বুধবার   ০১ মে ২০২৪   বৈশাখ ১৭ ১৪৩১   ২২ শাওয়াল ১৪৪৫

শহরের বাণিজ্যিক সেক্টরগুলোতে ধস

শাহজাহান দোলন

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৯:৩৭ পিএম, ৭ জুলাই ২০২১ বুধবার

#হোসিয়ারী ব্যবসায় টিকে থাকাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে 


# ভাটা পড়েছে থানকাপড়ের ব্যবসায়


# মন্দা কাটছেনা স্বর্ণের ব্যবসায়, কারিগরদের দৈন্যদশা


# পরিবহন ব্যবসায় ধস, শ্রমিকরাও আর্থিক সংকটে

 

গত বছর দেশে প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্তের পর থেকেই, এটি প্রতিরোধে সরকার একের পর এক লকডাউন দিয়ে যাচ্ছে। তবে মহামারী প্রতিরোধে সরকার ঘোষিত এই লকডাউন এখন দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাছে আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। কারণ এর ফলে ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন জেলায় ব্যবসা বাণিজ্যসহ নানা খাতে ধস নেমেছে। বাদ যায়নি প্রাচ্যের ডান্ডি খ্যাত শহর নারায়ণগঞ্জও।

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সারাদেশে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকা লকডাউনে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন বাণিজ্যিক সেক্টরগুলো অর্থনৈতীক ভাবে মুখ থুবরে পড়েছে। এরমধ্যে শহরের হোসিয়ারী শিল্প, থানের ব্যবসা, পরিবহন সেক্টর ও স্বর্ণের ব্যবসা রয়েছে। হোসিয়ারী ব্যবসায় টিকে থাকাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে : নারায়ণগঞ্জে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্যিক এলাকার মধ্যে শহরের নয়ামাটি ও উকিলপাড়া অন্যতম। এলাকা দুটির মধ্যে ছোট-বড় মিলিয়ে কয়েক হাজার হোসিয়ারী প্রতিষ্ঠান আছে। জানা গেছে, দীর্ঘ দিন ধরে চলতে থাকা করোনা ভাইরাস ও লকডাউনের ফলে এমনিতেই ধস নেমেছে এসব এলাকার হোসিয়ারী ব্যবসায়। আর এরমধ্যে গত ৬ দিন যাবৎ সারাদেশে চলমান কঠোর লকডাউনের ফলে আরো ক্ষতির মুখে ধাবিত হচ্ছে হোসিয়ারী মালিকরা।

 


গতকাল সরেজমিনে গিয়ে নয়ামাটি ও উকিলপাড়ার কয়েকজন হোসিয়ারি ব্যবসায়ীর সাথে কথা হলে তাঁরা জানান, লকডাউনের ফলে দেশের দূরপাল্লার বিভিন্ন যানবাহন চলাচল ও পোশাকের দোকান বন্ধ থাকার কারণে পাইকারী পোশাকের বেচাকেনা বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে তৈরী করা অধিকাংশ পোশাক এখনো গোডাউনেই পড়ে আছে। উকিলপাড়ায় অবস্থিত আলী হোসিয়ারীর পরিচালক মোহাম্মদ দৌলত মিয়া বলেন, গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের কাছে লকডাউন কোন দুশ্চিন্তার বিষয় না। কারণ তাঁদের মাল বিমান দিয়ে দেশের বাইরে চলে যায়। তবে আমরা যারা ছোট ছোট হোসিয়ারী পরিচালনা করি, তাঁদের দেশেই ব্যবসা করতে হয়।

 

তাই সারাদেশে এখন যেই কঠোর লকডাউন চলছে এতে আমাদের অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় কোন ক্রেতারা নারায়ণগঞ্জ আসছেনা পোশাক ক্রয় করতে। তাই আমরাও বিক্রি করতে পাড়ছিনা। এখন শ্রমিকদের বেতন দেয়া ও ব্যবসাটা কোনরকম টিকিয়ে রাখাটাই আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জ। নয়ামাটির আরেক হোসিয়ারী ব্যবসায়ী বাদশা মিয়া বলেন, গত রোজার ঈদে যেই পোশাক তৈরী করেছিলাম লকডাউনের ফলে সেগুলো বিক্রি হয়নি। ভেবেছি এই ঈদে বিক্রি করবো; তবে এখন যেই কঠোর লকডাউন শুরু হয়েছে, এতে মনে হয় সকল মাল গোডাউনেই পড়ে থাকবে। তাই শ্রমিকদের বেতন ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনাসহ নানান দিক নিয়ে খুব বিপাকে আছি।

 


এদিকে বাংলাদেশ হোসিয়ারী এসোসিয়েশনের সভাপতি নাজমুল আলম সজল বলেন, আমাদের এখানে যারাই এখন হোসিয়ারী ব্যবসায় সাথে জড়িত আছেন, তাঁদের অধিকাংশের অবস্থাই এখন খারাপ। কারণ লকডাউনের ফলে দেশের বিভিন্ন শপিংমলগুলো বন্ধ থাকায় কেউই ঠিকমতো পোশাক বিক্রি করতে পাড়ছেনা। এছাড়া পাইকারদের কাছ থেকে আমাদের ব্যবসায়ীরা পাওনা টাকাও ঠিকমতো বুঝে পাচ্ছেনা। তাই এই মূহুর্তে সরকার যদি আমাদের হোসিয়ারী ব্যবসায়ীদের ক্ষুদ্র পরিসরে কিছু ঋণ সহায়তা করে তাহলে আমাদের জন্য খুবই ভালো হবে। ভাটা পড়েছে থানকাপড়ের ব্যবসায়: গত দুই সপ্তাহ যাবৎ চলেতে থাকা দেশব্যাপী কঠোর লকডাউন ও করোনার প্রভাব বেশ ভালো ভাবেই পড়েছে নারায়ণগঞ্জের সবচেয়ে বড় থানকাপড়ের মার্কেটে। শহরের দুই নং রেলগেট এলাকায় অবস্থিত এই পাইকারী থানের মার্কেটে বেচাকেনায় এখন রীতিমতো ভাটা লেগেছে।

 

ব্যবসায়ীরা জানান, সুতার অতিরিক্ত মূলবৃদ্ধির কারণে কয়েকমাস ধরে এমনিতেই মন্দা চলছিলো থান কাপড়ের ব্যবসায়। তবে এরমধ্যে একের পর এক কঠোর লকডাউন ব্যবসায়ীদের মাঝে ‘মরার উপর খারার ঘা’ হয়ে পড়েছে। পিন্টু মিয়া নামে এক থানের ব্যবসায়ী বলেন, গত তিন মাস ধরে বাজারে সুতার দাম অনেক বেশি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের থানের মূল্য বৃদ্ধি হওয়াতে এখন চাহিদা আগের তুলনায় কম। কিন্তু এরপরও আমরা কোনরকম ব্যবসাটা চালিয়ে নিচ্ছিলাম। তবে গত ৬-৭ ধরে যেই কঠোর লকডাউন চলছে এতে আমাদের অবস্থা একেবারে বেগতিক হয়ে গেছে। মূলত বেচাকেনা না থাকায় বিভিন্ন হোসিয়ারী গুলোতে উৎপাদন কমে গেছে তাই আমাদের থানের বিক্রিও বন্ধ।


করোনাকালে পরিবহন ব্যবসায় ধ্বস : গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে সরকারি বিধি-নিষেধের কারণে নারায়ণগঞ্জ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেড়ে যওয়া দূর পাল্লার গণপরিবহনগুলোর চলাচল একেবারেই বন্ধ। এতে আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নারায়ণগঞ্জের পরিবহন সেক্টরের প্রায় কয়েক লাখ শ্রমিক ও অসংখ্য মালিকরা এখন মানবেতর জীবন যাপন করছে।

 


এ বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলা বাস ও মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব আলী বলেন, আমাদের একটি বাস একদিন বসে থাকলেই ১ হাজার টাকা লস হয়ে যায়। কারণ স্টাফ ও মিস্ত্রিদের বেতনসহ প্রতিদিন আমাদের অনেক খরচ আছে। কিন্তু গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় আমাদের যেই ক্ষতি হচ্ছে এতে আমাদের পরিবহন ব্যবসা টিকিয়ে রাখাটাই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমাদের শ্রমিকরাও খুব সমস্যার মধ্যে আছে। তাই এই মূহুর্তে সরকারের পক্ষ থেকে যদি অনুদান বা সাহায্য না আসে তাহলে সামনে আমাদের করুণ পরিস্থিতি হবে।

 


বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থার সিনিয়র সহ সভাপতি বদিউজ্জামান বদু বলেন, আমাদের লঞ্চ মালিকরা এতোদিনের লকডাউনে কি পরিমানে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সেটা ভাষায় বলে শেষ করা যাবেনা। কিন্তু এরমধ্যে একের পর এক লকডাউন। তাই এখন কিভাবে স্টাফদের বেতন দিবো ও অন্যান্য খরচ চালাবো সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। ইতিমধ্যে নারায়ণগঞ্জের বহু লঞ্চের মালিকরা আমাকে ফোন আমাকে জানিয়েছেন যে, লঞ্চ বিক্রি করে দিবে। কারণ একের পর এক লকডাউনে যেই আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, সেটা আর তাঁদের পক্ষ্যে বহন করা সম্ভব হচ্ছেনা।

 


মন্দা কাটছেনা স্বর্ণের ব্যবসায়, কারিগরদের দৈন্যদশা : ছোট বড় প্রায় ১’শ স্বর্ণের দোকান নিয়ে শহরের কালীরবাজারে অবস্থিত স্বর্ণপট্টি এলকা। আধুনিক ডিজাইন এবং চোখধাধানো নানা অলংকার তৈরীতে এখানকার কারিগরদের রয়েছে বিশেষ সুনাম। তাই বহু বছর ধরে এখানে গহনার জমজমাট ব্যবসা হলেও, গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সারাদেশে লকডাউন ও চলমান করোনা পরিস্থিতির জন্যে এখানকার ব্যবসায়ীরা এখন অর্থনৈতীক ভাবে চরম সংকটের মধ্যে আছে। আর ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি গহনা তৈরীর কারিগরদেরও যেতে হচ্ছে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে।

 


কালীরবাজার স্বর্ণ ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি হাজী মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ এ বিষয়ে বলেন, গত এক বছর ধরে করোনা ও লকডাউনের আমাদের গহনার ব্যবসায় কোন উন্নতী নেই। লকডাউনের ফলে আমাদের বেচাকেনা বন্ধ হয়ে গেল! এখন দেখা যাচ্ছে বেচাকেনা বন্ধ থাকায় আমাদের দোকান ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন এগুলো সবই মূলধন থেকেই দিতে হচ্ছে। সুতরাং এই অবস্থা যদি আর কিছুদিন থাকে তাহলে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলা ছাড়া আর কোন উপায় নেই আমাদের কাছে।