শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৪ ১৪৩০   ১৯ রমজান ১৪৪৫

চাঞ্চল্যকর জঙ্গি মামলা ছয় জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট

মো. মোমিনুল ইসলাম ও তুষার আহমেদ

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৩:৫০ পিএম, ৭ এপ্রিল ২০২১ বুধবার

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় জঙ্গি আস্তানা আবিস্কার ও বিপুল পরিমান বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেছে পুলিশ। দীর্ঘ ১৮ মাসের তদন্ত শেষে গত ২২ মার্চ নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চাঞ্চল্যকর ওই মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করা হয়।  

 

গতকাল আলোচিত ওই মামলার দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তা ফতুল্লা মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) হুমায়ুন কবীর ও আদালত সূত্র দৈনিক যুগের চিন্তাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। 

 

এর আগে ২০১৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সদস্য মোখলেছুর রহমান বাদি হয়ে নব্য জেএমবির ছয় সদস্যের বিরুদ্ধে ফতুল্লা মডেল থানায় সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলাটি দায়ের করেন।
 
 

মামলার আসামীরা হলো নিষিদ্ধ ঘোষিত নব্য জেএমবির সক্রিয় সদস্য খুলনার তেরখাদা থানার পাতলে ডাঙ্গা গ্রামের স্থায়ী ও নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন রসুলবাগ এলাকার অস্থায়ী বাসিন্দা খাঁন হমায়ুন কবিরের ছেলে মিশুক খান ওরফে মাহের মিশাল ওরফে আবু উবায়দা ওরফে মোহাম্মদ আলী (১৯), নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানাধীন পশ্চিম শিহাচর তক্কার মাঠ এলাকার বাসিন্দা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা জয়নাল উদ্দিনের দুই ছেলে ফরিদ উদ্দিন রুমি (২৭) ও জামাল উদ্দিন রফিক (৩০), ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থানাধীন ঈশ্বর গ্রামের মুজিবর রহমানের ছেলে মেহেদী হাসান তামিম (২৪), ভোলার কালীবাড়ী এলাকার বাসিন্দা আফতাব উদ্দিন আহম্মেদের ছেলে আব্দুল্লাহ আজমীর (২৪) এবং ভোলার হোন্দরখালী গ্রামের জাহাঙ্গীর বেপারীর ছেলে আনোয়ার হোসেন (২৫)।

 

এদের মধ্যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. জয়নাল উদ্দিনের বড় ছেলে আসামী ফরিদ উদ্দিন রুমি বুয়েটে মাস্টার্স সম্পন্ন করে ঢাকার আহসান উল্লাহ ইউনিভার্সিটির লেকচারাল ছিলেন। আর ছোট ছেলে জামাল উদ্দিন রফিক খুলনার কুয়েটে অনার্স সম্পন্ন করেছেন। তাছাড়া ৫নং আসামী আব্দুল্লাহ আজমীর সোনারগাঁয়ে অবস্থিত মেঘনা সুপার রিফাইনারী লিঃ এর সহকারী ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়।

 

চার্জশিট থেকে প্রাপ্ত তথ্য সূত্রে জানা যায়, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আসামী মিশুক খান ও ফরিদ উদ্দিন রুমিকে ঘটনার দিনই গ্রেফতার করা হয়। অতঃপর পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন তারিখে অন্যান্য আসামীদেরকেও গ্রেফতার করা হয়েছিলো। 

 

এই ছয় আসামীর মধ্যে মেহেদী হাসান তামিম ও আব্দুল্লাহ আজমীর বর্তমানে পলাতক রয়েছে বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে। বাকি চার আসামীকে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলো পুলিশ। এছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা জয়নাল উদ্দিনের দুই ছেলে ফরিদ উদ্দিন রুমি ও জামাল উদ্দিন রফিক কয়েকমাস পূর্বে হাইকোর্ট থেকে জামিনে মুক্তি পেলেও প্রধান আসামী মিশুক খান ওরফে মোহাম্মদ আলী এবং আনোয়ার হোসন বর্তমানে হাজতবন্দি রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ঢাকায় সন্ত্রাস বিরোধী আইনে বিভিন্ন ধারায় আরো একাধিক মামলা রয়েছে।    

 

জানা গেছে, শুরুতে গুরুত্বপূর্ন এই মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ফতুল্লা মডেল থানার সাবেক উপ-পরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমান। তিনি অন্যত্র বদলী হলে মামলার তদন্তভার গ্রহণ করেন হুমায়ুন কবির। তবে, তদন্তের সিংহভাগ কাজ সম্পন্ন করেছিলেন প্রথম তদন্তকর্মকর্তা মিজানুর রহমানই। 

 

বদলী হওয়ায় মিজানুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব না হলেও চার্জশিট প্রদানকারী দ্বিতীয় তদন্তকর্মকর্তা এসআই হুমায়ুন কবীর দৈনিক যুগের চিন্তাকে জানান, ‘মামলার সকল আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তারা ইতিপূর্বেও জঙ্গীবাদের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে ঢাকায় সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলাও রয়েছে। মামলা নম্বর- ৫৩, তারিখ ২৯(৪)১৯।’  

 

গতকাল কোর্ট পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক সাহিল দৈনিক যুগের চিন্তাকে জানান, ‘গত ২২ মার্চ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। আগামী ২৮ এপ্রিল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এই মামলাটি উত্থাপন করা হবে। সম্ভবত ওই তারিখে মামলাটি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বদলী করা হবে।’ 

 

চাঞ্চল্যকর এই মামলার চার্জশিট প্রদানের বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম দৈনিক যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘পুলিশ বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিটি বিভাগ এ ধরনের জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ দমনে সর্বদা সচেষ্ট। আমরা জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ দমনে জিরো ট্রলারেন্স নীতি অবলম্বন করছি।’ 
 
 

জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার সেহাচর তক্কার মাঠ এলাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা জয়নাল উদ্দিনের ‘পরিত্যাক্ত’ বাড়িতে আবিস্কৃত হয় জঙ্গি আস্তানা। রুদ্ধশ্বাস অভিযানে ব্যবহার করা হয় রিমোর্ট কন্ট্রোল রবোট। অতঃপর ওই জঙ্গি বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া সক্রিয় বোমাগুলো বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিস্ক্রিয় করা হয়। এতে ফতুল্লার বিস্তীর্ণ এলাকা কেঁপে ওঠে এবং একটি বাড়িতে আগুন ধরে যায়। 

 

এদিকে, চাঞ্চল্যকর এই ঘটনা প্রসঙ্গে ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর একটি ফলোয়াপ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় দৈনিক যুগের চিন্তা পত্রিকায়। ওই প্রতিবেদনে দৈনিক যুগের চিন্তার সাথে কথা বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. জয়নাল উদ্দিন। তিনি জানিয়েছিলেন, তার ছেলে (মামলার দুই আসামী) ফরিদ উদ্দিন রুমি (২৭) ও জামাল উদ্দিন রফিক (২৫) ছিলেন মেধাবী। এসএসসি-এইচএসসি’তে দুজনই অর্জন করেছেন জিপিএ-৫। পুথিগত শিক্ষায় কমতি ছিলো না কারোর। সততা নামক সম্বল বুকে লালন করে সন্তানদের নিয়ে আকাশচুম্বি স্বপ্ন থাকলেও বেধাবী দুই ছেলের ললাটে পড়ে জঙ্গিবাদের ত্বকমা। 

 

জয়নাল উদ্দিন বলেন, ‘হঠাৎ কিভাবে কি হয়ে গেলো তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। তাদের মধ্যে আচরণ বা পরিবর্তন দেখিনি। আমার ছেলেরা কিভাবে জঙ্গি হতে পারে!’

 

সরেজমিনে দেখা যায়, ‘তক্কার মাঠ এলাকার ওই বাড়িটি জঙ্গিবাড়ি নামে পরিচিতি পেয়েছে স্থানীয়দের কাছে। তবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পূর্বে এই বাড়িতে জঙ্গিকার্যক্রম চলতো বলে তা ঘুনাক্ষরেও আঁচ করতে পারেনি প্রতিবেশিরা।