শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৫ ১৪৩০   ১৯ রমজান ১৪৪৫

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ’ই স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা : বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজল

এন. হুসেইন রনী

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৮:৫০ পিএম, ২১ ডিসেম্বর ২০২২ বুধবার

 

‘১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে আমার উপস্থিত হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সেই জ্বালাময়ী ভাষণটি আমার হৃদয় পটে আজও ভেসে উঠে। আমরা সেইদিন বুঝতে পেরেছিলাম স্বাধীনতা যুদ্ধ আসন্ন। সে সময় আমি তোলারাম কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি। আমাদের ছাত্র নেতৃবৃন্দের কাছ থেকেও এমনই আভাস পাচ্ছিলাম। আমার খুব মনে পড়ে ছাত্রনেতা সিরাজুল ইসলাম সিরাজ (পরবর্তীতে যুদ্ধকালীন কমান্ডার) ভাইয়ের কথা; আমি তাকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি’- যুগের চিন্তা’র আয়োজনে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব আফজল মিয়া এভাবেই স্মৃতিচারণ করেন, তুলে ধরেন তার জীবনের ঘটনা।

 

পরিচিতি:
‘আফজল মিয়া’র জন্ম  ১৯৫৩ সালে নারায়ণগঞ্জ ফতুল্লা থানার আওতাধীন ৯নং ওয়ার্ডের তল্লা গ্রামে। তার পিতা: মরহুম আযুব আলী মিয়া, এবং রত্নাগর্ভা মাতা : মরহুমা আকছি বিবি। ২৭ মার্চ সকালে মাসদাইর এলাকায় ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

 

ভারতে প্রশিক্ষণ:
০৬ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে আমার গ্রামের প্রতিবেশী চার বন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর, বীর মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ারকে নিয়ে নবীগঞ্জ হয়ে প্রথমে মোগড়াপাড়া যাই। সেখান থেকে বাসযোগে রওয়ানা হই ইলিয়টগঞ্জের উদ্দেশ্য। কিন্তু ইলিয়টগঞ্জে পৌছার প্রায় আধা মাইল আগে আমরা জানতে পারি, পাকিস্তানি আর্মিরা, ইলিয়টগঞ্জ ব্রীজ উড়িয়ে দিয়েছে। তাই আমরা সেখানে বাস থেকে নেমে অন্যান্য যাত্রীদের সাথে চক দিয়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করি। শুরু হয় জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর পথচলা, অনিশ্চয়তার পথে যাত্রা। অনেকদূর হাঁটার পর এক গ্রামে পৌছালে রাত হয়ে যায়। আমরা যাত্রা বিরতি করি; রাতে একটি বাড়ীতে মাতৃস্নেহে আশ্রয় দেন একজন মা। পরম যত্নে মায়ের স্নেহে রাতে আমাদের খাবারেরও ব্যবস্থা করেন; তার প্রতিও আমি কৃতজ্ঞ। যাইহোক পরেরদিন খুব ভোরে গ্রামের একজন ব্যাক্তির নিকট কুমিল্লার দিকে রাস্তার বিষয়ে জানতে চাইলে সে আমাদেরকে একটি খাল পার করে দিয়ে, পথ দেখিয়ে দেয়। তার দেখানো পথে আমরা হাঁটতে হাঁটতে কুমিল্লার বুড়িচং বাজারে গিয়ে পৌছাই। সেখানে ঐ এলাকার একজন চেয়ারম্যান সাহেব ছিলেন অত্যন্ত আন্তরিক। তিনি আমাদের নাম-ঠিকানা লিখে একটি পত্র ধরিয়ে দেন। তিনি বলেন, ভারত সীমান্তে ভারতের আর্মিদের এই কাগজ দেখালে তারা আমাদের ট্রেনিংয়ের জন্য সহযোগীতা করবে। চেয়ারম্যান সাহেব, আমাদের সাথে একজন গাইড দেন; যে আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। সেই লোকের সাথে আরো অনেক বাঙালি রাতের আধাঁরে বুড়িচং বাজারের পরে, একটি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করি। আমরা দ্বিধাদ্বন্দে ছিলাম চেয়ারম্যান সাহেবের লোক আবার আমাদের পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেয় কিনা। কোন পথ দিয়ে গিয়েছি, তা বলতে পারবো না। বিভিন্ন জায়গা থেকে শুধু গুলি আর বিস্ফোরণের আওয়াজ পাচ্ছিলাম। আমাদের গাইড থামতে বললে থামি, লুকাতে বললে ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে পড়ি। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, সে এক কঠিন অভিজ্ঞতা। কিন্তু সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আমরা ভোর শেষ; সম্ভবত সকাল সাতটার দিকে ইন্ডিয়ান বর্ডারের কাছে মতিনগর গিয়ে পৌছাই। সেখানে ইন্ডিয়ান আর্মি আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে, আমরা সেই চেয়্যারম্যান সাহেবের প্রদানকৃত কাগজটি দেখাই। ইন্ডিয়ান আর্মি, চেয়্যারম্যান সাহেবের কাগজটি দেখে আমাদেরকে সেদিনের মতো আশ্রয় দেয়। এবং আমরা যুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য এসেছি জানালে; তারা বলে আপনারা এখানে আশ্রয় নেন, থাকেন, পরে দেখা যাবে। সেখানে আমরা অনেক বাঙালিকে দেখতে পাই; তারাও প্রশিক্ষণের জন্য এসেছে। ২-১ দিন যাওয়ার পরই আমাদের প্রায় ২৫-৩০ জন বাঙালিকে মতিনগর ক্যাম্প থেকে পাহাড়ের মধ্য দিয়ে একটি স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে আমাদের জংগল পরিষ্কার করার কাজ দেওয়া হয়। এদিকে আমরা তো প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য ভেতরে ভেতরে বেশ উতলা ছিলাম। যাইহোক জংগল পরিষ্কার যখন শেষ পর্যায়ে তখন একদিন আমাদের জানানো হয়, আগামীকাল সকাল থেকে তোমাদের প্রশিক্ষণ শুরু হবে। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হতে চাইছিল না। পরেরদিন খুব সকালে আমরা ৩০ জনের দল তৈরি হয়ে যাই। সকালে সেই পাহড়ি এলাকায় কয়েকজন বাঙালি সেনা অফিসার এবং ভারতীয় সেনা অফিসার আসেন; শুরু হলো আমাদের প্রশিক্ষণ। আমাদের প্রশিক্ষণ ছিল সকালে হালকা ব্যায়াম এবং গ্রেনেড নিক্ষেপ করার ট্রেনিং নেয়া। আমাদের প্রশিক্ষকরা আমাদেরকে একটা মন্ত্রই শিখিয়ে দিলেন যে, তোমাদের কাজ হলো: নিজ নিজ এলাকায় যেয়ে সরকারি অফিস-আদালত, সম্ভব হলে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পের কাছাকাছি গ্রেনেড ছুড়ে আতংক সৃষ্টি করা। তোমাদের কাজই হলো হিট এন্ড রান। সে অনুযায়ী প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে ৩০ এপ্রিল আমাদের সবাইকে ২টি করে গ্রেনেড দেওয়া হয়। আমরা তাই নিয়ে, ভারতীয় আর্মিদের সহযোগীতায় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে, রামচন্দ্রপুর থেকে লঞ্চে উঠি সোনারগাঁ’র বৈদ্দারবাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। এখনো মনে পড়ে, বাঙি’র উপরের দিকে মুখ কেটে; সেই গ্রেনেড বাঙি’র ভিতরে নিয়ে আমরা কৌশলে ছদ্মবেশ ধারণ করে এসেছিলাম।  

 

হিট এন্ড রান:
আমরা নারায়ণগঞ্জে এসেই প্রথম গ্রেনেড চার্জ করি কিল্লারপুলের ওয়াপদা অফিসে। সেদিন সকাল ১০টা হবে আনুমানিক, গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দে, ওয়াপদার সব অফিসাররা ভয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছিল। আর আমি এবং আমার সহযোদ্ধারা কিল্লার ভেতর দিয়ে লুকিয়ে চলে আসি। আরেকদিনের ঘটনা, চাষাঢ়া রাইফেল ক্লাবে সন্ধ্যার কিছুটা পরে, সেখানে পাকিস্তানিরা পার্টি করছিল। আমি এবং আমার বাল্য বন্ধু মরহুম জিন্নাত আলী মুন্সির ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা হোসেন একত্রে রাইফেল ক্লাবে গ্রেনেড ছুড়ি এবং দ্রুত স্থান ত্যাগ করি। পরবর্তীতে কমান্ডার কমল ও ডেপুটি কমান্ডার এড. নুরুল হুদা সাহেবের অধীনে ছিলাম, তাদের নির্দেশ মোতাবেক আমরা কাজ করতাম। মরহুম গিয়াস উদ্দিন কমান্ডার বীর প্রতীক এর সাথেও যুদ্ধকালীন সময়ে কিছু কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তিনি আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। আমি বীর প্রতীক গিয়াস উদ্দিন সাহেবকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।

 

কৃতজ্ঞতা:
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে আমি ও আমরা সকল মুক্তিযোদ্ধরা কৃতজ্ঞ। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্বে আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করি এবং সফলভাবে দেশ শক্রমুক্ত করি। আজ আমরা স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের নাগরিক, তাই একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি গর্বিত।

 

পরিশেষে বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজল মিয়া বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতা করছেন, আমরা মুক্তিযোদ্ধারা তার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ। পাশাপাশি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যার ডাকে আজ এই দেশ স্বাধীন হয়েছে।”

 

তিনি নতুন প্রজন্মকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আমরা তোমাদেরকে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র দিয়েছি; এই অর্জন ধরে রাখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হৃদয়ে লালন করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধে উজ্জীবীত হয়ে দেশ ও সমাজ গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে”, তোমাদের কাছে এই আমার প্রত্যাশা; একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার আর কোন চাওয়া পাওয়া নেই। তিনি দেশকে মায়ের সাথে তুলনা করে বলেন, ‘স্বার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে; স্বার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে।’

এস.এ/জেসি