রোববার   ১৯ মে ২০২৪   জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১   ১১ জ্বিলকদ ১৪৪৫

টিকা নিতে এসে ক্ষুব্ধ বিরক্ত মানুষ

যুগের চিন্তা অনলাইন

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৬:৫৫ পিএম, ১২ আগস্ট ২০২১ বৃহস্পতিবার

বেলা তখন ৩টা। করোনাভাইরাসের টিকা (প্রতিষেধক) নিতে লাইনে দাঁড়িয়েছেন গৃহিনী জেনিফা (৩৩)। সাথে দাঁড়িয়ে তার ৫৫ বছর বয়সী মা শিরিনা বেগম। প্রায় ৫ ঘন্টা যাবৎ লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন বলে জানান তারা। গতকাল নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতাল কেন্দ্রে এই চিত্র দেখা যায়।

 

ক্ষুব্দ-বিরক্ত জেনিফা ও শিরিনা বেগম টিকা প্রদান কার্যক্রমে নিয়োজিত সংশ্লিষ্টদের অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তোলেন। শিরিনা ও জেনিফার সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা জানান, মুঠোফোনে খুদেবার্তা পেয়ে সকাল ১০টা বাজে টিকার জন্য লাইনে দাঁড়ান। শুরুতে লাইন ছিল হাসপাতাল ছাড়িয়ে রাস্তা হয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নগরভবনের সামনে। বেলা ১১টার দিকে হাসাপাতালের ভেতর প্রবেশ করতে পারেন। কিন্তু তখন শোনেন, হাসপাতালে বরাদ্দ টিকা শেষ। আবার বাসায় ফিরে যাওয়ার পর শুনতে পারেন, আবার টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। পুনরায় এসে লাইনে দাঁড়ান তারা।

 

হাসপাতালে টিকা প্রদান কার্যক্রমে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুলে জেনিফা বলেন, ‘এত এত মানুষ লাইনে দাঁড়ায়ে আছে, এখন কি করোনা ছড়ায় না? এইখানে করোনা আরও বেশি ছড়াইতাছে। ভ্যাক্সিনের নামে এখন শরীরে করোনা ঢুকতাছে। স্টাফদের পরিচিত লোকজন দেখে দেখে লাইন ভেঙে ঢুকানো হইতেছে। সরকারের উচিত ছিল সব ব্যবস্থা রাইখা তারপর টিকা দেওয়ার। কোনো সিস্টেমই ঠিক নাই। টিকা কীভাবে শেষ হয়?’ তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণ জনগণ এইভাবেই হেনস্থার শিকার হবে। আপনারা লেইখা নিতে পারবেন, ছবি তুলবেন কিন্তু কিছু করতে পারবেন না।’

 

তার মা শিরিনা বলেন, ‘টিকার ম্যাসেজ আসছে দেইখা সকাল থেইকা এই পর্যন্ত দাঁড়ায়ে রইছি। আমি অসুস্থ মহিলা মানুষ। এতক্ষণ কি আমরা দাঁড়ায়ে থাকতে পারি? আমার ৫০ বছর বয়সের এই জীবনে এমন তামাশা দেখি নাই।’ এই কথা বলার পরই ক্লান্ত শিরিনা লাইন থেকে বেরিয়ে হাসপাতাল চত্ত্বরের এক কোনায় গিয়ে বসে পড়েন। সকাল ৮টায় লাইনে দাঁড়ান হাফসা। বেলা ১১টা বাজে টিকার বরাদ্দ শেষ শুনে ফিরে গিয়েছিলেন বাসায়। পরিচিত একজনের ফোনে আবার ফিরে আসেন। দুপুর আড়াইটায় টিকা নেন তিনি। হাফসা অভিযোগ করে বলেন, ‘কোনো সিস্টেম নাই। ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেও কেউ টিকা নিতে পারতেছে না। আবার কেউ কেউ লাইন ভেঙে পরিচিত লোক দিয়ে টিকা নিয়ে নিচ্ছে লাইনে না দাঁড়িয়েই।

 

এই কথা জিজ্ঞেস করলে নার্সরা খারাপ ব্যবহার করেন।’ সকাল থেকেই হাসপাতালে ছিল টিকা গ্রহীতাদের ভিড়। টিকা গ্রহীতাদের লাইন হাসপাতাল চত্ত্বর ছাড়িয়ে যায়। হাসপাতালের সামনেও সড়কেও লাইন ধরতে দেখা যায় অনেককে। তারা দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন টিকা নেওয়ার জন্য। এই সময় স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই ছিল না। দীর্ঘ লাইনে একে-অপরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রতিষেধক নিতে এসে করোনায় সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছেন তারা। হাসপাতালে দায়িত্বশীল কর্মকর্তা-কর্মচারী ও টিকাগ্রহীতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১২ আগস্ট থেকে করোনার প্রতিষেধক মডার্নার প্রথম ডোজ দেওয়া বন্ধ থাকবে; এমন খবর শুনে অনেকেই হাসপাতালে টিকা নিতে ভিড় করেন। মুঠোফোনে খুদেবার্তা না পেলেও টিকা কার্ড হাতে চলে আসেন হাসপাতালে। বেলা ১১টা নাগাদ নিয়মিত বরাদ্দের টিকা শেষ হয়ে গেলে টিকা প্রদান কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এ নিয়ে হাসপাতালে হুলস্থুল বেঁধে যায়।

 

পরিস্থিতি সামলাতে সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহ্ জামানের নেতৃত্বে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয় হাসপাতালে। ওসি বলেন, সকাল থেকেই তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছেন। হাসপাতালে মাইকিং করার ব্যবস্থা ছিল না, তারা তা ব্যবস্থা করেছেন। লাইন ভঙ্গ করে যাতে কেউ ঢুকতে না পারে সেইদিকে নজর রেখেছেন তারা। অতিরিক্ত মানুষের চাপ সামলাতে বেগ পেতে হয়েছে তাদের। তবে টিকা নিতে আসা ব্যক্তিদের অভিযোগ, পুলিশের সামনে দিয়েই হাসপাতালের স্টাফদের পরিচয় দিয়ে লাইন ভঙ্গ করে টিকা নিয়েছেন। টিকা নিতে আসা ষাটোর্ধ্ব মমতা রাণী সাহা বলেন, লাইন ভেঙে অনেকেই টিকা নিয়েছেন। হাসপাতালের লোকজনের পরিচয়ে তারা টিকা নিয়েছেন। একই অভিযোগ করেছেন পোশাক শ্রমিক সাইফুল ইসলাম।

 

উল্লেখ্য, সিটি কর্পোরেশনভুক্ত এলাকাগুলোতে মডার্নার টিকা প্রদান করা হয়। নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে সিটি এলাকায় নিবন্ধন করা ব্যক্তিদের টিকা প্রদান করা হয়। সাধারণত দুপুর দুইটার দিকে টিকা প্রদান কার্যক্রম শেষ হলেও বিকেল চারটা পর্যন্ত এই কার্যক্রম চলে। দৈনিক দুই হাজার টিকা বরাদ্দ থাকলেও ওইদিন বিশেষ ব্যবস্থায় দ্বিগুন টিকা প্রদান করা হয়েছে বলে জানান নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) মো. আসাদুজ্জামান।

 

নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শেখ মোস্তফা আলী বলেন, মডার্না টিকার প্রথম ডোজ প্রদান বন্ধ হয়ে যাবে শোনার পরই অতিরিক্ত মানুষ হাসপাতালে টিকা নিতে আসেন। এতেই চাপ বেড়ে যায়। তাছাড়া সিটি এলাকায় অনেক লোকের বসবাস। অনেকেই গণটিক কার্যক্রমে টিকা দিতে পারেননি। তারা সবাই এসে হাসপাতালে ভিড় করাতে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। তবে চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দের চেয়ে দ্বিগুন টিকা দেওয়া হয়েছে। টিকা না নিয়ে কেউ ফিরে যাননি।