শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৫ ১৪৩০   ১৯ রমজান ১৪৪৫

তিতাসে যত ভোগান্তি তত লাভ

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০২:১৫ পিএম, ৩১ জানুয়ারি ২০২৩ মঙ্গলবার

 

 

# অভিযোগ পেলে শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে : কাজিম উদ্দিন
# অসাধু কর্মকর্তারা মিলে অবৈধ সংযোগ দেয় : হাজী নুরুদ্দিন

 

 

সকাল-বিকাল-সন্ধ্যা যে সময়ই গৃহিনীরা চুলায় আগুন ধরাতে যান হয় গ্যাস থাকে না কিংবা আগুন নিভু নিভু করে। অথচ মাস শেষে গ্রাহকদের গ্যাস বিলটা ঠিকই জমা দিতে হয়। এরফলে ঠিকমতো রান্নার কাজ শেষ করতে না পারায় বিভিন্ন হয়রানির শিকার হচ্ছেন গৃহবধূরা। এতে করে সকালের নাস্তা তৈরিতে ঝামেলার কারণে বাচ্চারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং চাকরীজীবীরা তাদের কর্মস্থলে সময় মতো যেতে পারছে না। একদিকে স্কুল কলেজ কিংবা অফিসে যাওয়ার সময় নাস্তা খাওয়া, দুপুরের খাবার নিয়ে যাওয়া কিংবা সারাদিন পরিশ্রম করে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে শান্তি মতো রাতের খাবারও খেতে পারছেন না। এতে করে অনেক পরিবারেই সৃষ্টি হচ্ছে পারিবারিক কলহ।

 

তিতাস কর্তৃপক্ষকে এই সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নিতে নারায়ণগঞ্জবাসী বিভিন্ন সময় অভিযোগ দেনদরবার ও আন্দোলন সংগ্রামও করেছে। কিন্তু তাতে কোন ফলাফল আসেনি। এরই মধ্যে আমরা নারায়ণগঞ্জবাসীসহ নারায়ণগঞ্জের বেশ কয়েকটি সামাজিক সংগঠনও এই বিষয়ে প্রতিবাদ ও দাবী জানিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করেছে। তবে বৈধ গ্যাস সংযোগের তুলনায় অবৈধ গ্যাস সংযোগের পরিমান বেশি হওয়ায় এই সমস্যা আরও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে সমাজের সচেতন মহলের ধারণা। তাদের মতে এখানে তিতাসের কিছু অসাধু কর্মচারী কর্মকর্তা জড়িত থাকায় গ্রাহকদের ভোগান্তি তাদের সুফল বয়ে আনে। গ্যাসের সংযোগসহ নিরবিচ্ছিন্ন লাইনে যত বেশি ভোগান্তি হয় ততই এসব অসাধু লোকদের অবৈধ সংযোগ দেওয়ার টাকার পরিমান বেড়ে যায় বলে অভিযোগ তাদের। অর্থাৎ গ্রাহকদের যত বেশি ভোগান্তি এসব সিন্ডিকেট সদস্যরা তত বেশি লাভবান হন বলে মনে করেন তারা।

 

বিভিন্ন তথ্য সূত্রে জানা যায়, একদিকে লোকসান দিয়ে ভর্তূকির মাধ্যমে গ্যাস কিনে সরবরাহ করছে সরকার। অন্যদিকে কিছু অসাধু কর্মকর্তা স্থানীয় প্রভাবশালীদের সাথে আঁতাত করে অবৈধ গ্যাস সংযোগের মাধ্যমে কোটি কোটি হাতিয়ে নিচ্ছে। নারায়ণগঞ্জে যতগুলি আবাসিক গ্যাসের সংযোগ আছে তার অর্ধেকেরও বেশি অবৈধ সংযোগ বলে বিভিন্ন পরিসংখ্যনে জানা গেছে। শুধুমাত্র বন্দর এবং সোনারগাও উপজেলায়ই তিতাস গ্যাসের আবাসিক লক্ষাধিক অবৈধ সংযোগ আছে বলে জানা গেছে। এসব অবৈধ গ্রাহকদের কাছ থেকে সংযোগ ফি বাবদ নির্ধারিত ফি এর কয়েকগুন বেশি টাকা নেওয়া হয়। যা সরকারের খাতায় না গিয়ে চলে যায় অসাধু কর্মকর্তা ও ঠিকাদারসহ স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের পকেটে।

 

এতে করে ভোগান্তিতে পড়ে বৈধ সংযোগকারী গ্রাহকগণ। সেসব অবৈধ সংযোগকারীরা একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বড় অংকের টাকা খরচ করে খুব অল্প সময়ের মাধ্যমেই পেয়ে যায় নতুন সংযোগ। এতে সংযোগ প্রতি এককালীন ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে জানা যায়। প্রতি মাসের হিসেবে সেসব সংযোগকারীদের কাছ থেকে নেওয়া হয় গ্যাস বিল। এগুলো আবার নিজেরা ভাগবাটোয়ারা করে নেয়। তাই বৈধ সংযোগকারীদের তুলনায় অবৈধ সংযোগ সংখ্যা বেশি হওয়ায় এবং সেখানে অনিয়ন্ত্রিত গ্যাস খরচ হওয়ায় বৈধ গ্রাহকদের চুলায় গ্যাসের চাপ কমে যায়।

 

তাছাড়া যখনই কোন উচ্ছেদ অভিযানের পরিকল্পনা করা হয় তখনই সেই খবর অবৈধ সংযোগকারীদের কাছে নিজ দায়িত্বে পৌছে দেন তিতাসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা এবং স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে সেসব সংযোগ অস্থায়ীভাবে সরিয়ে নেয়া হয়। তবে যে সব অবৈধ সংযোগকারীরা এই দালাল বা সিন্ডিকেট চক্রকে নিয়মিত মাসোহারা না দেয় তাহলে আশেপাশের সব অবৈধ সংযোগ ঠিক থাকলেও বিভিন্ন উছিলায় শুধু সেসব অবৈধ সংযোগ চিহ্নিত করে বিচ্ছিন্ন করা হয়। সেখানে নিয়ম মেনে কোন ম্যাজিস্ট্রেট রাখারও প্রয়োজন হয় না। তিতাসের অসাধু কর্মকর্তা ঠিকাদার এবং দালালরা এসে দেখে দেখে শুধু সেই সংযোগটিই বিচ্ছিন্ন করে চলে যায়।

 

স্থানীয় সচেতন মহলের মতে, এই অবৈধ সংযোগগুলো বিচ্ছিন্ন করা যেহেতু সম্ভব হচ্ছে না এবং সরকারও এখান থেকে কোন লাভবান হচ্ছে না। তাই যে সংযোগগুলো অবৈধভাবে করা আছে তা বৈধ করলে অন্তত এর মূল্য সরকারের খাতায় জমা হবে। যেহেত এসব বৈধ অবৈধ সব গ্যাস সংযোগের জন্যই ভর্তুকি দিয়ে সরকারকে গ্যাস কিনে আনতে হয় তাই এই টাকা সরকারে খাতে জমা পড়লে তাতে সরকার কিছুটা হলেও ক্ষতি লাগব হবে।

 

এই বিষয়ে জানতে চাইলে আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী সংগঠনের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, স্থানীয় পর্যায়ের কিছু টাউট বাটপার নেতা আছে যারা তিতাসের ঠিাকাদারসহ কিছু অসাধু কর্মকর্তার সাথে যোগসাজশ করে এই অবৈধ সংযোগ দেওয়ার কাজগুলো করে। তাদের একটি নেটওয়ার্ক আছে। তিতাসের সাথে সম্পৃক্ত কোন লোক ছাড়া অভিজ্ঞ লোক ছাড়া এধরণের কাজ করা সম্ভব না। তিতাসের সংযোগ প্রক্রিয়া কোন সহজ কাজ না। এখানে তিতাস বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীসহ কিছু ঠিকাদার আছে এই কাজগুলো করার জন্য।

 

তিনি বলেন, অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদের জন্য যখন কোন লাইন কাটা হয় সেখানে দুই একদিন পরই দেখা যায় আবারও সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এখানেই বুঝা যায়, যারা এই কাজগুলো করে তারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই করে এবং তারা অনেক শক্তিশালী। যারা এগুলো কর্তন করে তাদের মধ্যেও হয়তো কেউ কেউ যুক্ত আছে। আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারি একদিনেই প্রায় ৫ হাজার ১০ হাজার করে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এতেই বুঝা যায় তিতাস গ্যাসের কত হাজার হাজার লাখ লাখ অবৈধ সংযোগ আছে।

 

বর্তমানে বৈধ লাইনের তুলনায় অবৈধ লাইনের সংখ্যাই বেশি। এখন অবৈধ লাইনের চাপে বৈধ সংযোগগুলোরও ভোগান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। কোন এলাকায় অবৈধ সংযোগ কর্তন করার জন্য অফিসিয়াল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার সময় তিতাসের লোকজনের মধ্যে বিষয়টি জানাজানি হলে বিষয়টি সেখানে থাকা অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীরাও জেনে যায়। ফলে তাদের স্বার্থের জন্য তারা বিষয়টি আগেই প্রকাশ করে দিলে স্থানীয়রা তখন আগে থেকেই সাবধান হতে শুরু করে।

 

এই বিষয়ে বাংলাদেশ তিতাস গ্যাস কর্মচারী ইউনিয়নের (সিবিএ) সভাপতি এবং জাতীয় শ্রমিক লীগের আইন ও দরকষাকষি বিষয়ক সম্পাদক মো. কাজিম উদ্দিন প্রধান বলেন, তিতাসের কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী এই প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত থাকার কোন অভিযোগের প্রমাণ হলে সাথে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তাই তাদের জড়িত থাকার কোন সুযোগ নেই। তবে কেউ যদি এমন কোন তথ্য দিয়ে অভিযোগ করেন তার বিরুদ্ধে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

 

অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নে সংস্থাটি বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এগুলো উচ্ছেদের কোন বিকল্প নেই। অবৈধ সংযোগ বৈধ করার বিষয়ে তিনি বলেন, এগুলো বৈধ করার অধিকার তিতাসের নেই। এটা সম্পূর্ণ সরকারের সিদ্ধান্ত। সরকার যদি কখনও মনে করেন তাহলেই শুধু এগুলো বৈধ করার প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে।

এস.এ/জেসি