মঙ্গলবার   ৩০ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১৭ ১৪৩১   ২১ শাওয়াল ১৪৪৫

সোনারগাঁয়ে চৈতি কম্পোজিটের বর্জ্য দূষণ দখল ভরাটের কবলে মারীখালি

আশরাফুল আলম

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৬:৪৫ পিএম, ১২ জানুয়ারি ২০২৩ বৃহস্পতিবার

 

সোনারগাঁ উপজেলার টিপরদী এলাকায় অবস্থিত চৈতি কম্পোজিট নামের একটি তৈরি পোষাক কারখানার দূষিত বর্জে মারীখালি নদী ও আশেপাশের কয়েকটি খালের পানি দূষিত হয়ে পড়েছে।

 

 

যার ফলে উপজেলার মোগরাপাড়া ইউনিয়ন ও সোনারগাঁ পৌর এলাকার ২০ টি গ্রামের প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনে এই দূষিত পানি ব্যবহার করার ফলে বিভিন্ন রোগবালাইতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।

 

 

বিগত সময় পরিবেশ রক্ষায় তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা গ্রহনের লক্ষে টিপরদী এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকা ও পরিবেশ অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ বরাবরসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত ভাবে স্বারক লিপি প্রদান করেন।

 

 

এছাড়া পরিবেশ দূষণ রোধে সম্প্রতি পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়ন সোসাইটির সোনারগাঁ শাখা কর্তৃক জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ, মানব বন্ধন কর্মসূচী ও সংবাদ সম্মেলন করেছেন।

 

 

পরিবেশ রক্ষায় স্থানীয় বাসিন্দাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে সে সময় পরিবেশ অধিদপ্তর, সদর দপ্তর ঢাকা কর্তৃপক্ষ সরেজমিন তদন্ত করে পরিবেশ দূষনের দায়ে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষন আইন, ১৯৯৫(সংশোধিত-২০১০) মোতাবেক ২০২১ সালে চৈতি কম্পোজিট লিমিটেডকে ৫২ লাখ ৪৮ হাজার টাকা জরিমান আদায় করার নির্দেশ দেন।

 

 

সচেতন নাগরিক সমাজের অভিমত, অপরিকল্পিত নগরায়ণ অব্যাহত দখল, দূষণ ও ভরাটের কবলে পড়ে নাব্যতা সঙ্কটে মৃত প্রায় সোনারগাঁ উপজেলায় প্রবাহিত এক সময়কার খরস্রোতা নদী মারীখালি।

 

 

পাশাপাশি উপজেলার আরো কয়েকটি নদী ও খালের অবস্থাও খুবই সঙ্কটাপন্ন। দেশে নদী রক্ষায় উচ্চ আদালতের নির্দেশ, টাস্কফোর্সের হুশিয়ারী এবং দখল, দূষণকারীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত উচ্ছেদ অভিযানও তেমন কাজে আসছেনা।

 

 

স্থানীয় প্রশাসন এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দখল, ভরাট ও শিল্পবর্জ দূষণ প্রতিরোধে মাঝে মধ্যে লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা করলেও স্থায়ী কোন আইনি ব্যবস্থা গ্রহনে তাদের তেমন কোন তৎপরতা নেই বললেই চলে।

 

 

দখল, দুষণ ও ভরাটের কবল থেকে নদী রক্ষায় দেশে প্রচলিত আইন থাকা সত্ত্বেও মারীখালি নদীতে দখল, ভরাট ও শিল্পবর্জ দুষণ কোন ভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না।

 

 

নদী মাতৃক বাংলাদেশে নদীর সঙ্গে এদেশের মানুষের মিতালী সু-প্রাচীন। এখানে ওখানে কান পাতলেই শুনা যেত নদীর কলতান। আমাদের পূর্ব পুরুষদের সঙ্গে নদীর যে নীবিড় সম্পর্ক ছিল তা আমাদের মাঝে আজ লুপ্ত প্রায়।

 

 

এদেশের মানুষের জীবন জীবিকার সঙ্গে নদী যেন মিশে আছে অনেকটা নিয়তির মতোই। নদ-নদী মানুষের জন্য কখনো আর্শীবাদ আবার কখনো কখনো অভিশাপও বটে।

 

 

নদী মানুষকে স্বপ্ন দেখায় আবার নিঃস্বও করে দেয়। এক সময় মানুষের দৈনন্দিন জীবনে, ব্যবসা-বানিজ্যে, দুর-দুরান্তে যাতায়ত ব্যবস্থায় নদী পথে নৌযানেই ছিল একমাত্র ভরসা।

 

 

বর্তমান সময়ে মানুষের আধুনিক জীবন মানে অব্যাহত দখল, দুষণের কবলে ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারনে ক্রমেই মুছে যাচ্ছে বাংলাদেশের নদী মাতৃক পরিচয়। এছাড়া কোন ভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না দখল আর দুষণ। যার ফলে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে নদী গুলি ।

 

 


সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে বর্তমানে নদীর সংখ্যা প্রায় ২৩০টি। এর মধ্যে গত কয়েক বছরে হারিয়ে গেছে ২৫ টি নদী। দখল, দুষণ ও ভরাটের কবলে পড়ে বিপদ সংকুল অবস্থায় রয়েছে ১৭৪টি নদী। এসব নদীর মধ্যে ১১৭টি নদী ধাবিত হচ্ছে অবধারিত মৃত্যুর দিকে। ছোট বড় দখলদারির ঘটনা ও দুষণ ঘটেছে প্রায় সব নদীতেই। সেইজন্য দ্রুত হারে বিনষ্ট হচ্ছে নদীগুলো।

 

 

কৃষি নির্ভর এ দেশের জীব-বৈচিত্র প্রকৃতির প্রতিটি ধারার সঙ্গেই নদীর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতে নদীগুলো একের পর এক শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকান্ড নদীগুলোকে গলাটিপে মেরে ফেলছে।

 

 

এছাড়া পলির চাপ এবং বিকল্প বাঁধও নদীগুলোর পানি প্রবাহে বাধার সৃষ্টি করছে। নদী মৃত্যুর ঘটনায় বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবন যাত্রার মান পাশাপাশি দেখা দিচ্ছে ভয়াবহ পরিবেশ ও জীব বৈচিত্রের বিপর্যয়।

 

 

দেশের প্রধান নদী গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি মারীখালি। নদীটির বিভিন্ন জায়গাতে পলি জমে স্রোত ধারা ক্ষীণ হয়ে পড়েছে এবং শুস্ক মৌসুমে নদীর বুকে চলছে ইরি বোরো ধান চাষ। দিনরাত অভিরাম অব্যাহত ভরাট উৎসবের কারনে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এসব নদীর পানির উৎস মুখের শাখা উপশাখা।

 

 

ফলে নদীর তীরবর্তী কৃষক ও জেলে পরিবার গুলোর জীবন ধারা বিপন্নের মুখোমুখি অবস্থায় দাড়িয়েছে। নদী মৃত্যুর পেছনে সরকারি ভূমিকাও কম নয়। বিগত কয়েক বছরে নদী বিপর্যয়ের পেছনে সরকারি কর্মকান্ড ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রভাবে থাকা শিল্পকারখানা মালিক জড়িত।

 

 

নদী থেকে অবৈধ্য বালু উত্তোলনকারী ও ব্যবসায়ীদের উৎখাত করতে গিয়েও করা যাচ্ছে না সরকারের উদাসীনতার কারণে। এ ব্যাপারে সরকারের এক পক্ষ উচ্ছেদ অভিযান চালালে অন্য কোন সংশ্লিষ্ট বিভাগ তার বাধার সৃষ্টি করছে। একই ভাবে প্রচলিত আইন থাকা সত্ত্বেও নদীতে শিল্পবর্জ দুষণ ঠেকানো যাচ্ছে না।

 

 

একারণে দিনের পর দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছ, কাকড়া, কচ্ছপসহ নানান প্রাণী। নদী দখল, দূষণের ব্যাপারে পানি সম্পদ, বন পরিবেশ এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাফল্য প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম বলে নাগরিক সমাজ ও সুশিল সমাজের সচেতন মহল মনে করেন।

 

 


সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ সাবরিনা হক জানান, নদী ও খালে ফেলা কারখানা বর্জের কারনে পানি দূষিত হলে এই পানি ব্যবহার করার ফলে মানুষের ক্যানসার, কলেরা, আমাশয় ও বিভিন্ন চর্ম রোগ হতে পারে। তাই এবিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

 

 


শিল্পবর্জ দূষণের বিষয়ে চৈতি কম্পোজিট লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার মিজানুর রহমান জানান, আমরা পরিবেশের কোন ক্ষতি চাইনা। আমাদের কারখানা বর্জ ইটিপি প্লান্টের মাধ্যমে ১০০ ভাগ পরিশোধন করা। কোন দূষতবর্জ নদী অথবা খালে ফেলা হয় না। অন্য কোন কারখানার শিল্পবর্জ হয়তো পানিতে মিশতে পারে।

 

 


শিল্পবর্জ দূষণের বিষয়ে পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়ন সোসাইটির সোনারগাঁ শাখার সভাপতি মোহাম্মদ হোসেন বলেন, চৈতি কম্পোজিট নামে শিল্পকারখানার বর্জ দূষণের বিষয়ে প্রতিবাদ সভা, মানব বন্ধন ও সংবাদ সম্মেলনসহ আমরা বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করেছি। কোন ভাবেই শিল্পবর্জ দূষণ ঠেকানো যাচ্ছেনা। আমরা আবারো বৃহত্তম কর্মসূচি পালন করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহন করছি।

 

 


নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, শিল্পবর্জ দূষণের অপরাধে সোনারগাঁয়ে অবস্থিত চৈতি কম্পোজিটের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। সূনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আবারো তদারকি করে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।