বিআরটিএ’র ডিজিটাল সেবায় দূর হলো ভোগান্তি
লতিফ রানা
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ০৮:৫৬ পিএম, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ রোববার
# দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার ভোগান্তি কমেছে
# দালালের খপ্পরে পড়ে অতিরিক্ত টাকা গুণতে হচ্ছে না গ্রাহককে
# অনেক কম সময় ব্যয় করেই হাতে লাইসেন্স পাওয়া যায়
# গ্রাহককে শুধুমাত্র একদিন স্বশরীরে হাজির হতে হয় : সহকারি পরিচালক
বিআরটিএ নারায়ণগঞ্জ। যেখানে গেলেই দেখা যেত দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য অপেক্ষারত গ্রাহকদের হৈহুল্লোড়। অন্যায়ভাবে কে কার আগে চলে গেল, কে দীর্ঘ সময় যাবৎ লাইনে দাঁড়িয়ে পাচ্ছে না লাইসেন্স নামের সোনার হরিণটি, সে নিয়ে চলতো বাগবিতণ্ডা। নারায়ণগঞ্জ বিআরটিএ’র কার্যালয়ের প্রবেশ মুখের ফটকের সামনে এরকম দৃশ্য ছিল নিত্যদিনের চিত্র।
অন্যদিকে যে ব্যাংকগুলোতে ড্রাইভিং লাইসেন্স এর জন্য টাকা জমা নেওয়া হতো সেখানেও ছিল গ্রাহক বিড়ম্বনা। এসব জায়গায় নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছাতে না পারলে আবার ফিরে যেতে হতো এবং পরের দিন আবার চেষ্টার যুদ্ধে লিপ্ত হতো লাইসেন্স পেতে চাওয়া সাধারণ জনগণের। শুধুই কি তাই! দালালের সহযোগিতা ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স করবেন এমন বিষয়টা যেন ভাবাও ছিল পাপ।
বিআরটিএ’র কার্যালয়ে গেলেই পড়তে হতো দালালদের খপ্পরে। যার ফলে প্রকৃত টাকার কয়েকগুণ বেশি গুণতে হতো গ্রাহকদের। অথচ এখন বিআরটিএ’র সেই একই জায়গায় দেখা যায় সুনসান নীরবতা। সেই হৈহুল্লোড়, ধাক্কাধাক্কি, বাগবিতণ্ডা কিংবা অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের সেই অস্থির চিত্র এখন আর দেখা যায় না। নেই কোন দালালের প্রতাপ।
ব্যাংকগুলোতেও টাকা জমা দেওয়ার জন্য নেই দীর্ঘ লাইন কিংবা সেই সকাল থেকে টাকা জমা দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থেকে সবার আগে টাকা জমা দিয়ে বিআরটিএ’র অফিসে দৌড় দেওয়ার প্রচেষ্টা। যেন কোন এক আজব যাদুবলে এই ধরণের হয়রানি ও ভোগান্তি উবে গেছে। বাস্তবে তা যাদুই বলতে হবে, আর যাদুর নাম ডিজিটাল সেবা। ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে বিআরটিএ’র ডিজিটাল সেবা চালু করার কারণেই এসব হয়রানি ও ভোগান্তি দূর করা সম্ভব হয়েছে।
বিআরটিএ’র দেওয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশের মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ যেকোনো নাগরিক ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবেন। তবে এখানে কিছু প্রাথমিক শর্ত আছে। যেমন একজন গ্রাহককে প্রথমে হালকা ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে হবে। এর কমপক্ষে তিন বছর পর তিনি পেশাদার মিডিয়াম ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবেন। মিডিয়াম ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার কমপক্ষে তিন বছর পর ভারী ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবেন।
অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য কমপক্ষে ১৮ বছর এবং পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য বয়স কমপক্ষে ২০ বছর হতে হবে। আবেদন করতে হলে যেসব কাগজপত্র লাগবে তাহলো- ৩০০ বাই ৩০০ পিক্সেলের ছবি যা সর্বোচ্চ ১৫০ কিলোবাইটের মধ্যে হতে হবে। রেজিস্টার্ড ডাক্তারের সইসহ পূরণকৃত মেডিকেল সার্টিফিকেট ফরমের স্ক্যান কপি, এনআইডি/জন্ম নিবন্ধন সনদ কিংবা পাসপোর্ট এর কপি, বর্তমান ঠিকানার জন্য গ্যাস, বিদ্যুৎ বা পানির বিলের কপি। এগুলো সর্বোচ্চ ৬০০ কিলোবাইটের মধ্যে হতে হবে।
লার্নারের জন্য শুধু এগুলো হলেই চলবে। এর সাথে লাইসেন্স ফি জমা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়ে যাবে লার্নার বা শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্স। যা ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষার সময় ব্যবহার করা যাবে। এরপর এসব ধাপ পার হওয়ার পর স্মার্টকার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদনের জন্য এসব কাগজের সাথে লার্নার বা শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্স নম্বর সংযোজন করে ও প্রয়োজনীয় ফি জমা দিতে হবে। এরপর যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে লাইসেন্সটি তৈরি হলে ডাকযোগে গ্রাহকের উল্লেখিত বর্তমান ঠিকানায় তা পাঠানো হবে।
তবে এর আগে বিআরটিএ থেকে ড্রাইভিং পাওয়ার জন্য লাইসেন্স প্রত্যাশীদের ভোগান্তি নিয়ে লেখালেখি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে গ্রাহককে বিআরটিএ-তে চার থেকে পাঁচদিন ধরণা দিতে হতো বলে অভিযোগ ছিল। এমনকি চাহিদা মতো ঘুষ না দিলে কিংবা দালাল ছাড়া সহজে কোন ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যেত না বলেও জানা গেছে। দালাল ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করলে পদে পদে ভোগান্তির শিকার হতে হতো।
লিখিত, মৌখিক ও ফিল্ড (মাঠ) টেস্ট পরীক্ষায় পাস করার পর নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার জন্য সরাসরি ছবি তোলা ও আঙুলের ছাপ দেয়ার সিরিয়াল পেতেও ঘুষ দিতে হতো। মোট কথা সরকার নির্ধারিত টাকা থেকে দুই কিংবা তিনগুণ বেশি টাকা প্রদান করতে হতো বলেও জানা যায়। ব্যাংকে দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করে নির্দিষ্ট টাকা জমা দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্সের রেফারেন্স নাম্বার নিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার সময় ২ হাজার টাকা অতিরিক্ত দিতে হতো বলে অভিযোগ ছিল গ্রাহকদের।
পরীক্ষায় পাস করার পর ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার জন্য আবারও ব্যাংকে নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে ছবি তোলার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীদের টাকা দিতে হতো বলে জানা গেছে। এছাড়া সর্বশেষ লাইসেন্স আনার সময়ও অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হতো বলে ছিল অভিযোগ। যদিও বরাবরই বিষয়গুলোকে অস্বীকার করে গেছেন বিআরটিএ’র কর্মকর্তারা।
তবে ডিজিটাল সিস্টেম চালু হওয়ার পর থেকে একদিকে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ সেসব অভিযোগগুলো থেকে পরিত্রাণ পেয়েছে। অন্যদিকে গ্রাহকগণও অনেক অল্প সময় ব্যয় করে, কোন দালাল ছাড়া, অতিরিক্ত টাকা না গুণে এবং বারবার ব্যাংক কিংবা বিআরটিএ’র কার্যালয়ে না দৌঁড়িয়ে অনেক সহজেই এই সেবা পাচ্ছেন তারা।
এই বিষয়ে আলাপকালে বিআরটিএ নারায়ণগঞ্জ এর সহকারী পরিচালক (প্রকৌশলী) মো. শামসুল কবীর বলেন, ডিজিটাল পদ্ধতি শুরু হওয়ার পূর্বে গ্রাহকসহ আমাদের স্টাফদেরও অনেক ঝামেলা পোহাতে হতো। গ্রাহকদের পক্ষ হতে অনেক হয়রানি ভোগান্তি ও অতিরিক্ত টাকা খরচের অভিযোগ করারও সুযোগ ছিল। ২০২২ সালে নারায়ণগঞ্জ বিআরটিএ’র এই ডিজিটাল সেবা চালু করার পর থেকে এখানে সেই সুযোগগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।
অফিস চলাকালীন সময় আমাদের অফিসের নিচের গেটে লাইসেন্স নিতে আসা লোকদের প্রায় সব সময়ই ভিড় লেগে থাকতো। দালালদের খপ্পরে অনেককেই অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হতো বলে অভিযোগ পেতাম। এখন এসব সমস্যার সমাধান হয়েছে। একজন গ্রাহককে একদিনের জন্য মাত্র লিখিত, মৌখিক ও ফিল্ড টেস্ট-এ অংশ গ্রহণ করতে বিআরটিএ-তে উপস্থিত হতে হয়। আমাদের কাছে নিয়মতান্ত্রিকভাবে কেউ লার্নার (শিক্ষানবিশ) লাইসেন্সের জন্য আবেদন করলে আমরা তা দিয়ে দেই।
পরীক্ষায় পাশ করার পর লার্নার লাইসেন্স নম্বরসহ স্মার্টকার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য অনলাইনে আবেদন করতে হয়। টাকা জমা দেওয়ার জন্যও এখন ব্যাংকে যাওয়া বাধ্যতামূলক না। ঘরে বসে অনলাইন ব্যাংকিয়ের (যেমন-বিকাশ, নগদ ইত্যাদি) মাধ্যমে টাকা জমা দিতে পারবে। এরপর স্মার্টকার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রস্তুত হলে আমরা পোস্ট অফিসের মাধ্যমে গ্রাহকদের ঠিকানায় তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করি। এস.এ/জেসি