বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৪ ১৪৩০   ১৮ রমজান ১৪৪৫

মামুনুলের রিসোর্ট কাহিনি : উত্তরবিহীন কিছু প্রশ্ন

যুগের চিন্তা অনলাইন

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৭:১৫ পিএম, ১১ এপ্রিল ২০২১ রোববার

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য থেকে শুরু করে সরকারকে হুমকি দেওয়া, নিজের প্রতিটি কর্মকান্ডের জন্য শিরোনাম হয়েই চলেছেন হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হক। তবে উগ্র ইসলামপন্থী গোষ্ঠীটির এই যুগ্ম মহাসচিব এবার আলোচনার কেন্দ্রে কোনো বক্তব্য নয়, বরং ব্যক্তিগত বিষয়ের জন্যই আলোচনায় এসেছেন।

 

গত ৩ এপ্রিল বিকেলে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার একটি রিসোর্টের ৫০১ নম্বর কক্ষে এক নারীসহ ধরা পড়েন মামুনুল। পরবর্তীতে ওই নারীকে নিজের দ্বিতীয় স্ত্রী বলে দাবি করেন তিনি। সোনারগাঁও ইউএনও এবং পুলিশ কর্মকর্তারা এ কথা শুনে রিসোর্টে যান। এ বিষয়ে পুলিশ জানিয়েছিল, তারা মামুনুলকে আটক বা  গ্রেফতার করছে না। কী ঘটেছে তা জানার চেষ্টা করছে।

 

যদিও কয়েক ঘন্টা পরেই লাঠি নিয়ে হেফাজত সমর্থকরা রিসোর্টটিতে আক্রমণ করে ভাঙচুর চালায় এবং মামুনুলকে পুলিশের কাছ  থেকে নিয়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত ভিডিওতে মামুনুলকে রিসোর্টে থাকাকালীন স্থানীয়দের সাথে কথা-কাটাকাটি করতে দেখা  গেছে। কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে তাকে বলতে শোনা যায় সাথের নারীটি তার দ্বিতীয় স্ত্রী। যার নাম আমেনা তাইয়্যেবা। পরবর্তীতে জানা যায় আমেনা তার প্রথম স্ত্রীর নাম এবং রিসোর্টের ওই নারীর নাম জান্নাত আরা ঝর্ণা। এ ঘটনার পর মামুনুল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসে স্বীকার করেন স্থানীয়দের জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি মিথ্যা বলেছিলেন। তবে দু বছর ধরে তিনি ঝর্ণার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ বলে দাবি করেন। যা তার হেফাজতে ইসলামও সমর্থন করেছে। যদিও ঘটনার ছয় দিন পরেও মামুনুল তার দ্বিতীয় বিয়ের কোনও অফিসিয়াল ডকুমেন্ট বা প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি।

 

ঘটনার পর দু'বার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরাসরি হাজির হওয়া সত্ত্বেও মামুনুলকে আর জনসমক্ষে দেখা যায়নি। অবশ্য  হেফাজতের দু-একটি সভায় মামুনুল অংশ নিয়েছেন বলে জানানো হয়েছে।

 

মামুনুলের ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পর মামুনুল আর তার ঢাকার বাড়িতে ফিরে আসেননি। হেফাজতে ইসলাম প্রধানরা জনসমক্ষে মামুনুলের পক্ষে কথা বললেও অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে তারাও বিষয়টি নিয়ে ক্ষুদ্ধ। তারা এটাও আশঙ্কা করছে নারায়ণগঞ্জ কেলেঙ্কারির পর আইন প্রয়োগকারীরা সংগঠনের সমর্থকদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেবে। ২৬ মার্চ রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদে সংঘর্ষের ঘটনায় মামুনুলসহ আরও কয়েকজন নেতা ও কমপক্ষে ২ হাজার অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির সাথে পুলিশের সহিংসতার ঘটনায় হওয়া মামলার প্রেক্ষিতেই মামুনুল গ্রেফতার হতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন তারা। এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) জেলা প্রশাসক (মতিঝিল বিভাগ) সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, তদন্ত পুরোদমে চলছে এবং দোষীদের গ্রেফতারের জন্য আমরা অভিযান চালাচ্ছি।

 

মামুনুল এখন কোথায়?

রিসোর্টের ঘটনার পর থেকেই মামুনুলের হদিস সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে পারেনি। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে নিজের বাড়িতেও আর আসেননি তিনি। তবে কয়েকটি সূত্র বলছে মামুনুল জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসায় অবস্থান করছেন। সেখানে তিনি  শিক্ষকতা করেন। মামুনুলের ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, মামুনুলের স্ত্রী আমেনা রিসোর্টের ঘটনার পরপরই বাচ্চাদের নিয়ে  মোহাম্মদপুরের বাড়ি থেকে চলে যান। অবশ্য মামুনুলের পরিবারের হস্তক্ষেপে আবারও বাসায় ফিরে আসেন আমেনা যদিও মামুনুলের ভাই- বোনরা এ ঘটনায় বিরক্ত হয়ে আছেন তবে অনেক চেষ্টা করেও মামুনুলের ভাই মাহফুজুল হকের সাথে কোনো যোগাযোগ করা যায় নি। সেই ব্যক্তির মতে, মামুনুলের পরিবার নারায়ণগঞ্জের ঘটনার আগ পর্যন্ত তার দ্বিতীয় বিবাহ সম্পর্কে অবগত ছিল না। অপরদিকে মামুনুলের কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী জান্নাত আরা ঝর্ণা ঢাকার বাসিলায় একটি ফ্ল্যাটে অবস্থান করছেন।

 

ফোনের কথোপকথন ফাঁস

রিসোর্টের ঘটনার পরেই মামুনুল ও অন্যান্য হেফাজত নেতাদের একাধিক ফোন কল সামাজিক  যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ হয়। প্রথম ফোন কলে মামুনুলকে পুলিশ কর্মকর্তাসহ এনায়েত উল্লাহ নামে এক হেফাজত নেতার সাথে কথা বলতে শোনা যায়। এনায়েত পুলিশ অফিসারকে বলেন মামুনুলের সাথে থাকা নারী তার দ্বিতীয় স্ত্রী। দ্বিতীয় ফোন কলটি ছিল এনায়েত এবং অজ্ঞাতপরিচয় হেফাজতের এক নেতার মধ্যে। তাদের কথোপকথন শোনা যায় এনায়েত বলছে, মামুনুলই তাকে পুলিশকে জানাতে বলেছিলো দ্বিতীয় বিয়ের কথা তিনি (এনায়েত) জানেন। অজ্ঞাতপরিচয় অন্য ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়, ইতোমধ্যে সংগঠনের শীর্ষ নেতাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে এই বিয়েটা দু'বছর আগে হয়েছে। এনায়েত দাবি করেন মামুনুল ঝর্ণাকে বিয়ে করার সময় তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি অবশ্য সঠিক তারিখটি মনে করতে পারেননি।

 

সবই ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে?
হেফাজতের অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, পুরো ‘দ্বিতীয় বিবাহ’ বিষয়টিই কেলেঙ্কারী লুকোনোর একটি চেষ্টা। যারা এই বিয়ের সাক্ষী বা সাক্ষী হওয়ার দাবি করছে তারা সবাই মিথ্যা বলছে। মামুনুল নিজের কাছের লোক হিসেবে দাবি করা হেফাজত কর্মী শহিদুল ইসলামের সাথে বিবাহিত থাকা অবস্থায়ই ঝর্ণার সাথে সম্পর্ক  রেখেছিলেন বলে জানা যায়। তাদের প্রায় তিন বছর আগে বিবাহবিচ্ছেদ হয়। বিষয়টি সম্পর্কে পরিচিত লোকেরা জানান, শহীদুলের স্ত্রী থাকা অবস্থায়ই মামুনুলের সাথে ঝর্ণার একটি সম্পর্ক ছিল। ঝর্ণার ছেলে আবদুর রহমানও একটি ভিডিও বার্তায় এমনটা দাবি করেছেন। বিবাহ বিচ্ছেদের পর ঝর্ণা ঢাকায় একটি বিউটি পার্লারে চাকরী নেন। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারির কারণে তার চাকরি হারান। তবে ঝর্ণা বা তার ছেলের ফোন বন্ধ থাকার কারণে তাদের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।  পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে তারা সত্যের সন্ধানে মামুনুল এবং ঝর্ণার সাথে নিয়মিত যোগাযোগে ছিল এমন  কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তাদের মধ্যে একজন জিজ্ঞাসাবাদের সময় নিজেকে ঝর্ণার প্রাক্তন প্রেমিক হিসেবেও দাবি করেছেন। তিনি আরও বলেন, “ঝর্ণার অনেক ব্যক্তির সাথেই বিশেষ সম্পর্ক ছিল। আর্থিক সমস্যার কারণে এসব ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থও নিত সে। মামুনুলের সাথে বিয়ে হলে ঝর্ণার আর্থিক অবস্থা আরও ভাল থাকত।”