শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১   ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

সন্ত্রাসের জনপদ চনপাড়ায় অঘোষিত ‘রাজা’ বজলু

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৪:১১ পিএম, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২ বৃহস্পতিবার


# সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি অনেকটা ওপেন সিক্রেট
 

নাম বজলুর রহমান। ডাকনাম বজলু। যাকে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জের চনপাড়া এলাকার সবাই এক নামে চিনে। তবে ভালো কাজের জন্য নয়, তিনি পরিচিতি পেয়েছেন কুখ্যাতি হিসাবে। মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ এলাকার সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি অনেকটা ওপেন সিক্রেট।

 



আছে অস্ত্রধারী বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী। প্রয়োজনে যাকে-তাকে অপহরণ করে আনা হয় বজলুর ডেরায়। টর্চার সেলে রেখে করা হয় অমানুষিক নির্যাতন। ইয়াবা দিয়েও পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি একজন কলেজ শিক্ষার্থীও তার রোষানলে পড়ে পরীক্ষা দিতে পারেননি। অপরদিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনেও তিনি অনেক ধাপ এগিয়ে রয়েছেন। প্রকাশ্যে মারধর ছাড়াও কয়েকদিন থেকে তার বাহিনীর সদস্যরা বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়িতে দফায় দফায় হামলা অব্যাহত রেখেছে।

 



দল-মত নির্বিশেষে বজলু বাহিনীর ভয়ে অনেকে এখন বাড়ি ছাড়া। এভাবে পুরো চনপাড়া এলাকা সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত হয়েছে। কেউ ভয়ে মুখ খুলতে চান না। ভুক্তভোগীদের অনেকে জানিয়েছেন, বজলুই এখন এই এলাকার অঘোষিত রাজা; তার নির্দেশেই চলে সবকিছু।

 

 



এলাকাবাসীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সরেজমিন সোম ও মঙ্গলবার চনপাড়া এলাকায় গিয়ে ভুক্তভোগীদের বেশির ভাগ অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। রাজধানীর নিকটবর্তী চনপাড়া এলাকাটি প্রদীপের নিচে অন্ধকারে পরিণত হয়েছে। অস্ত্র ও খুনের মামলায় এক সময়ের জেলখাটা বজলু এখন সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তির খাতায় নাম লিখিয়েছেন।

 

 

 

অভিযোগ আছে, অবৈধ টাকার জোরে তিনি স্থানীয় কায়েতপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদটিও হাতিয়ে নিয়েছেন, হয়েছেন ইউপি সদস্য। এসব পদ ও প্রতিপত্তির জোরে তিনি তার চেয়ে অনেক বড় প্রভাবশালী এক নেতার হয়ে রীতিমতো ভাড়া খাটছেন। সবাই তার গডফাদারের নাম-পরিচয়ও জানে। কিন্তু জানমালের নিরাপত্তাহীনতার কারণে মুখ খুলতে চান না। এমন এক পরিস্থিতিতে চনপাড়ার সবাই যেন অসহায়।

 



এ বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের এসপি গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, ‘আমি এখানে নতুন। কয়েকদিন আগে এসপি হিসাবে যোগদান করেছি। এরই মধ্যে শুনেছি রূপগঞ্জের একজন ইউপি সদস্য বহু অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। ওই এলাকায় আমি ইন্টেলিজেন্স নিয়োগ করেছি। ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টে অভিযোগের সত্যতা পেলে তাকে আইনের আওতায় আনতে কালক্ষেপণ করব না।’

 

 

 

তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশের কোনো সদস্য যদি ওই ইউপি সদস্যের অপকর্মের সহযোগীর ভূমিকা পালন করে, তবে তাকেও ছাড় দেওয়া হবে না।’
 

 

 

মাদক সাম্রাজ্য : চনপাড়া বস্তিতে মাদকের স্পট রয়েছে একশর বেশি। মাদক ব্যবসা চলে কয়েকটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। প্রতিটি সিন্ডিকেটের একটি বা দুটি করে ওয়াচ পার্টি থাকে। এদের কাজ হচ্ছে পোশাকে বা সাদা পোশাকের পুলিশ-র‌্যাব দেখলেই সতর্ক করা। ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন, মদ, গাঁজা বিক্রির জন্য পৃথক সিন্ডিকেট রয়েছে।

 

 

 

কেউ কারও ব্যবসায় নাক গলাবে না-এটাই এখানকার অলিখিত নিয়ম। ব্যতিক্রম ঘটলেই চলছে হামলা-নির্যাতন। সংঘর্ষ এবং খুনোখুনির ঘটনাও ঘটছে মাঝে মধ্যে। মাদক সিন্ডিকেটে বেশ কয়েকজন নারী সদস্যও আছে। রুমার কাছ থেকে কেনা ইয়াবা বিক্রি হয় ৪০টি আস্তানায়। এছাড়া জুয়ার স্পর্ট রয়েছে ২৫টির বেশি। অত্যাধুনিক অস্ত্র বেচাকেনা এবং ভাড়া দেওয়া হয় চনপাড়া বস্তি থেকে।

 



সরেজমিন চনপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় নব কিশলয় গার্লস হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ৪ নম্বর ওয়ার্ডে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসংলগ্ন এলাকা এবং বহর এলাকাসহ কয়েকটি স্থানে দিনদুপুরেই চলছে মাদক বিক্রি। স্থানীয় রায়হানের বাড়ির ভেতরেও চলছিল ইয়াবা সেবন। স্থানীয়ভাবে ওই বাড়িটি ইয়াবা সেবন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।

 

 



হামলা-নির্যাতন-টর্চারশেল : স্থানীয় ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি হারুন অর রশীদ মিয়াজি জানান, চনপাড়ার গাজী বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেতুবন্ধন এলাকায় বজলুর রহমানের দুটি টর্চার সেল আছে। তার দেহরক্ষীরা জোর করে মানুষকে তুলে নিয়ে টর্চার সেলে নির্যাতনের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করে।

 

 

 

সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের প্রায় ২০ জন নেতাকর্মীকে তুলে নিয়ে অর্থ আদায় করা হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রতন, দ্বীন ইসলাম, আক্তার, কবির, আলমগীর (১), আলমগীর (২), ইউসুফ হাওলাদার, মো. রফিক, মোহাম্মদ আলী, ইদ্রিস, মাসুমসহ প্রমুখ।

 

 


তিনি বলেন, ‘কেউ চাঁদা না দিলে বাড়িঘরে হামলা চালায় বজলুরের ক্যাডাররা। কয়েকদিন আগে আমার বাড়িতেও হামলা করেছে। ইদ্রিসের কাছ থেকে অনেকবার টাকা নিয়েছে বজলুর। পুলিশের ভয় দেখিয়ে সপ্তাহখানেক আগে সাড়ে তিন লাখ টাকা চাঁদা নিয়েছে। ১০-১২ দিন আগে টর্চারশেলে নিয়ে রফিককে হাতুড়িপেটা করেছে। তার শরীরে ৭৮টি হাতুড়িপেটার দাগ রয়েছে।

 

 

 

সাংবাদিকরা বিষয়টি জেনে ফেলার পর টাকা না নিয়েই রফিককে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর পর থেকে রফিক এলাকাছাড়া।’ হারুন অর রশীদ মিয়াজি আরও বলেন, কেউ বজলুর কথা না শুনলে তাকে ইয়াবা দিয়ে চালান দেওয়া হয়। কয়েকদিন আগে শাকিল হোসেন নামের শিক্ষার্থীকে ১৩০০ পিস ইয়াবা ও ২০ গ্রাম হেরোইন দিয়ে পুলিশে দিয়েছে। অথচ ছয় মাস পর ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল পরীক্ষা। কিন্তু বজলুর রোষানলে পড়ে তিনি সেমিস্টার পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি।

 

 


সন্ত্রাসী বাহিনীর দৌরাত্ম্য : তিন বছর আগেও চনপাড়ার ‘নিয়ন্ত্রক’ ছিলেন দুজন। একজন কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী সদস্য বিউটি আক্তার ওরফে কুট্টি এবং অন্যজন ইউপি সদস্য বজলুর রহমান। আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে বিউটির স্বামী এমএ হাসান এবং ২০১৯ সালের জুন মাসে বিউটি খুন হলে বদলে যায় পরিস্থিতি। চনপাড়ার একক ‘নিয়ন্ত্রণ’ চলে আসে বজলুর কাছে।

 

 

 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যারাই চনপাড়ার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করেছে তারাই হত্যার শিকার হয়েছে। কুট্টি এবং হাসান ছাড়াও আলোচিত হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে চানমিয়া, ফিরোজ সরকার, ফারুক মিয়া, পুলিশের এএসআই হানিফ মিয়া, ফালান মিয়া, আব্দুর রহমান, খোরশেদ মিয়া, মনির হোসেন, আসলাম হোসেন, আনোয়ার, সজল এবং সামসু হত্যা।

 

 



স্থানীয় সূত্র জানায়, বজলু সব সময় চলাফেরা করেন তিনজন সশস্ত্র দেহরক্ষী নিয়ে। তার ২০-২৫ জনের বাহিনী আছে। বাহিনী সদস্যদের মধ্যে আছে জয়নাল আবেদীন, শাহীন মিয়া ওরফে সিটি শাহীন, রাজু আহমেদ রাজা, রায়হান, ইউসুফ, সাদ্দাম হোসেন ওরফে স্বপন, সায়েম, নাজমা, রিপন, শাওন, রেহান মিয়া, জাকির হোসেন, আনোয়ার হোসেন, শাহীন, হাসান, মিজু, রাজা, রুমাসহ প্রমুখ।

 

 



আরও যত অপকর্ম : স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন সাবেক নেতা যুগান্তরকে বলেন, ‘একটি রাজনৈতিক দলের একজন প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় বজলু বেপরোয়া। মানসম্মান রক্ষায় আমার মতো কেউ কেউ অন্য দলে যোগ দিয়েছে।’

 

 

গণমাধ্যম এর সাথে কথা বলার সময় তার স্ত্রী বলেন, ‘বজলুর খুব খারাপ লোক। পুরো চনপাড়া চলে তার ইশারায়। বজলু ও তার লোকের বিষয়ে কিছু বললে এলাকায় থাকতে পারব না। এমনকি আমাদের দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে পারে। এরপর ভয়ে তিনি তার স্বামীকে নিয়ে চলে যান।’

 



স্থানীয়রা জানায়, চনপাড়ার অস্ত্র ব্যবসা, প্লট বাণিজ্য, নৌকার ঘাট, বাজার, পরিবহণ, জুয়া এবং সালিশি বৈঠকসহ চনপাড়ার সবকিছুর নিয়ন্ত্রণই যেন বজলুর হাতে। ২০০৩ সালে রূপগঞ্জের সাবেক এমপি মেজর জেনারেল (অব.) কেএম শফিউল্লাহর বিরুদ্ধে অনাস্থা এনে ঝাড়ু-জুতা মিছিল করে আলোচনায় আসে বজলু। ২০০৬ সালে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় গ্রেফতার হন তিনি। ওই সময় তার বিরুদ্ধে ১১টি মামলা ছিল।

 

 



স্থানীয় বাচ্চু মিয়া অভিযোগ করেন, বছরদুয়েক আগে আমার ১৯ বছর বয়সি মেয়ে বৃষ্টিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। মাদক ব্যবসায়ী ইউসুফের নির্দেশে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ঘটনার পরপরই সিদ্দিককে হাতেনাতে ধরে বজলুর রহমানের কাছে দিই। কিন্তু বজলুর তাকে ছেড়ে দেন। পুলিশ তদন্ত করে আবু বক্কর সিদ্দিক এবং নাছিমাকে আসামি করে চার্জশিট দিয়েছে। কিন্তু আসামিরা বজলু মেম্বারের লোক হওয়ায় তাদের ভয়ে কেউ আদালতে সাক্ষ্য দিতে যাচ্ছে না।

 

 



স্থানীয় আনোয়ার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জয়নাল এবং সিটি শাহীন গ্রুপের দ্বন্দ্বের বলি হয়ে মাস তিনেক আগে আমার ১৭ বছর বয়সি ভাগনে সজল প্রাণ হারান। মাথায় ইট দিয়ে থেঁতলে নির্মমভাবে আমার ভাগনেকে হত্যা করা হয়। আমার ভাগনে মারা যাওয়ার আগের দিনও ৯ নম্বর রোডের আরিফকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়। ভাগ্যগুণে সে বেঁচে যায়।’

 



বজলুর বক্তব্য : সোমবার বিকালে বজলুর রহমানের কার্যালয়ে গেলে দেখা যায় তার পাশেই বসে আছেন চনপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মেহেদী হাসান খান। কার্যালয়ের ভেতর ৩০-৪০ জন মানুষ। এ সময় বজলুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি কোনো অপকর্মের সঙ্গে জড়িত না। আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাকে এখানে পুনর্বাসন করা হয়েছিল। সেই সূত্রে আমি এখানকার বাসিন্দা।

 

 

 

মাদক সিন্ডিকেটের সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘২০০৭ সালে অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলাম। চাঁন মিয়া হত্যা মামলায় আরেকবার গ্রেফতার হয়েছি। তবে আমার বিরুদ্ধে যে কটি মামলা হয়েছিল সবকটিতেই আমি খালাস পেয়েছি। এই মুহূর্তে আমার কোনো পেন্ডিং মামলা নেই।’

 

 


ফাঁড়ি ইনচার্জের বক্তব্য : বজলুর রহমানের পাশে বসে থাকা অবস্থায় চনপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মেহেদী হাসান খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আপনি এখানে এলেন কীভাবে? আমরাও তো ভয় পাই। অভিযান চালাতে গেলে এলাকার মাদক ব্যবসায়ীরা আমাদের ওপরও হামলা চালায়। পরে এলাকায় এলে আমাকে জানিয়ে আসবেন। কারণ এখানে সাংবাদিকদেরও নিরাপত্তা নেই।’  এন.এইচ/জেসি