শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৫ ১৪৩০   ২০ রমজান ১৪৪৫

কালের বির্বতনে হারিয়ে যাচ্ছে রমজানের খুচরা বরফ বিক্রি

জহিরুল হক

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৫:২৩ পিএম, ১ মে ২০২১ শনিবার

কিছু ব্যবসা আছে, যা সবসময় করা যায় না। কিন্তু একটা মৌসুম বা উপলক্ষকে কেন্দ্র করে সে ব্যবসাটা জমজমাট হয়ে উঠে। তেমনি একটা ব্যবসা হলো বরফের খুচরা ব্যবসা। আগের দিনে যখননি রমজান আসতে বিশেষ করে গরমকালে রোজা আসলে ইফতারের আগে দেখা যেত বিভিন্ন স্থানে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা বরফের পাটা (বড় সাইজের বরফের টুকরো) নিয়ে আসতো যার ওজন প্রায় ৪০ থেকে ৫০ কেজি। সেখান থেকে কেটে কেটে টুকরো টুকরো করে এক কেজি, আধা কেজি এমনকি পোয়া কেজি (আড়াই শত গ্রাম) ও বিক্রি করতো। এখনকার দিনে সে ধরণের ব্যবসা বা ব্যবসায়ীদের তেমন একটা চোখে পড়ে না।


 
বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ। তবে শিল্প ও প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে বিভিন্ন মিল কারখানা ও যানবাহনের বিষাক্ত ধোঁয়া থেকে নির্গত হচ্ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড। আর নগরায়নের নামে কেটে ফেলা হচ্ছে গাছপালা ও বনাঞ্চল। এর প্রভাব পড়ে নষ্ট হচ্ছে প্রকৃতির অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ভারসাম্য। এর কারণে ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে পড়েছে পৃথিবী। তাই আমাদের দেশে এখন আর ছয় ঋতুর আলাদা রূপ তেমনভাবে চোখে পড়ে না। তবে গরম, বৃষ্টি বা শীতকে আলাদা করতে তেমন একটা সমস্যা হয় না। 

 

আর বিজ্ঞানের অবদানে প্রযুক্তির এই যুগে বর্তমানে প্রায় প্রতি ঘরে না হলেও প্রায় প্রতি বাড়িতে দেখা যায় রেফ্রিজারেটর বা ফ্রীজ। মানুষের প্রয়োজনে যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরির্বতন হয়েছে দেশের অবকাঠামো থেকে শুরু করে ব্যবসা বাণিজ্যের ধরণ। পরিবর্তন হচ্ছে মানুষের চাহিদা। আর তাইতো প্রচন্ড এই গরমেও রাস্তায় বসে মৌসুমী সেই ব্যবসায়ীদের ‘বরফ লাগবে বরফ’ বলে চিৎকার করে ডাকতে শোনা যায় না। এখন রাস্তায় রাস্তায় মিক্সার (ব্লেন্ডার মেশিন) মেশিন ব্যবহার করে বরফের সরবত বিক্রি করতে দেখা যায়। তবে তা শুধু রমজান বা রোজাকে কেন্দ্র করে না, সারা বছরই চলে এ ব্যবসা। যা শহর কেন্দ্রীক। গ্রামে খুব একটা চোখে পড়ে না।
 
একে একে চলে গেল ১৬ রোজা পাশাপাশি বাংলা বৈশাখ মাসেরও আজ ১৬ দিন। এক দিকে রমজান মাস অন্য দিকে বৈশাখের খড়া-উত্তাপ ও প্রচন্ড তাপ দাহ। আশির কিংবা নব্বইয়ের দশকের রমজান মাসে ইফতারে পূর্বের চিত্র আর আধুনিক এই প্রযুক্তির যুগের ইফতারের আগের চিত্র পুরোটাই আলাদা। প্রচন্ড গরমে পবিত্র রমজানের সময় সারাদিন উপোস থেকে সন্ধ্যায় যখন ইফতারের সময় হয় তখন হাতের কাছে লেবু মিশ্রিত শীতল পানির সরবতের জন্য মানুষ অধীর আগ্রহে থাকতো তখনকার দিনে বরফই ছিল মানুষের ভরসা। কারণ বরফের টুকরো ছাড়া তখনকার সাধারণ মুসল্লীদের কাছে ঘরে বসে ঠান্ডা পানি পাওয়াটা ছিল প্রায় অকল্পনীয়। 

 

আর তাইতো এলুমিনিয়ামের জগ নিয়ে শিশু কিশোরসহ বয়স্কদেরও দেখা যেত বরফ কিনতে রাস্তায় ছুটতে। বরফ ছাড়া ইফতার যেন অসম্পুর্ণ থেকে যেত। তাই সব ধরণের মুসল্লীদের কাছে মৌসুমি সেই বরফ বিক্রেতাদের এক ধরণের বিশেষ চাহিদা ছিল। কালের পরিক্রমায় এখন তা আর চোখে পড়ে না। শোনা যায় না সেই বরফ বিক্রেতাদের হাক-ডাক কিংবা তৃষ্ণার্ত মানুষের বরফ পাওয়ার জন্য হৈ হুল্লোরের শব্দ।  এক টাকা কিংবা বারো আনা করে প্রতি কেজি বিক্রি করতেন সেই মৌসুমি বরফ বিক্রেতারা। চার আনা (পঁচিশ পয়সা), আট আনা (পঞ্চাশ পয়সা) থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের কাছে খুচরো বিক্রি হতো এই বরফ। যারা ২ টাকা কিংবা ৩ টাকার কিনতেন, তাদের জন্য ছিল আলাদা একরকমের কদর। বিকেলের পর থেকেই শুরু হয়ে যেত বরফ বিক্রি এবং ক্রয়ের তাগাদা, চলতো ইফতার পর্যন্ত।
 
কালের বিবর্তনে মানুষের জীবন ধারণ পাল্টে গিয়ে বিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। এখন নি¤œ আয়ের মানুষ থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত প্রায় বেশিরভাগ পরিবারেই আছে ফ্রিজ বা রেফ্রিজারেটর।


গত এক দশকে ব্যপক পরির্বতন হয়েছে মানুষের জীবন যাপন পদ্ধতি পরিবর্তন হয়েছে চাহিদা। এখন আর সেই মৌসুমি বরফ খুচরা বিক্রেতাদের সেই হাক ডাক চোখে পরে না। দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে সেই দৃশ্য। তবে কদাচিৎ কোথাও এরকম দৃশ্য দেখা গেলে চোখে ভেসে উঠে তিন চার দশক আগের সেই চিত্র। তেমনি হারানো এই চিত্রটি দেখা গেলো চাষাড়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সামনে। সেখানে থেকে খুচরা বরফ বিক্রেতা থেকে সংগ্রহ করছে আশা পাশে হকার থেকে শুরু করে খেটে খাওয়া শ্রমিক ভ্যান চালক, রিক্সা চালকসহ নি¤œ বিত্ত ও শহরের ভাসমান লোকজন। তবে এই দৃশ্য দেখে এখনো হয়তো অনেকের চোখে ভেসে উঠে হারিয়ে যাওয়া সেই অতীত আর কানে ভেসে উঠে, ‘এই লন বরফ, মাত্র ১টাকা কেজি বরফ, ঠান্ডার আরাম বরফ’।