মঙ্গলবার   ০৭ মে ২০২৪   বৈশাখ ২৪ ১৪৩১   ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫

বাজেটে বৈষম্য বাড়বে কি কমবে

করীম রেজা

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৮:০৬ পিএম, ১১ জুন ২০২২ শনিবার

 

বাজেট ঘোষণা হয়েছে। সমাজের নানা শ্রেনির নানা বয়সের লোকজন তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন নানা ভঙ্গিতে। একজন ফেসবুক  ব্যবহারকারী লিখেছেন,“যানজটের কারণে ইদানিং ঢাকা শহরে চলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। বাজেটে এবার বিমান কেনার শুল্ক কমানো হয়েছে। কিছু টাকা পয়সা দিয়ে বিমান কিনবো ভাবছি”।

 

এই উক্তিতে দেশের বহুমাত্রিক চিত্র উঠে এসেছে। খেদোক্তি বা রসিকতার আড়ালে আছে নিদারুন বাস্তবতা । যখন ১০ টাকার চালের মূল্য বাড়িয়ে ১৫ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়। তখন বাজেটের প্রভাব সরাসরি সমাজের দরিদ্র শ্রেণির উপর বর্তায়। আবার যখন বিমান কেনার শুল্ক কমানো হয়, তার সুবিধাভোগী সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণি। যারা বিলাস-বৈভবে জীবন যাপন করে। সমাজে এখন দুটি শ্রেণি। একটি শ্রেণির যে কোনও পণ্য দ্রব্যে দাম বাড়ালে কিছুই যায় আসে না। ধন সম্পদ তাদের কুক্ষিগত। সবরকম রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিধি বিধানের তারাই একমাত্র সুবিধাভোগী। তাদের সুবিধার জন্যই আইন তৈরি হয়,সংকার হয় বিধি নিয়ম।

 

তেল-পিয়াজের দাম বাড়লে যারা ট্রাকের পিছনে দৌড়ায়,কিংবা স্কুল ফেরত বাচ্চা নিয়ে কম দামে তেল-ডাল কেনার জন্য স্বাস্থ্য ঝুকি নিয়ে রাস্তায় ট্রাকের জন্য অপেক্ষা করেন, তারা সেই দলের নন। ১০ টাকায় যারা ৩০ কেজি চাল পেতেন, তাদের চালের মূল্য ৫ টাকা বাড়ানো হয়। অন্য দিকে বিমান ক্রয়ের শুল্ক কমানো হয়। যুক্তি দেয়া যায় বিমান ত ভুরি ভুরি কেনা হয় না। কথা সত্য, এ সত্য যে ১০ টাকা কেজির চালও তাদের কিনতে হয় প্রত্যেক দিন। বিমানে ত্তঠার স্বপ্ন তারা ভুলেও দেখে না। কিংবা লেটেস্ট মডেলের গাড়িতে চড়ার কথা তারা কখনই ভাবে না। কিন্ত উচ্চবিত্ত শ্রেনীর গ্যারেজে আছে ঐ রকম বিলাস বহুল গাড়ি একাধিক।

 

রাস্তায় যানজটের মূল কারণ ৭৫ ভাগ ব্যক্তিগত গাড়ি। বাজেটের মৌসুম এলে শুরু হয় জল্পনা। বাজেট ঘোষনার পর এক পক্ষের প্রশংসা অন্য পক্ষের প্রত্যাখ্যান তথা বিভিন্ন খুঁত বের করা এই দেশের চিরাচরিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নিয়মের বাইরে কিছু ব্যক্তি সংগঠন বাজেটের ভাল-মন্দ দিক ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। তাদের কথা থেকে বুঝতে পারা সহজ হয় বাজেটের কোন বিষয় বা কতটুকু সাধারণ মানুষের উপকারে আসবে। আর কোনটিতে অপকার হবে। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে একটি জাতীয় দৈনিক।

 

তিনি প্রতিক্রিয়ার এক জায়গায় প্রশ্ন করেছেন করপোরেট কর হার কমানো হলো,কিন্তু ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয় সীমা বৃদ্ধি করা হলো না। করপোরেট করের সুবিধা উচ্চবিত্তের জন্য। নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্তের এতে কোনও সুবিধা পাওয়ার সুযোগ নেই। ব্যক্তিগত আয়ের করমুক্ত সীমা বাড়ানো হলো না কার স্বার্থে? করপোরেট গ্রুপ কিন্ত একই সঙ্গে আরো অন্যান্য সুবিধাও পাবে। যেমন ব্যাংক ঋণ গ্রহন, সুদ মত্তকুফ,লোন পুন তফসিলিকরণ, নগদ বা বিশেষ প্রণোদনা, নানা নামে নানা মোড়কে সুবিধা তাদের জন্যই।

 


দেশ থেকে অর্থ সম্পদ বিদেশে পাচার হয়। পরোক্ষভাবে হলেও সরকার বিষয়টি স্বীকার করে নিল, পাচারকৃত অর্থ বৈধ করার বিধানের মাধ্যমে। যদিও বলা হয়েছে ‘বিদেশি অর্জিত সম্পদ’, শব্দ-ভাষার আড়ালে ‘ অর্থ পাচার’ হয়ে গেল ‘অর্জিত সম্পদ’। প্রভাবশালী গোষ্ঠীর আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা হল এই প্রস্তুাবনার দ্বারা। ৭ শতাংশ কর দিয়ে পাচার করা টাকা দেশে ফেরত আনার কথা বলা হয়েছে। অন্য দিকে এফ বি সি সি আই আশঙ্কা প্রকাশ করেছে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার উদ্দেশ্যের সফলতা নিয়ে। সিপিডি প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট করেই বলেছে যে এই বাজেটে উচ্চ আয়ের মানুষেরাই বেশি উপকৃত হবে। ডিজিটাল সুবিধা নিশ্চিত করে দেশের প্রভূত উন্নতি সাধনের বিভিন্ন পর্যায় ও পরিকল্পনার কথা জানা যায়। আবার ল্যাপটপ আমদানির উপর ১৫ শতাংশ কর ধার্য করা হয়েছে।

 

শিক্ষা ও ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় এই দামবৃদ্ধির প্রভাব হবে সুদূর প্রসারী। দেশি ফ্রিজ, মুঠোফোন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী, রেলের টিকিট ইত্যাদির দাম বৃদ্ধি সরাসরি সাধারন, নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জীবন যাপনে প্রভাব ফেলবে। অন্য দিকে গাড়ির উপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। উচ্চবিত্তের জীবনে এই বৃদ্ধি তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে না। বলা হয় দরিদ্র মানুষের মাঝে ধনীর ঔজ্জ্বল্য বেশ পরিস্কার ভাবে মালুম হয়। দরিদ্র না থাকলে ধনীর জাঁক তেমন ফোটে না। আমাদের সামাজিক বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। দেশে মধ্য ও উচ্চবিত্তের সংখ্যা ৪ কোটির অধিক।

 

সাধারণ মানুষের অগ্রাধিকারের পরিবহন ট্রেনের ভাড়া বাড়বে। কিন্ত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেস্টুরেন্টে খাবার খরচ কমবে। কয়জন সাধারন মানুষ এসি রেস্তঁরায় খাবার খেতে যায়। ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ভাতা আয়কর মুক্ত করা হয়েছে। ভাতা ভোগী শ্রেণি অবশ্যই সাধারন মানুষ নয়, যারা ১০ টাকা কেজি চাল কিনে খায়। কিংবা যারা দুই পাঁচ লাখ টাকা সঞ্চয় পত্রে বিনিয়োগ করে। উচ্চবিত্তের লোকজন কর্তৃক নামে-বেনামে অধিক হারে সঞ্চয় পত্রে বিনিয়োগ ঠেকাতে নানান কাগজ-পত্রের নিয়ম বেঁধে মূলত নিম্নবিত্ত তথা সাধারন মানুষের ভোগান্তি বৃদ্ধি করা হয়েছে। উচ্চবিত্তের বিনিয়োগ কিংবা কালো টাকার সঞ্চয় পত্রে বিনিয়োগ ঠেকাতে কার্যকর কোনও উপায় বের না করে সাধারনের ভোগান্তি বাড়ানো হয়েছে। আয়করের মুক্তসীমাও সাধারন মানুষের কোনও বাড়তি সুবিধা দিতে ব্যর্থ। বৈষম্য সমাজে, জীবনে সরকারি বেসরকারি চাকুরি ক্ষেত্রে। বড় ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর মধ্যে বৈষম্য।

 

করপোরেট প্রতিষ্ঠানের দাপটে, আগ্রাসনে ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প বন্ধ হতে বসেছে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বড় পুঁজি দেশের বাজার নিয়ন্ত্রন করে। তেল,নুন,পিয়াজের দাম বাড়ে মন্ত্রী কর্তৃক কমার ঘোষনা দিলেও। বাজেট ঘোষনার পর পরই এমন অবস্থা জনবান্ধব নয়, ব্যবসা বান্ধব একটি পরিবেশের দৌরাত্ম প্রকাশ করে। বঙ্গবন্ধু বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতেন, সেই পথে আমরা কত দূর, পিছিয়ে পড়ছি কি? এমই/জেসি