খুন-গুমে ভয়ঙ্কর আজমেরী ওসমান
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ১০:৩১ পিএম, ২৩ অক্টোবর ২০২৪ বুধবার
# ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পর ২০ টিরও বেশি মামলার আসামী
যুগের চিন্তা রিপোর্ট: গত ৫ আগষ্টের পরে গডফাদার সাবেক এমপি শামীম ওসমান সহ তার ভাতিজা আজমেরী ওসমান নারায়ণগঞ্জ পালিয়ে আত্মগোপনে রয়েছে। একই সাথের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পতনের সাথে ওসমান পরিবারের পতন ঘটে। পতন ঘটার পর থেকে এই পর্যন্ত ৫ আগষ্টের পর থেকে আজমেরী ওসমান, তার চাচা শামীম ওসমান, ওয়ন ওসমান প্রায় ২০ টিরও বেশি নতুন হত্যা মামলার আসামী হয়েছে। এছাড়া তাদের অপকর্মের ভয়ে তারা নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে ওসমান সম্রাাজ্যের অনেকেই দেশে ছেড়ে পালিয়ে বাইরের দেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাছাড়া চাদাঁবাজি, টেন্ডারবাজি, ভুমিদস্যুতা করে আজমেরীয় সওমানের গুন্ডাবাহিনী অনেকেই শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।
এইদিকে ৫ আগষ্টের আওয়ামী লীগের পতনের আগে শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমান অন্তত ১৬টি খুনের দায়ে অভিযুক্ত রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় শীর্ষ পর্যায় থেকে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা থাকায় কখনও গ্রেপ্তার হননি আজমেরী ওসমান। এমনকি হত্যা মামলায় তাঁর নাম দিতে চাইলে সেই মামলাও নেওয়া হতো না। ফলে বাধাহীনভাবে নারায়ণগঞ্জের আল্লামা ইকবাল রোডে টর্চার সেল বানিয়ে চালিয়েছেন। এছাড়া এখানে বসে নানা অত্যাচার-নিপীড়ন সহ অপকর্ম পরিচালনা করেছে। একের পর এক অপরাধ করে গেলেও বিচারের সম্মুখীন হতে হয়নি তাঁকে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি এখন পলাতক। কেউ জানে না কোথায় আছেন।
নারায়ণগঞ্জ-৫ (শহর-বন্দর) আসনে জাতীয় পার্টির প্রয়াত সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের একমাত্র ছেলে আজমেরী ওসমান। ১৯৯৮ সালে পরিবার নিয়ে নগরীর চাষাঢ়া বালুর মাঠ এলাকায় মনির টাওয়ারে থাকতেন এ জাপা নেতা। এ ভবনের কেয়ারটেকার নুরুন্নবী ওই বছরের রোজার ঈদের সময় খুন হন। অভিযোগ রয়েছে, আজমেরীর গতিবিধি সম্পর্কে তাঁর বাবাকে তথ্য দেওয়ায় আজমেরীই নুরুন্নবীকে খুন করেন। তাঁর লাশ নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসকের বাসভবনের পাশের রাস্তায় পাওয়া যায়। কেয়ারটেকার নুরুন্নবী পরিবার নিয়ে এ বাসায় থাকলেও হত্যাকাণ্ডের পরে এই পুরো পরিবারের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
অভিযোগ রয়েছে, ২০০০ সালের ১৯ নভেম্বর নগরীর ইসদাইর ওসমানী স্টেডিয়ামের সামনে আজমেরী ওসমান কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে খুন করেন তাঁরই এক সময়ের বন্ধু আলমগীরকে। এ ছাড়া ২০০৯ সালের এপ্রিলে শহরের আমলাপাড়ায় ১৪ টুকরা অজ্ঞাত লাশ পাওয়া যায়। মামলা হলেও পুলিশ এই খুনের রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও আজমেরী ওসমানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।
২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল গাজীপুরে সাবেক এমপি শামীম ওসমানের শীর্ষ ক্যাডার নুরুল আমিন মাকসুদের লাশ পাওয়া যায়। তাকে আজমেরী ওসমান খুন করেছেন বলে নারায়ণগঞ্জে প্রচার রয়েছে। ২০১১ সালে শহরের প্রেসিডেন্ট রোডে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে গলা কেটে খুন করা হয় অটোচালক জামালকে। অবৈধ অস্ত্র ও মাদক পরিবহনে রাজি না হওয়ায় আজমেরীর বাহিনী তাকে খুন করে। এ ব্যাপারে থানায় মামলা হলেও তাঁকে মামলায় আসামি করা যায়নি। একই বছরের ১১ মে শীতলক্ষ্যা নদীতে ব্যবসায়ী আশিক ইসলামের লাশ পাওয়া যায়। তাঁর মুখমণ্ডল ঝলসানো এবং বিশেষ অঙ্গ ছিল থেঁতলানো। আশিকের ভাই ফাহিমুল ইসলাম জানান, তারা থানায় অভিযুক্ত আজমেরী ওসমানের নামে মামলা করতে গেলে ওসি তাদের বলেন, তাঁর আব্বা নাসিম ওসমান খুব ভালো। তাঁর ছেলে আজমেরী ওসমানও খুব ভালো। তিনি এসব করতে পারেন না। ফলে আমরা মামলায় আজমেরীর নাম দিতে পারিনি। আশিক হত্যার পর ২০১১ সালের মে মাসের শেষ দিকে শীতলক্ষ্যা নদীতে অজ্ঞাতপরিচয় দুই যুবকের লাশ পাওয়া যায়। সে সময় নারায়ণগঞ্জ শহরে প্রচার হয়, এই দুটি লাশ আশিক হত্যাকাণ্ডে জড়িত ভাড়াটে খুনির। হত্যার আলামত মুছে ফেলতে তাদের খুন করা হয়েছে।
২০১৩ সালের ২৯ জানুয়ারি তিন দিন নিখোঁজ থাকার পর শীতলক্ষ্যা নদীতে টানবাজারের রং-সুতা ব্যবসায়ী গোবিন্দ সাহা ভুলুর লাশ পাওয়া যায়। চাঁদা না দেওয়ায় তাঁকে হত্যা করা হয় বলে তাঁর ভাই চিত্তরঞ্জন সাহা সে সময় জানিয়েছিলেন। তাঁর হত্যার ব্যাপারে আজমেরী ওসমানকে দায়ী করে বিভিন্ন সময়ে সমাবেশ করেছে নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট।
২০১২ সালের ১৫ জুলাই গাবতলী এলাকার বাসিন্দা মিঠুকে শহরের জামতলা ধোপাপট্টি এলাকায় হিরা কমিউনিটি সেন্টারের সামনে প্রকাশ্যে খুন করা হয়। তিনি গাবতলী এলাকায় আজমেরীর অনুগত মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। মিঠুর বাবা খোরশেদ আলম তখন জানিয়েছিলেন, ফতুল্লা থানার ওসি তাঁকে দেখান আজমেরীর নাম দিলে মামলাই নেওয়া হবে না। সম্প্রতি মারা যান খোরশেদ আলম।মিঠুকে হত্যার পরদিনই সাংস্কৃতিক কর্মী দিদারুল আলম চঞ্চলকে খুন করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শামীম ওসমানের পক্ষে কাজ না করে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে কাজ করায় তাঁকে হত্যা করা হয়। চঞ্চলের ভাই জুবায়ের ইসলাম পমেল জানান, চঞ্চলের লাশ পাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বন্দর থানার ওসি অজ্ঞাত হিসেবে লাশ দাফন করে বিষয়টি গোপন করার চেষ্টা করেন।
মিঠু হত্যায় সরাসরি জড়িত ছিলেন আজমেরীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী সিনেমার এক সময়ের জনপ্রিয় খলনায়ক আদিলের ছেলে হামীম। খুনের সাক্ষী না রাখার জন্য মিঠু হত্যার তিন দিন পর ামীমকে ২০১২ সালের ১৮ জুলাই কক্সবাজারে নিয়ে মদের সঙ্গে বিষপান করিয়ে হত্যা করা হয় বলে প্রচার রয়েছে।
২০১৩ সালের শুরুতে নগরীর মাসদাইর এলাকায় একটি গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যান আজমেরী ওসমান। এখানে গান গাইছিলেন উম্মে হানী নামের এক মেয়ে। আজমেরী অনুষ্ঠানের সব অতিথিকে নামিয়ে দিয়ে মেয়েটিকে ধর্ষণ ও অপহরণ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পরে মেয়েটি ও তাঁর পরিবারকে আর নারায়ণগঞ্জ শহরে দেখা যায়নি। হানীকে হত্যার পর আজমেরী লাশ গুম করেন বলে অনেকের সন্দেহ।
২০১৩ সালের ৬ মার্চ চাষাঢ়ায় সুধীজন পাঠাগারে যাওয়ার পথে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে অপহরণ করা হয়। ৮ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদীর কুমুদিনী পোতাশ্রয় থেকে তার লাশ পাওয়া যায়। ‘এ’ লেভেল পরীক্ষায় সারাবিশ্বে পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে ৩০০ নম্বরের মধ্যে রেকর্ড ২৯৭ নম্বর পায় কিশোর ত্বকী। এ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া আজমেরীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী সুলতান শওকত ভ্রমর ২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। এতে সে জানায়, শহরের কলেজ রোডের টর্চার সেলে আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বেই ত্বকীকে খুন করা হয়।
২০১৩ সালের নভেম্বরে ১ নম্বর বাবুরাইল থেকে নিখোঁজ হন নাট্যকার মামুনুর রশীদের আত্মীয় আসিফ। আজমেরী বাহিনী তাঁকে গুম করে বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০২০ সালের ১৭ জানুয়ারি ১ নম্বর বাবুরাইল এলাকায় আজমেরীর বন্ধু দারুণ কাওয়ালকে ফাঁসিতে ঝুলতে দেখা যায়। এ ঘটনাটি আত্মহত্যা নয়, হত্যা বলেও সন্দেহ করা হয়। তবে গত বৃহস্পতিবার দারুণের বাসায় গেলে তাঁর স্ত্রী রিনা বেগম এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। গত ৫ আগষ্টের আগে ১৬ খুনের অভিযোগ নিয়ে পলাতক রয়েছে আজমেরী ওনসমান। আর বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের পর আর ২০ টিরও বেশি হত্যা মামলায় তার নাম যুক্ত হয়েছে। আর এতে করে প্রায় ৪০ টির হত্যার ঘটনায় আজমেরী ওসমানের নাম জরিত থাকার অভিযোগ উঠেছে।