শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১   ১১ শাওয়াল ১৪৪৫

দিন বদলের আশায় সোনারগাঁয়ের গামছা তাঁতীরা

যুগের চিন্তা অনলাইন

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৮:১৪ পিএম, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ শনিবার

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার চরভুলা ও আট গড়িয়া আলমদী গ্রাম দুটিতে প্রবেশ করলেই কানে আসে খুটখাট শব্দ। প্রায় প্রতিটি বাড়ীর বারান্দায় রয়েছে ছোট ছোট তাঁত। নানা নকশার গামছা বুননে ব্যস্ত তাঁতিরা। মানে সেরা বলে দেশের বিভিন্ন স্থানের ব্যবসায়ী ও স্থানীয় লোকজন এই গামছা কেনেন।

 

তবে বর্তমানে সোনারগাঁয়ের গামছা তাঁতিরা তেমন ভালো নেই। স্থানীয় তাঁত শিল্পে জড়িত শ্রমিকরা বলেন, দিন দিন সুতার দাম বাড়লেও তাদের কাপড়ের দাম বাড়েনি। লাভ আগের মত না থাকায় শতাধিক কারিগর তাঁত বন্ধ করে দিনমজুরি, রিকশাভ্যান চালানোসহ আশপাশের বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। যারা আছেন তারা দিন বদলের আশায় কোনো মতে গামছা বুনে যাচ্ছেন। সস্প্রতি সোনারগাঁ উপজেলার চরভুলা, আটগড়িয়া ও আলমদী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়। বর্তমান বাজারে দ্রব্যমূল্য উর্দ্বগতি হওয়ায় সংসার চালানোতে হিমসিম খেতে হচ্ছে তাঁত শিল্পে জড়িত অনেক পরিবারকে। তাই সাংসারিক কাজের পাশাপাশি গৃহবধুরাও এখন গামছা তৈরি করছেন। বাড়ির আঙিনায় চরকায় রং-বেরঙের সুতা গুটিতে গুছিয়ে দিচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা।

 


স্থানীয় তাঁতিরা বলেন, বিগত পাঁচ-ছয় বছর আগেও দুই গ্রামের প্রায় তিন শতাধিক কারিগর গামছা তৈরি করতেন। বর্তমানে মাত্র অর্ধশতাধিক কারিগর গামছা তৈরি করছেন। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার আনন্দবাজার, নরসিংদীর ভুলতা গাউছিয়াতে বসে গামছার হাট। দুর-দুরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা এসে গামছা কেনেন। অনেক ব্যবসায়ী আবার গামছা কিনতে সরাসরি তাঁতিদের বাড়িতে আসেন। চরভুলা গ্রামের তাঁতি আফসার উদ্দিন (৫৬) বলেন, গামছা তৈরি করার কাজ আমার বাবা শিখেছিল দাদার কাছে, আমি শিখেছি বাবার কাছ থেকে, আমার ছেলে মেয়েরা ও এখন গামছা বুনতে পারে। তিনি বলেন চরভুলা ও আলমদী গ্রামে তৈরি কাপড়ের মান উন্নত। এখানকার কারিগরেরা বুননে ফাঁকি দেয়না। প্রতিটি গামছার সুতা, রং এবং মাপ সঠিক থাকে। এ কারনে সারাদেশে এখানকার গামছার আলাদা কদর রয়েছে। বিদেশেও এখানকার তৈরি গামছা বিক্রির জন্য পাঠানো হয়।

 


উপজেলার বারদী এলাকার জহিরুল ইসলাম মৃধা জানান, বিগত ৪০ বছর ধরে এখানকার তৈরি গামছা ব্যবহার করি। এই গামছার বিশেষত্ব হলো সুতা ও বুনন, যা দেশের অন্য কোন স্থানের গামছায় পাওয়া যায়না। এখানকার গামছা খুবই মসৃন এবং ব্যবহার করে খুব আরাম। দীর্ঘদিন ধরে চরভুলা ও আলমদী গ্রামে গামছা কিনতে আসেন চাঁদপুরের ব্যবসায়ী জমির আলী। তিনি বলেন আমার অনেক ক্রেতা আছেন, যারা সোনারগাঁয়ের গামছা ছাড়া অন্য কাপড় কিনতে চায়না। মানে ভালো বলে একটু বেশি দামে বিক্রি করা যায়।

 


স্থানীয় তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলে জানাগেছে, চার-পাঁচ বছর আগেও এক মুড়া (২৮০গ্রাম) সুতার দাম ছিল মাত্র ২০ থেকে ২৫ টাকা। রঙের দামও ছিল অনেক কম। এক মুড়া সুতা দিয়ে এক জোড়া গামছা বুনা যায়। তখন এক জোড়া গামছার পাইকারি দাম ছিল ১২০-১৪০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি জোড়া গামছায় গড়ে লাভ ছিল ৮০ টাকা। সংসারে নারী পুরুষ ও বৃদ্ধরা মিলে প্রতি তাঁতে ৭/৮টি গামছা বুনতে পারতেন। তাঁতিরা বলেন বর্তমানে এক মুড়া সুতার দামই ১০০ টাকা। একজোড়া গামছা তৈরিতে রং লাগে আরো ৪০ টাকার। ব্যবসায়ীদের কাছে পাইকারি দামে ওই গামছা বিক্রি করা যায় ১৭০ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি জোড়া গামছায় গড়ে লাভ হয় মাত্র ৪০/৫০টাকা। একটি তাঁতি পরিবার সারাদিন গামছা বুননের কাজ করলে মজুরি পায় মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম বাড়তি হওয়ায় বর্তমানে এই টাকা দিয়ে তাদের সংসার চালানো খুবই কষ্টকর।

 


এব্যাপারে তাঁতি আব্দুল করিম (৫০) বলেন, গামছার সুতা ও রংঙের দাম বেশি। কিন্তু বেচতে হয় কম দামে। এখন সংসার চালাতে গিয়ে এক বেলা ভ্যানগাড়ি চালাতে হয়। গৃহবধু সামিয়া খাতুন (৪০) কুঁড়ে ঘরের বারান্দায় গামছা বুনছিলেন। আগে স্বামী তাঁত চালিয়ে গামছা বুনত। গামছাতে লাভ কমে যাওয়ায় স্বামী অন্য কাজ করে। তাই স্বামীর সংসারে সহযোগিতার জন্য আমিও গামছা বুননের কাজ করছি। স্থানীয় তাঁতি পরিবারের কয়েকজন সদস্য বলেন, ন্যায্য দাম না পাওয়ার পরও গামছা বুননের কাম ছাড়তে পারছেননা তারা, স্থানীয় তাঁতি জাকির হোসেন (৩৫) জানান, বাপ-দাদার পেশা ছাড়তে পারছিনা। সরকার যদি সুতার দাম কমাত, তাঁতি পরিবারের জন্য ঋন সহায়তা এবং কাপড়ের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নিত, তাহলে এই শিল্পটা টিকে থাকত অনেকদিন। নইলে অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁতশিল্প বন্ধ হয়ে যাবে।