শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৫ ১৪৩১   ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

রূপগঞ্জে ঘড়ি মেকারদের পেশা বদল

রূপগঞ্জ প্রতিনিধি

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৭:৫৩ পিএম, ২২ জুন ২০২২ বুধবার

একই দোকানে দীর্ঘ ৫০ বছর একটানা রেডিও আর ঘরির মেকার ছিলেন নগেন্দ্র চন্দ্র বর্মণ। ২০২০ সালে তিনি পরলোক গমন করলে সেই দোকানের হাল ধরেন তারই ছেলে দীপংকর বর্মণ। তবে ঘরি আর রেডিওর মেকারের আয়ে তার আস্থা নেই। তাই পাশাপাশি ফার্মাসিস্ট কোর্স করে ঔষুধ বিক্রি করছেন তিনি। এমন চিত্র নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের প্রাচীন হাট বাজারের ঘরির মেকারদের।

 

সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, এক সময় রেডিও,টিভি আর ঘড়ি মেকারদের কদর ছিলো বেশ। সময় জানতে ঘরি নির্ভরতা ছিলো অতীব প্রয়োজনীয়। আর তাই ঘড়ির মেকারদের প্রয়োজন পড়তো বেশি। সময়ের ব্যবধানে ঘড়ি এখন শুধু ফ্যাশনের জন্য কেউ কেউ ব্যবহার করেন। তবে তা আগের তুলনায় সামান্য সংখ্যক। দুএকজন ব্যবহার করলেও বেটারী ফুড়িয়ে গেলেই ফেলে দেয় ভালো ঘড়ি। 

 

সৌখিন ঘড়িকে মেরামত করে পড়ার ইচ্ছে নেই যেন ব্যবহারকারীদের। কারন হিসেবে জানা যায়, এক সময় শ্রমিক শ্রেণিরাও ঘড়ি ব্যবহার করতো। এখন কেবল তরুণ ও সচ্ছলরাই তা ব্যবহার করেন। ফলে ঘড়ি সামান্য নষ্ট হলেই ফেলে দেন ঘড়ি। এসব শিশুরা ভাঙ্গাড়ীর ভ্রাম্যমাণ হকারদের কাছে বিক্রি করে দেয়।

 

 এভাবে অনেকটা পুরনো পেশা ঘড়ির মেকারদের উপর পড়েছে প্রভাব। তারা ঘড়ির মেকারী করে তাদের সংসার চালাতে না পেরে বাধ্য হয়ে পেশা বদলাচ্ছেন। এতে দরিদ্রদের মাঝে যারা নষ্ট ঘড়ি আগে মেকার দিয়ে মেরামত বা ঠিক করে ব্যবহার করতে পারতেন এখন আর তা পারছেন না। কারন মেকারদের সংখ্যা কমে গেছে।

 

 কথা হয় কাঞ্চন পৌর বাজারের ৫২ বছরের পুরনো একটি ঘড়ি মেকারের দোকানের মালিক দীপংকর বর্মনের সঙ্গে। তিনি জানান, তার স্বর্গীয় পিতা নগেন্দ্র চন্দ্র বর্মণ দীর্ঘ ৫০ বছর এ দোকানে ঘড়ির মেকারী করেছেন। তারা দুই ভাই বোনকে লেখা পড়া করিয়েছেন। তাদের মাঝে বোন আঁখি রানী সরকারী চাকুরী পেয়েছেন আর তিনি ফার্মাসিস্ট কোর্স করেছেন। 

 

ছোটকাল থেকেই বাবার পাশে থেকে ঘরির মেকারী কাজও রপ্ত করেছেন বেশ। শুধুই ঘড়ি নয়। পাশাপাশি রেডিও, টিভি, ক্যালকোলেটরসহ ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র মেরামত দক্ষতাও অর্জন করেছেন। কিন্তু আগের মতো এখন আর মানুষজন ঘড়ি ঠিক করতে আসেননা। আসলেও শুধুমাত্র ব্যাটারী পরিবর্তন করেন। অনেকে বেটারী শেষ হলেই হাজারের অধিক মুল্যের ঘড়ি ফেলে চলে যায়।

 

 এভাবে সারাদিনে ঘড়ির মেকারী আর বেটারী বিক্রি করে ২শ টাকাও আয় হয়না। তবে পিতার পেশাকে সম্মান জানাতে ঘড়ির এ দোকান চালু রেখেছি। আমার মতো কাঞ্চনের আরো ৫ জন ছিলো যারা এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। এখন কেবল দুটি দোকান টিকে আছে। একটি তার অপরটি কাজল চন্দ্রের। 

 

একই চিত্র উপজেলার পুরনো হাট ভুলতা বাজার, তারাবো বাজার,মুড়াপাড়া, আতলাপুর,বেলদী ও ইছাপুরার বাজারের। মুড়াপাড়া বাজারের ঘড়ির মেকার সামসুল ইসলাম বলেন, আমার বাবা ৩০ বছর ঘড়ির মেকারী করেছেন।এখন বয়সভারে তিনি এ কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। তবে আমাদের দুই ভাইকে শিখিয়ে ছিলেন কিন্তু ঘড়ি ঠিক করে ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমে গেছে।

 

 তাই ঘরির দোকানে এখন ব্যাগ,ছাতাসহ ভ্যারাইটিজ দোকান চালাচ্ছি। বেলদী বাজারের ৪০ বছরের পুরনো ঘরির মেকার সুবল দাশ বলেন, আমি ঘড়ি মেকারী করে সংসার চালাতাম। এখন ঘড়ির মেকারী ছেড়ে মুচির কাজ করছি। কিছু করে খেতে হবে তো!

 

সূত্র জানায়, শুধুমাত্র রূপগঞ্জের ১২টি স্থায়ী বাজারে গত ১০ বছর পূর্বেও ৭০ টির অধিক দোকান ছিলো। সময়ের ব্যবধানে সেসব বাজারে ১১টি দোকান টিকে আছে। বাকি সবাই ভিন্ন পেশায় যোগ দিয়েছেন। তাদের মাঝে কেউ পূর্বের দোকানে হরেক পন্য বিক্রি করছেন,কেউ রিক্সা চালাচ্ছেন আবার কেউ মুচির কাজ করছেন। এভাবেই বিলীন হচ্ছে ক্ষূদ্র প্রকৌশল বিদ্যায় রপ্ত গ্রামীণ মেকাররা। মেকারদের দাবী আর্থিক স্বচ্চলতা বেড়ে যাওয়ার কারনে ও এমনটা হয়েছে। ফলে কেউ নষ্ট ঘড়ি ঠিক করে ব্যবহার করেন না। নতুন কিনে নেয়।

 

এসব বিষয়ে রূপগঞ্জ সাহিত্য পরিষদের সভাপতি প্রবীণ কবি ও সাংবাদিক আলম হোসেন বলেন, আগে একটা প্রচলন ছিলো নতুন জামাইকে ঘড়ি উপহার দেয়ায়। ঘরি ব্যবহার হতো হাতে হাতে। এখন দুচারজন হয়তো ফ্যাশনের জন্য ব্যবহার করে থাকেন। তবে এটা স্বাভাবিক ঘটনা। মোবাইলের আধুনিক যুগের সাথে পেশা বদল করেই সংসারের হাল ধরতে হবে। তবে এ শ্রেণির পেশাদারদের ঘুরে দাড়ানোর জন্য সরকারী দৃষ্টিপাত জরুরী। একই দোকানে দীর্ঘ ৫০ বছর একটানা রেডিও আর ঘরির মেকার ছিলেন নগেন্দ্র চন্দ্র বর্মণ। এসএম/জেসি