বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১২ ১৪৩১   ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ত্রিশ বছরের আশা রাইফেল ক্লাবে শেষ

ফরিদ আহম্মেদ বাধন

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৭:১১ পিএম, ১৮ নভেম্বর ২০২১ বৃহস্পতিবার

# ভারপ্রাপ্ত থেকে ভারমুক্ত হওয়ার পথে লুৎফর রহমান স্বপন
#এক সভাতেই বাদ মীর সোহেল-ফাইজুর-লিটন-মিছির-শরীফ-বিপ্লব-মজিবর
# অর্ন্তকোন্দলের দোহাই দেয়া হলেও মনেই চোট পেয়েছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা

বলা হয়ে থাকে সিংহ পুরুষ হিসেবে খ্যাত শামীম ওসমানের দাপট ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জে। আরো ভালো করে বললে, ফতুল্লা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতারাই মিটিং-মিছিল, সভা-সমাবেশে মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেন শামীম ওসমানের। কিন্তু গেল ত্রিশ বছরে এই ইউনিয়নেই ছিলনা কোন নির্বাচন। মেঘ কাটিয়ে আকাশ না দেখা যেতেই তাতে হাত দিয়ে বসলেন এমপি শামীম ওসমান। এই ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে স্বপ্ন দেখেছিল শামীম ওসমানের মেইনস্ট্রিমের কর্মীরা।  

 

ত্রিশ বছর কেটে যাওয়ার পর নির্বাচনের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদের ভোটাররা। অনেকে মেম্বার পদে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিতেও শুরু করেছেন। তবে কে হবেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ? এমন প্রশ্ন ছিলো জনগণের মনে। চেয়ারম্যান পদে আওয়ামীলীগের প্রার্থী হতে ইতিমধ্যে সাংসদ শামীম ওসমানের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত  মীর  সোহেল আলী, ফরিদ আহম্মেদ লিটন, আবু মোহাম্মদ শরিফুল হক ও ফাইজুলের নাম শোনা যাচ্ছিল। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান খন্দকার লুৎফর রহমান স্বপনসহ মোট ৮জন নৌকা প্রতীকে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। এ ব্যাপারে গত মঙ্গলবার বিকেলে ফতুল্লা থানা আওয়ামীলীগের জরুরী সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছিল। 

 

গতকাল রাতে রাইফেল ক্লাবে সাংসদ শামীম ওসমান ফতুল্লা থানা নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে আগামী ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে,বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ থেকে খন্দকার লুৎফর রহমান স্বপনকে নৌকার প্রার্থী হিসেবে সমর্থন করেছেন। শামীম ওসমানের এমন সমর্থণের ব্যাপারে প্রত্যক্ষভাবে তেমন কেউ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। দীর্ঘ ৩০টি বছর মীর সোহেল, লিটন, শরীফ, ফাইজুলসহ বেশ কয়েকজন আশায় ছিলেন সেই আশা আর তাদের পূরণ হলো না। এবার নৌকার প্রার্থী হিসেবে খন্দকার লুৎফর রহমান স্বপনের পক্ষে মাঠে কাজ করতে হবে তাদের। মূলত শামীম ওসমান তাঁর ঘর ঠিক রাখতেই তরুণদের পক্ষ থেকে কাউকে সমর্থন দেননি বলেও অনেকে মন্তব্য করেছেন। যদি স্বপন ছাড়া বাকিদের মধ্য থেকে যে কোন একজনকে নৌকা প্রতীকের জন্য সমর্থন দেয়া হতো তাহলে ফতুল্লায় চরম অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দিতো বলেও একটি সূত্র দাবি করেছেন।  অপর সূত্রের দাবী, দীর্ঘ ৩০ বছরে ফতুল্লা থানা আওয়ামীলীগের নতুন নেতৃত্ব যেমনি সৃষ্টি হয়নি, তেমনি ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় নতুন জনপ্রতিনিধি সৃষ্টিতেও এবারের নৌকার সমর্থনে আটকে গেলো নতুন মুখ।  


মামলা জটিলতার কারণে ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন ছিলো না প্রায় ৩০ বছর। এরমধ্যে নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের অনেকে মৃত্যু বরণ করেছেন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না থাকায় কাঙ্খিত উন্নয়ন হচ্ছিলনা বলেও দাবী করে আসছিলেন ফতুল্লা ইউনিয়নবাসী। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। আগামী ২৩ ডিসেম্বর ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘোষণা আসে। ফতুল্লায় সাংসদ শামীম ওসমানের আস্থাভাজন হেভিওয়েট মীর সোহেল আলী, লিটন, ফাইজুল ও শরীফ নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হতে শুরু করেছিলেন প্রচার প্রচারণাও। প্রচারণাও চালিয়েছে ব্যাপক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের আশায় গুড়ে বালি পড়েছে। গতকাল রাতে রাইফেল ক্লাবে সাংসদ শামীম ওসমান আগামী ফতুল্লা ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হিসেবে খন্দকার লুৎফর রহমান স্বপনের নাম ঘোষণা করেছেন। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে তাঁর নাম জেলা কমিটিতে পাঠানো হবে। জেলা কমিটি স্বপনের নাম কেন্দ্রে পাঠাবেন। এরপরেই স্বপন ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে হবেন নৌকার মাঝি।


যে কারণে মীর সোহেল নৌকার মাঝি হতে চেয়েছিলেন :


মীর সোহেল আলী একসময় জাতীয়তাবাদী দলের সমর্থক ছিলেন। এক সময় তিনি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগে সাংসদ শামীম ওসমানের মাধ্যমেই আওয়ামীলীগে  যোগদান করেন। এর মধ্যেই ফতুল্লা থানা যুবলীগের সভাপতির পদ পেয়েছেন তিনি। পরবর্তীতে  জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদও পান। যদিও মীর সোহেল কখনোই ফতুল্লা ছেড়ে শহরের রাজনীতিতে আসতে চাননি। তবুও তাকে দেয়া হয়েছে জেলা কমিটিতে সাংগঠনিক পদ। সাংসদ শামীম ওসমানের বিভিন্ন সভায় যারা ফতুল্লা থেকে মিছিল নিয়ে যোগদান করেন তাদের মধ্যে মীর সোহেল অন্যতম। এবারের ফতুল্লা ইউপি নির্বাচনে মীর সোহেল দলীয় পদসহ সাংসদ শামীম ওসমানের আস্থাভাজন হিসেবে নৌকা প্রতীক আশা করেছিলেন। কিন্তু না,সব কিছু পজেটিভ থাকলেও তিনি এবার দলীয় মনোনয়ন বা শামীম ওসমানের সমর্থন পেলেন না।  


যে কারণে ফরিদ আহম্মেদ লিটন নৌকার মাঝি হতে চেয়েছিলেন :


ফরিদ আহম্মেদ লিটন। ফতুল্লা থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি। বর্তমানে ফতুল্লা থানা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করছেন। তিনিও সাংসদ শামীম ওসমানের আস্থাভাজন হিসেবে সর্ব মহলে পরিচিত। সাংসদ শামীম ওসমানের বিভিন্ন সভা সেমিনারে ফতুল্লা থেকে যে কয়েকটি মিছিল অংশ গ্রহণ করেছিলো লিটনের অবস্থানও কোনো অংশে ছোটো করে দেখা যাবে না। এছাড়াও ফতুল্লায় আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা হিসেবে লিটনের অবস্থানও কোনো অংশে কম নয়। চতুর্থ ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হিসেবে তিনিও শামীম ওসমানের সমর্থন চেয়েছিলেন। তবে গতকাল রাতে তাকেও সমর্থন করেননি সাংসদ।


যে কারণে আবু মোহাম্মদ শরীফুল হক ও ফাইজুল নৌকার মাঝি হতে চেয়েছিলেন:


ফতুল্লা থানা ছাত্রলীগের সফল সভাপতি হিসেবে বহু বছর যাবৎ দলের কাজ করে যাচ্ছেন আবু মোহাম্মদ শরীফুল হক। তিনিও সাংসদের আস্থাভাজনদের একজন। এবারের ফতুল্লা ইউপি নির্বাচনে তিনি আশা করেছিলেন নৌকা প্রতীকে অন্তত শামীম ওসমানের সমর্থণ পাবেন। কিন্তু না,তাকেও শামীম ওসমান সমর্থন করেননি। এছাড়াও ফতুল্লা থানা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন ফাইজুল। সাংসদ শামীম ওসমানের সাথে পারিবারিকভাবে ফাইজুলের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তিনিও শামীম ওসমানের সমর্থণ থেকে বঞ্চিত হলেন।


যে কারণে খন্দকার লুৎফর রহমান স্বপনকে সমর্থন করলেন শামীম ওসমান:


ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কাকে নৌকার পক্ষে সমর্থণ করবেন এ নিয়ে মহা টেনশনে ছিলেন শামীম ওসমান।  শক্তহাতে ধরতে না পারলে ফতুল্লায় বিভাজন দেখা দেবে। এ ভাবনাকে সামনে রেখে ফতুল্লা থানা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকে তিনি দায়িত্ব দিয়েছিলেন নৌকার প্রার্থীদের নিয়ে জরুরী সভা করার। তাঁর কথা মতো গত মঙ্গলবার মোট ৮জন ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক চেয়েছিলেন। সবাই যে যার অবস্থান থেকে বক্তব্যও রেখেছেন। গতকাল রাতে নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবে সাংসদ শামীম ওসমান এক প্রকার বাধ্য হয়েই খন্দকার লুৎফর রহমান স্বপনকে দলীয় প্রতীক নৌকা পেতে সমর্থণ দেন। আর এরই মধ্য দিয়ে ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী  হলেন স্বপন । মূলত, ফতুল্লাতে স্বপনকে ছাড়া  বাকি প্রার্থীদের মধ্য থেকে যে কোন একজনকে প্রার্থী করা হলে দলের মধ্যে তুমুল কোন্দল শুরু হয়ে যেতো। যা ঠেকানো শামীম ওসমানের পক্ষে সম্ভব ছিলোনা।  বিভিন্ন চিন্তা মাথায় রেখেই স্বপনকে সমর্থণ দিয়েছেন শামীম ওসমান। এমনটিই মনে করেন অনেকে।


অন্তর্কোন্দল বৃদ্ধির শঙ্কা : যদিও এমপি শামীম ওসমান নৌকার প্রার্থী ঠিক করে দিয়েছেন। এরপরেও এই ইউনিয়নে অন্তর্কোন্দল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ভবিষ্যতে। নেতাকর্মীরা বলছেন, ইউপি নির্বাচন নিয়ে ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি লুৎফর রহমান স্বপন শুধু নন, ফতুল্লা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি মিছির আলী, ফতুল্লা থানা যুবলীগের সভাপতি মীর সোহেল, থানা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ফাইজুল ইসলাম, ফতুল্লা থানা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক ফরিদ আহম্মেদ লিটন, ফতুল্লা থানা ছাত্রলীগের সভাপতি আবু মোহাম্মদ শরীফুল হক, থানা আওয়ামীলীগের সদস্য মজিবুর রহমান, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জানে আলম বিপ্লবও স্বপ্ন দেখেছিলেন। তারা এমপি শামীম ওসমানের সকল সভা-সমাবেশ, মিটিং-মিছিল বাস্তবায়নে প্রথম সারিতে থাকেন। 

 

এতোদিন আশায় থাকার পরও কোন সুযোগ না পাওয়ায় মনোক্ষুন্ন হয়েছেন অনেকে জানিয়েছে একটি বিশেষ সূত্র। জেলা আওয়ামী লীগের  সাংগঠনিক সম্পাদক মীর সোহেল, ফতুল্লা থানা ছাত্রলীগের সভাপতি আবু মোহাম্মদ শরীফুল হক ফতুল্লা থানা এলাকা, ফতুল্লা থানা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক ফরিদ আহম্মেদ লিটন দাপাসহ এর আশেপাশের এলাকা, স্বেচ্ছাসেবক  লীগ নেতা জানে আলম বিপ্লব ফতুল্লার তল্লা এলাকায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছেন। এছাড়া থানা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ফাইজুর ইসলাম কাঠেরপুল, শিবুমার্কেট, কড়ুইতলা, কুতুবাইল এলাকায় নিজের আধিপত্য বজায় রেখেছেন, দীর্ঘদিন ফতুল্লা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেব মিছির আলীও আওয়ামী লীগকে গুছিয়ে রেখেছিলেন এছাড়া থানা আওয়ামীলীগের সদস্য মজিবুর রহমানও সভা সমাবেশে নিজেকে সবসময় বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তারা সবাই চেয়েছেন কেন্দ্রে অন্তত আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সুপারিশপত্রে নামটি অন্ততপক্ষে যাক। কিন্তু শুরু হওয়ার আগেই শেষ করে দেওয়ায় অনেকে মনে কষ্ট পেয়েছেন বলে জানিয়েছে সূত্র। তারা বলছেন, দীর্ঘদিন রাজনীতিতে থাকার পরও নুন্যতম মূল্যায়ন না পাওয়াটা মনে বড় ধরণের কষ্ট না পাওয়াটাই অস্বাভাবিক।