) ও সাদিয়া (৮) দুই বোন। মুন্সিগঞ্জের জিয়াউদ্দিন কলেজের সামনের বাড়ি থেকে চোখের সমস্যার জন্য ঢাকা চক্ষু হাসপাতালে গিয়েছিলেন ডাক্তার দেখানোর জন্য। পরে ঢাকা থেকে লঞ্চ না পাওয়ায় নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জের উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য তারা লঞ্চে উঠেছিলেন তারা। লতার লাশ স্বজনরা খুঁজে পেলেও পাচ্ছেননা সাদিয়াকে।


এদিকে লঞ্চডুবির পরে বেঁচে যাওয়া কয়েক যাত্রীর দাবি করেন  জাহাজে ৭০ জন যাত্রী ছিল তবে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক বিকেল ৩টায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে জানান, ‘উদ্ধার করা লঞ্চটিতে ৪৬ জন যাত্রী ছিলেন। এই পর্যন্ত ২৭ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এরপরে কেউ নিখোঁজ থাকতে পারে। তাই র‌্যাব এর একটি দল  হেলিকপ্টার নিয়ে প্রহরা দিয়ে খোঁজ করবে। নিহতের পরিবারকে লাশ দাফন করার জন্য ২৫ হাজার টাকাসহ যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে।’


 সোমবার দুপুরে লঞ্চটি উদ্ধারের পর দুপুর দেড়টায় উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করেন বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক। তিনি জানান, ‘উদ্ধারকৃত মরদেহ গুলো জেলা প্রশাসনের স্বজনদের কাছে হস্তান্তরের ব্যবস্থা করবে। আমাদের রেকর্ড অনুসারে দুর্ঘটনার কবলে পড়া লঞ্চটিতে সাবিত আল হাসানে ৪৫জন যাত্রী ছিল। উদ্ধারে প্রধান লক্ষ্য ছিল যাত্রীদের জীবিত উদ্ধার করা। কিছু যাত্রী সাঁতরে পাড়ে হয়ে গিয়েছিলেন। উদ্ধারের সময় গতকাল সন্ধ্যা ৭টা লঞ্চটিকে সনাক্ত করতে পেরেছি। আবহাওয়া খারাপ থাকায় উদ্ধার কাজ ব্যাহত হয়েছিলো। লঞ্চটি শনাক্তের পর ডুবুরিরা চেষ্টা করেন সেখানে কোন মৃতদেহ আটকা ছিল কিনা। লঞ্চটি খুব সরু হওয়ায় একাজে ডুবুুরীদের বেগ পেতে হয়েছে। দুর্ঘটনাস্থলে একটি স্ট্রাকচার থাকায় কাজ করা কঠিন ছিল। এছাড়া সেখানে পানি বেশ নোংরা ও ¯্রােত বেশি থাকায় ভোর চারটা পর্যন্ত মৃতদেহ উদ্ধার কাজ চালিয়ে এরপর সেটি বন্ধ রেখে আমরা লঞ্চটি উদ্ধারের দিকে মনোযোগ দেই। উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয়, দুরন্ত, বালু জাহাজসহ কোস্ট গার্ডের বোট ও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরীদল নিয়ে কাজ শুরু করি। প্রথমে দুর্ঘটনাস্থল থেকে জাহাজটিকে সিলিংআপ করে বের করে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়। সকালে বাইরে নিয়ে আসি,পরে এটিকে উত্তোলণ করার চেষ্টা করি। সরু চ্যানেল হওয়ায় এই কাজটিও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সাড়ে ১১টার পর এটি উত্তোলণ করি। লঞ্চটি থেকে ২১টি মৃতদেহ আমরা বের করি। নৌপুলিশের কাছে এটি লঞ্চটি হস্তান্তর করা হয়েছে। বিপজ্জনকজায়গায় দুর্ঘটনাটি ঘটেছে, তাই ১৮ ঘন্টা সময় বেশি বলা যাবেনা। আরেকটি দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে সেটিও আমাদের মাথায় ছিল।’ 


তিনি বলেন, দুর্ঘটনা ঘটানোর জন্য দায়ী এসকেএল-থ্রি (এম ০১২৬১৩) কোস্টার জাহাজটি আটকের জন্য খোঁজ নেয়া হচ্ছে। খুব শীঘ্রই আশা করছি জাহাজটিকে ধরতে পারবো। উদ্ধার অভিযানে ব্যস্ত থাকায় ওই জাহাজটিকে ধরা যায়নি। যাদের অসতর্কতার দরুণ এই দুর্ঘটনা ঘটেছে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।


ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ ছালেহ জানিয়েছেন, নিখোঁজ থাকার দাবীর নিখোঁজ ফায়ার সার্ভিসের দুইটি ডুবুরি দল নদীতে সন্ধ্যা পযর্ন্ত এবং প্রয়োজন হলে আরো বেশী সময় নিখোঁজদের সন্ধানে নদীতে টহলে থাকবে।