মঙ্গলবার   ৩০ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১৭ ১৪৩১   ২১ শাওয়াল ১৪৪৫

না’গঞ্জে একাধিক প্রতিষ্ঠান হেলেনার স্বামীর

যুগের চিন্তা অনলাইন

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৯:০৬ পিএম, ৩ আগস্ট ২০২১ মঙ্গলবার

১৯৯৩ সালে নারায়ণগঞ্জের গলাচিপা এলাকায় স্বামী জাহাঙ্গীর আলমকে সাথে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ শহরের গলাচিপা এলাকায় বসবাস করতেন বর্তমান সময়ের আলোচিত নারী হেলেনা জাহাঙ্গীর। গলাচিপার নজরুলের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন তিনি। হেলেনা জাহাঙ্গীরের স্বামী জাহাঙ্গীর আলম সেই থেকে নারায়ণগঞ্জের নীট কনসার্ন গ্রুপে চাকুরী করতেন প্রডাকশন ম্যানেজার পদে। তখনকার সময়ে জাহাঙ্গীর আলমের বেতন ছিলো ১২ হাজার টাকা। নীট কনসার্ন গ্রুপেই ২৭ বছর চাকুরী করেছেন জাহাঙ্গীর আলম। ধাপে ধাপে পদোন্নতী লাভ করে নিট কনসার্ন গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (ইডি) এর দায়িত্ব পেয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম।


একটি সূত্র বলছে, হেলেনা জাহাঙ্গীরের ওই ঘটনার পর আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কার এবং গ্রেফতার হওয়ার পরপরই নিট কনসার্ন থেকে তার স্বামী জাহাঙ্গীর আলমকে চাকুরিচ্চুৎ করেন প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ। তবে, নিট কনসার্ন গ্রুপের পরিচালক জাহাঙ্গীর মোল্লার দাবী- নিট কনসার্ন গ্রুপকে নিজের মালিকানা প্রতিষ্ঠান বলে প্রচার করায় আরো প্রায় ২ মাস আগেই হেলেনার স্বামীকে নিট কনসার্ন থেকে চাকুরীচ্চ্যুত করা হয়েছে।

 


জানতে চাইলে নিট কনসার্ন গ্রুপের মালিক জাহাঙ্গীর মোল্লা দৈনিক যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘হেলেনা জাহাঙ্গীরের স্বামী জাহাঙ্গীর আলম ১৯৯৩ সাল থেকেই আমাদের প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করতো। সবশেষ তাকে নির্বাহী পরিচালক (ইডি) পদেও পদোন্নতী করা হয়েছিলো। ব্যক্তিগত ভাবে জাহাঙ্গীর আলমকে আমরা ভালো মানুষ হিসেবেই জানতাম। কিন্তু তার স্ত্রী হেলেনা জাহাঙ্গীর বিভিন্ন সময় বলে বেড়াতেন যে, তারা নিট কনসার্ন গ্রুপের মালিক। আমাদের প্রতিষ্ঠানের সাথে ছবি তুলে তারা এগুলো করতেন। বিষয়গুলো জানার পর গত প্রায় ২ মাস পূর্বেই জাহাঙ্গীর আলমকে আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে চাকুরিচ্চুৎ করে দেই। এরই মধ্যে গত কিছুদিন পূর্বে জানতে পেরেছি যে, হেলেনা জাহাঙ্গীর গ্রেফতার হয়েছেন। মূলত হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিষয়গুলো উঠে আসার আগেই আমরা তার স্বামীকে আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে বহিস্কার করেছি। আমাদের কাছে কাগজপত্রও আছে।’

 

এদিকে, নিট কনসার্নে ১২ হাজার টাকা বেতনে চাকুরী করা হেলেনা জাহাঙ্গীরের স্বামী এখন কোটিপতি। নারায়ণগঞ্জ শহরেই গড়ে তুলেছেন বেশ কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠান। এমনকি নিট কনসার্ন গ্রুপের পাশেই জাহাঙ্গীর আলম গড়ে তুলেছেন নিট কনসার্ন প্রিন্টিং ইউনিট। এখানে তার একাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ফতুল্লার পঞ্চবটিতেও রয়েছে তার মালিকানা প্রতিষ্ঠান। এদিকে, ১২ হাজার টাকা বেতনে চাকুরী জীবন শুরু করা জাহাঙ্গীর আলমের এই অর্থ সম্পদের উৎস নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে সর্বত্র।

 

তবে, এই বিষয়ে নীট কনসার্ন গ্রুপের পরিচালক জাহাঙ্গীর মোল্লা আরো জানান, ‘২৭ বছর আমাদের প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করেছে। আমি তাকে গলাচিপার নজরুলের বাড়িতে ঘর ভাড়া নিয়ে দিয়েছিলাম। সেখান থেকে তার স্ত্রী এতো টাকার মালিক হয়েছেন, তা আমাদের জানাই ছিলো না। হেলেনার স্বামী জাহাঙ্গীর আলম আমাদের প্রতিষ্ঠানের গেঞ্জি প্রিন্ট করতো। চাকুরীর পাশাপাশি আমার দেখা মতে এটাই ছিলো তার ব্যবসা। তারা আমাদের সাথেই সেই টাকার গরম দেখাতো। আমরা চলতাম হ্যারিয়ার গাড়িতে, আর তারা চলতো বিএমডব্লিউতে। তারা টাকার গরম দেখাতো। এই ব্যবসার বাইরে তারা কি করতো তা আমাদের জানা ছিলো না।’ নীট কনসার্নের পরিচালক জাহাঙ্গীর মোল্লা জানান, ঈদের পর থেকেই হেলেনা জাহাঙ্গীরের স্বামীকে নারায়ণগঞ্জে দেখা যাচ্ছে না। তিনি তার প্রতিষ্ঠানে এসেছেন কিনা- এমন কোন তথ্য পাইনি। হয়তো হেলেনার ঘটনা প্রকাশের পর থেকেই জাহাঙ্গীর আলম নারায়ণগঞ্জে আসাও বন্ধ করে দিয়েছেন।

 

প্রসঙ্গত, বিভিন্ন সময় নানা ভাবে আলোচনা-সমালোচনায় আসা হেলেনা জাহাঙ্গীরকে গত ২৯ জুলাই দিবাগত রাতে গুলশানের নিজ বাসা থেকে আটক করে র‌্যাব। কখনও ব্যবসায়িক আবার কখনও রাজনীতিবিদ হিসেবে আলোচনায় আসেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। তার আসল নাম হেলেনা আক্তার। ১৯৯০ সালে জাহাঙ্গীর আলমকে বিয়ে করলে নামের সঙ্গে যুক্ত হয় জাহাঙ্গীর। জাহাঙ্গীর আলম কুমিল্লার বাসিন্দা। তিনি তিন সন্তানের জননী। ১৯৭৪ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার তেজগাঁওয়ে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা মরহুম আবদুল হক শরীফ ছিলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন। বাবার চাকরির সুবাধে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামের হালিশহরের মাদারবাড়ী, সদরঘাট এলাকায়।

 

তথ্য বলছে, বেশকিছু দিন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সমাজ সেবক সিস্টার হেলেনা জাহাঙ্গীর নামে পরিচিতি পান। সমাজ সেবক ও নারী উদ্যোক্তা হিসেবে বিভিন্ন সময় মিডিয়ায় টকশোতে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও প্রায় এক ডজন সামাজিক সংগঠনের নেতৃস্থানীয় দায়িত্বে রয়েছেন হেলেনা। রাজনৈতিক অঙ্গনে রয়েছে তার দাপুটে উত্থান ও পদচারণ। সফল নারী উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী হিসেবে মিডিয়ায় হেলেনা জাহাঙ্গীর আলোচনায় আসেন। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজেও একটি জয়যাত্রা আইপি টিভি চালু করেন।

 

জয়যাত্রা গ্রুপের কর্ণধার হেলেনা জাহাঙ্গীর নিজেকে আইপি টিভি ও নার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি হিসেবেও পরিচয় দেন। হেলেনা জাহাঙ্গীর ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সদস্য ও নির্বাচিত পরিচালক। পোশাক শিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএরও সক্রিয় সদস্য তিনি। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক পুরস্কৃতও হয়েছেন রোটারি ক্লাবের একজন ডোনার হিসেবে। প্রিন্টিং, অ্যাম্ব্রয়ডারি, প্যাকেজিং, স্টিকার এবং ওভেন গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবেও তার পরিচিতি রয়েছে।

 

জয়যাত্রা গ্রুপের আওতায় এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি। সব মিলিয়ে ১২ হাজার কর্মী কাজ করছেন তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য ছিলেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। সাম্প্রতিক ঘটনার পর তাকে ওই কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়। কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কয়েকটি বিদেশযাত্রার সফরসঙ্গীও হয়েছিলেন হেলেনা। মিডিয়ার মাধ্যমে পরিচিত লাভ করা হেলেনা জাহাঙ্গীর বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত কর্মকান্ডের কারণে দেশজুড়ে আলোচিত-সমালোচিত হন।

 

সর্বশেষ আওয়ামী লীগে সহযোগী সংগঠন হিসেবে ‘চাকরিজীবী লীগ’ নামে একটি সংগঠনের সম্পৃক্ততার কারণে আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় তাকে। বর্তমানে আওয়ামী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হলেও এর আগে জাতীয় পার্টি ও বিএনপির রাজনীতিতে সংশ্লিষ্টতার খবর পাওয়া যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দুটি দলের প্রধান খালেদা জিয়া ও হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের সঙ্গে হেলেনা জাহাঙ্গীরের ছবি প্রকাশ পেয়েছে। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। তখন দাবি করতেন, তার কোনো রাজনৈতিক দল নেই। তিনি স্বতন্ত্র রাজনীতি করতে চান। যদিও পরে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান।

 

হেলেনা জাহাঙ্গীর গুলশান ক্লাব, গুলশান নর্থ ক্লাব, বারিধারা ক্লাব, কুমিল্লা ক্লাব, গলফ ক্লাব, গুলশান অল কমিউনিটি ক্লাব, বিজিএমইএ অ্যাপারেল ক্লাব, বোট ক্লাব, গুলশান লেডিস ক্লাব, উত্তরা লেডিস ক্লাব, গুলশান ক্যাপিটাল ক্লাব, গুলশান সোসাইটি, বনানী সোসাইটি, গুলশান জগার্স সোসাইটি ও গুলশান হেলথ ক্লাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।