মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১০ ১৪৩১   ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

ফটোসেশন থেকে তৈমূর-দীপু গ্রুপের তুলকালাম

যুগের চিন্তা অনলাইন

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ১০:৩৫ পিএম, ১৪ জুলাই ২০২১ বুধবার

#নেতাদের পাশে দাঁড়িয়ে ফটোসেশন নিয়েই সংঘাত, বিব্রত কেন্দ্রীয় নেতারা

 

‘কোন্দলে জর্জরিত বিএনপি।’ কথাটি অনেকটা প্রতিপাদ্যে রূপ নিলেও বাস্তবতায় এর স্বাক্ষরও রেখে যাচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের বিএনপি নেতারা। দলের দুঃসময়ে এক হতে না পারা নারায়ণগঞ্জের বিএনপি নেতারা এককাতারে দাঁড়াতে পারেননি কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দদের সামনেও। নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব নিয়ে বিরোধে জর্জরিত বিএনপি নেতারা যে দলের সাংগঠনিক কর্মকান্ড পালন বা দলীয় শৃঙ্খলার চাইতেও ফটো সেশনে মত্ত, তা আবারও প্রমাণ করেছেন গতকাল।

 

জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাশেম ফুড এন্ড বেভারেজ লিমিটেডে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ৫২ জন শ্রমিকের প্রাণহানীর ঘটনায় গতকাল দুপুরে কারখানাটি পরিদর্শনে আসেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম, বিএনপির যুগ্ন মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন ও বিএনপি নির্বাহী কমিটির প্রচার সম্পাদক সহিদউদ্দিন চৌধুরী এনিসহ প্রতিনিধি দল। প্রতিনিধি দল আসার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা কার্য সম্পাদনায় ছিলেন জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটি। তারা আসার পর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহায়ক নাসির আহমেদ তাদের আপ্যায়ন করেন। দুপুর আড়াইটার দিকে প্রতিনিধিদল হাসেম ফুড লিমিটেডের মুল গেইটের সামনে এসে উপস্থিত হন।

 

এসময় জেলা বিএনপির আহবায়ক অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার ও যুগ্ম আহবায়ক নাসির আহমেদসহ তাদের সমর্থকরা কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশে অবস্থান নেন। একই সময়ে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান ভুইয়া দিপুসহ তার সমর্থকরাও অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে দিপু ভূইয়া নাসির আহমেদকে কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশ থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে নাসির আহমেদও দিপু ভূইয়াকে ধাক্কা দেন। তখন নাসির আহমেদ ও দিপু ভূইয়ার কর্মীদের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়। উপস্থিত নেতাকর্মীরা বলছেন, উভয় পক্ষেরই উদ্দেশ্য প্রেস ব্রিফিংয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশে দাঁড়িয়ে ক্যামেরার ফোকাসে থেকে ফটো সেশন করা।

 

এদিকে, কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে সেই দফায় উভয়পক্ষ শান্ত হলেও কেন্দ্রীয় নেতারা ঘটনাস্থল থেকে চলে যাওয়ার পরই দিপু ভূইয়া ও জেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক নাসির আহমেদের কর্মী সমর্থকদের সাথে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয় এবং সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে সংবাদকর্মীরা সহ উভয় গ্রæপের অন্তত ২০ জনের মত আহত হয়। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে স্থানীয়দের মাঝে। পরে রূপগঞ্জ থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌছে উভয় গ্রæপের নেতাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

 

এই বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক নাসির আহমেদ দৈনিক যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় নেতারা আসার বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপিকে ব্যবস্থাপনায় থাকতে বলা হয়েছে। সেই হিসেবে আমরা ব্যবস্থাপনায় ছিলাম। কেন্দ্রীয় নেতাদের আমার অফিসে আপ্যায়ন করা হয়। পরিদর্শনের পর প্রেস ব্রিফিংয়ের সময়ে হঠাৎ করে দিপু ভূইয়া এসে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। উনি কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে আমি তাকে জায়গা এমনিতেই দিতাম। কিন্দু উনি আমাকে ধাক্কা দেয়ায় আমিও দিপু ভূইয়াকে দাঁড়াতে দেইনি। ব্রিফিং শেষে আমি কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে থাকাবস্থায় দিপু ভূইয়ার নেতৃত্বে তার লোকজন এসে আমার সাথে হাতাহাতি শুরু করে এবং আমার হাতে থাকা ২৮ হাজার ডলার মূল্যের ২৪ কেরেট স্বর্ন এবং ডায়মন্ডের তৈরী ঘড়ি ছিনিয়ে নেয় এবং পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় নেতারা চলে যাওয়ার পর তারা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। আমার এলাকার লোকজনও ছিলো।

 

তিনি বলেন, দিপু ভূইয়ার সাথে আমার কোন সময়ে দ্ব›দ্ব ছিলো না। হয়তো আমি আগামীতে জেলা বিএনপির ভালো একটি পদে আসতে পারি, তা নিয়ে দিপু ভূইয়া হিংসা করে এগুলো করে যাচ্ছে। ঘটনার বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা আমার সাথে যোগাযোগ করেছে। আমি তাদেরকে বিস্তারিত বলেছি। তারা যেই নির্দেশনা দেবেন, আমি সেটাই মেনে নেবো।’ এদিকে, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান ভুইয়া দিপু দৈনিক যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘আমি যখন এসেছি, তখন থেকেই নাসির সাহেব সবার সাথেই চেচামেচি করছিলো।

 

তখনই উপস্থিত ছেলেরা ওনাকে ধরতে চেয়েছিলো। তখন আমি নিজেই অনেক কষ্ট করে সবাইকে সরিয়ে দেই। যখন বেড় হয়ে চলে আসলাম, তারপর শুনলাম সেখানে গন্ডগোল লেগেছে আবার। এখানে আমার নির্দেশনা যদি থাকতো, তাহলে প্রথমেই কিছু একটা করতাম। আমি নিজে আটকাতে গিয়ে নিজেই লোকজনের হাতাহাতির মধ্যে পড়েছি। বিষয়টি আসলেই দুঃখজনক।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার ফটোসেশন করার প্রশ্নই উঠে না। আর এখানে কারো সাথে আমার ব্যক্তিগত কোন দ্বন্ধ নেই। নাসির চাচার বাবার সাথে আমার পরিবারের সবার সাথে ভালো সম্পর্ক। আমার মনে হয় না যে নাসির সাহেবের কাছে আমার শাক্তির জানান দেয়ার মত অবস্থানে উনি আছে বা তার সাথে আমার শক্তির জানান দেয়ারও কিছু নেই। এখানে আমার লোকজন তেমন ছিলো না।

 

এই বিষয়ে পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে আমার আর কোন কথা হয়নি।’ জেলা বিএনপির আহবায়ক অ্যাড. তৈমুর আলম খন্দকার দৈনিক যুগের চিন্তাকে বলেন, ছবি তোলা নিয়ে ধাক্কা ধাক্কি এবং পরবর্তীতে এই ঘটনার সূত্রপাত হয়। সাবাইতো দলকে ভালোবেসে রাজনীতি করতে আসে না। অনেকে আসে দল থেকে মধু খাওয়ার জন্য। যারা দলে আসে মধু খাওয়ার জন্য, তারা এমন অহেতুক শোডাউন করতে চায়। শোডাউন করতে গিয়ে গোলযোগ সৃষ্টি করে। নিজের প্রভাব বিস্তার করতে চায়। যারা এগুলো করে, তারা দলের জন্য কোন ফ্যাক্টর না।’ তিনি বলেন, ‘মহাসচিব আমার কাছে ঘটনা জানতে চেয়েছেন। মহাসচিবকে জানানো হয়েছে। আর কেন্দ্রের স্থায়ী কমিটির নোতারাও এখানে ছিলো। হয়তো তারা এই বিষয়ে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবেন।’

 

তথ্য বলছে, ‘২০০৬ সাল থেকে ক্ষমতার স্বাদ না পাওয়া নারায়ণগঞ্জ বিএনপি দলীয় কর্মসূচিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বারংবার। দীর্ঘ ১৫ বছরে স্বল্প সংখ্যক কর্মী নিয়েও নারায়ণগঞ্জের রাজপথে দাঁড়াতে পারেনি দলটি। ফলে এক সময়ের রাজপথ কাঁপানো নারায়ণগঞ্জ বিএনপি পরিণত হয় ডুবন্ত জাহাজে। তবে, দলীয় কর্মসূচিতে সরকারি দল ও প্রশাসনের সামনে দাঁড়াতে না পারলেও বিএনপি নেতারা লিপ্ত গৃহযুদ্ধে! নিজ দলের নেতাকর্মীদের ঘায়েল করতে ব্যস্ত সময় পাড় করছে জেলার নেতৃবৃন্দরা। এর বিরুপ প্রভাব পড়ছে দলের তৃণমূলে। একাধিক গ্রুপে ভাগ হয়ে বিএনপিতে একাধিক খন্ডন করেছে হেভীওয়েট নেতারাই।

 

এদিকে, প্রশ্ন উঠেছে বর্তমান জেলা কমিটি এবং আহবায়ক তৈমূর আলম খন্দকারকে নিয়েও। কেননা গত পহেলা জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটি হওয়ার পর থেকেই স্থানীয় বিএনপি ও অংগ সংগঠনের নেতাদের মাঝে বেধেছে একাধিক সংঘর্ষ। এসব সংঘর্ষকালে উপস্থিত ছিলেন তৈমূর আলম খন্দকার নিজেও। এরপরও সংঘর্ষ বেধে যাওয়ায় তৈমূরের অবস্থান এবং নেতৃত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপির একাধিক নেতা।