শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১   ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

উপমহাদেশের প্রথম হাদিসচর্চা কেন্দ্র সোনারগাঁয়ে

যুগের চিন্তা অনলাইন

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ১২:০৬ এএম, ১২ অক্টোবর ২০২১ মঙ্গলবার

বাংলার জমিনেই প্রথম স্থাপিত হয় উপমহাদেশের প্রথম হাদিসচর্চা কেন্দ্র সোনারগাঁয়ে। প্রাচীন এই শিক্ষাকেন্দ্রটি গড়ে তুলেছিলেন শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা বুখারি আদ-দেহলভি আল হানাফি (রহ.)। আনুমানিক ১২৭৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঢাকা থেকে ১৬ মাইল দূরে অবস্থিত তৎকালীন রাজধানী সোনারগাঁ আসেন।

 

প্রখ্যাত এই আলেম সেখানে গড়ে তোলেন একটি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেখানে তিনি বোখারি ও মুসলিম শরিফ থেকে শুরু করে বিভিন্ন হাদিসের কিতাবের পাঠ দিতে শুরু করেন। উপমহাদেশের দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে জ্ঞানার্জনের জন্য ছুটে আসত। সম্ভবত এর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের ইতিহাসে বোখারি ও মুসলিম শরীফের পাঠদান সূচিত হয়। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির কর্যক্রম নেই এবং এর অবকাঠামোর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে।



জানা যায়, ইসলাম আজ সারা বিশ্বে বিস্তৃত। পৃথিবীর সর্বত্র পৌঁছে গেছে ইসলামের দাওয়াত। ইসলামের শাশ্বত ও সুন্দর পয়গাম বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তাদের অন্যতম শেখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (রহ.)। শায়খ আবু তাওয়ামার জন্মস্থান নিয়ে দুটি মত পাওয়া যায়। কারো মতে, তিনি পারস্যের বুখারা অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। আর কারো মতে, তাঁর জন্মভূমি ইয়েমেন। হাদিস, ফিকহসহ অন্যান্য ইসলামী জ্ঞানের পাশাপাশি ভূগোল, গণিত, রসায়ন ও যুক্তিবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি দিল্লির সুলতান গিয়াসুদ্দিন বলবনের অনুরোধে ১২৭০ খ্রিস্টাব্দে মোতাবেক ৬৬৮ হিজরিতে ইসলাম ও ইসলামী শিক্ষার প্রচার-প্রসারে দিল্লিতে আগমন করেন। অতঃপর সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহর অনুরোধে বাংলায় আসেন।



গিয়াসুদ্দিন আজম শাহর সহযোগিতায় তিনি রাজধানী সোনাগাঁয়ে একটি বৃহৎ মাদরাসা ও সমৃদ্ধ পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন। উপমহাদেশে এই প্রতিষ্ঠানের সুনাম এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে,দূর-দূরান্ত থেকে হাদিসের জ্ঞান পিপাসু শিক্ষার্থীরা এই হাদিসের ক্লাসে অংশ নিতে শুরু করে। তার শিষ্যত্ব গ্রহণের জন্য সমবেত হয় সুদূর দিল্লি এবং সেরহিন্দ থেকে জ্ঞানার্জনের জন্য ছুটে আসত। এরই ধারাবাহিকতায় তৎকালীন রাজধানী হিসেবে সোনারগাঁয়ে বহু হাদিস বিশারদ সমবেত হতে থাকেন। সেখানে তিনি বোখারি ও মুসলিম শরিফ থেকে শুরু করে বিভিন্ন হাদিসের কিতাবের পাঠ দিতে শুরু করেন। সম্ভবত এর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের ইতিহাসে বোখারি ও মুসলিম শরীফের পাঠদান সূচিত হয়।

 

এক সময় মাদরাসার শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজারে। শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা দীর্ঘ ২৩ বছর এই সোনারগাঁ মাদরাসায় অধ্যাপনা করেন। মাদরাসায় অধ্যাপনাকালে ছাত্রদের উদ্দেশে ফিকহ বিষয়ে তিনি যেসব বক্তৃতা দিয়েছেন,সেগুলোর সংকলনে ফার্সি ভাষায় রচিত ‘নামায়ে হক’ একটি কাব্যগ্রন্থর অস্থিত্ব পাওয়া যায়। এ গ্রন্থে ১৮০টি কবিতা আছে। কেউ কেউ তা ‘মসনবী বনামে হক’ নামে অভিহিত করেছেন। গ্রন্থটি ১৮৮৫ সালে বোম্বাই থেকে এবং ১৯১৩ সালে কানপুর থেকে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া তাঁর ব্রিটিশ জাদুঘরের আর্কাইভ ভবনে শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামার লিখিত পান্ডুলিপির অস্তিত্ব রক্ষিত আছে। তার প্রতিষ্ঠিত এ মাদরাসাই উপমহাদেশের ইতিহাসে হাদিসের আনুষ্ঠানিক পাঠদান শুরু করেছে। বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম পর্যটক ইবনে বতুতা তার লেখা, ‘রেহালায়ে এবনে বতুতায়’ এই ঐতিহাসিক মাদরাাসার কথা উল্লেখ করেন।



সোনারগাঁয়ে প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তিনি উপমহাদেশের ধর্মীয় ইতিহাসে কালজয়ী হয়ে থাকবেন। শায়খ আবু তাওয়ামা (রহ.) ৭০০ হিজরি মোতাবেক ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁয়ে ইন্তেকাল করেন এবং বাংলার মাটিতেই তাঁকে দাফন করা হয়। বর্তমানে মহান এ ধর্ম প্রচারকের মাজারটি সোনারগাঁয়ের দরগাবাড়ী গেলে দেখা যায়। পাশাপাশি ছয়টি মাজারের মধ্যে সবুজ রং করা মাজারটি শায়খের। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে মাজার দেখতে আসেন শিক্ষানুরাগী ও শায়খের ভক্তবৃন্দ। তার কবরের পাশে হযরত ইব্রাহীম দানেশমান্দ (রহ.) সহ অন্যান্য বুযুর্গদের কবর রয়েছে। তবে বর্তমানে সংরক্ষণের অভাবে উপমহাদেশের প্রাচীনতম দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্মৃতিচিহ্নগুলো আজ হারিয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে।



বিশিষ্ট গবেষক ও মাদরাসাতুশ শরফ আল ইসলামিয়া মহতামিম আল্লামা মুফতি ওবায়েদুল কাদের নদভী বলেন, ইসলামী দার্শনিক ও চিন্তাবিদ সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহঃ) হিন্দুন্তান থেকে সোনারগাঁয়ে এসে শায়খের কবর জিয়ারত ও মুনাজাত করেন। এবং মাজার থেকে অল্পদূরে ভাগলপুর এলাকায় শায়খ শরফুদ্দিনের স্মৃতি রক্ষার্থে ‘মাদরাসাতুশ শরফ আল ইসলামিয়া’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করেন, যা বর্তমানে সোনারগাঁয়ে ইসলামী শিক্ষার জ্যোতি ছড়াচ্ছে। এটা শুধু বাংলাদেশের জন্য সমগ্র মুসলিম দুনিয়ার গর্ব ও গৌরবের স্থান। এটার সংরক্ষণে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নেয়ার ধর্মপ্রাণ মানুষের দাবি। ঐতিহ্যবাহী ভাটিবন্দর মিফতাহুল উলুম কওমী মাদরাসার মহতামিম মুফতি মাও: মুহাম্মদ উল্লাহ বলেন,শায়েখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (রহ.) এর প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাটি ছিলো উপমহাদেশে ইলমে হাদিসের সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ বিদ্যাপীঠ।



প্রসঙ্গত, শায়েখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা রহ. এর মাজার অর্থাৎ দরগাবাড়ি আসতে হলে প্রথমে আপনাকে গুলিস্তান থেকে স্বদেশ ও দোয়েল সিটিং বাসে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের সোনারগাঁয়ের মোগরাপাড়া চৌরাস্তা বাসস্ট্যান্ডে আসতে হবে। পরে সোনারগাঁ ডিগ্রী কলেজ রোডে রিক্সা বা অটোরিক্সা দিয়ে মোগরাপাড়া বাজারে এসে যে কাউকে দরগাবাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলেই আপনাকে দেখিয়ে দিবে। দরগাবাড়ি কবরস্থানে সাড়িবদ্ধ বেশ কয়েকটি কবর রয়েছে। এর মধ্যে সবুজ রংয়ের কবরটি শায়েখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা রহ. এর মাজার।