বুধবার   ১১ ডিসেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ২৭ ১৪৩১   ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ছাত্রলীগ নিষিদ্ধে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

যুগের চিন্তা রিপোর্ট :

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৬:৪৬ পিএম, ২৫ অক্টোবর ২০২৪ শুক্রবার

# জনকল্যাণের জন্য ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে : মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন

# ছাত্রলীগ ছিল আওয়ামী লীগের লাঠিয়াল বাহিনী : এড. সাখাওয়াত হোসেন

# আরো আগেই নিষিদ্ধ করা উচিৎ ছিল : ইঞ্জি. মনোয়ার হোসেন 

# ছাত্রলীগের অপকর্মের বিচার বিভাগীয় তদন্তের প্রয়োজন  : তরিকুল সুজন


ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সরকারের ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের এই সিদ্ধান্তকে অনেক রাজনৈতিক দলের নেতা সমর্থন করেছেন। আবার অনেক রাজনৈতিক দলের নেতারা এই সিদ্ধান্তকে যথার্থ বলছেননা। বাংলাদেশের অন্যতম বড় দল বিএনপি ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। 

 

জেলা বিএনপির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘ছাত্রলীগকে যে কত ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীতে পরিণত করা হয়েছে তা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যেই ফুটে উঠেছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমানোর জন্য ছাত্রলীগ যথেষ্ট বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। ছাত্রলীগ যে কতবড় সন্ত্রাসী গ্রুপে পরিণত হয়েছে তা ছাত্রআন্দোলনের সময় সারা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে। ক্যাম্পাসে ছাত্র-ছাত্রীদের উপর হামলা, নির্যাতন, আন্দোলনের সময় পুলিশ, র‌্যাব-বিডিআরের সাথে সাথে ছাত্রলীগের হেলম্যাটবাহিনী কি নৈরাজ্য করেছে তা সবাই প্রত্যক্ষ করেছে। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা গুলি করেছে। কোন ছাত্রসংগঠনের এমন সন্ত্রাসী আচরণ মেনে নেয়া যায় না। সন্ত্রাসী কার্যক্রম কোন ছাত্রসংগঠনই করতে পারে না। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে আমি মনে করি সেটি মানুষের কল্যাণের জন্যই। গণহত্যার দায়ে ছাত্রলীগের জড়িতদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।’

 

মহানগর বিএনপির সভাপতি এড. সাখাওয়াত হোসেন খান মনে করেন, ‘ছাত্রলীগ গত ১৫/১৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগের ছায়াতলে থেকে যেধরণের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে, তাতে আওয়ামী লীগ স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ছাত্রলীগ ব্যবহৃত হয়েছে। ফ্যাসিস্ট সরকারে গুম, খুন, রাহাজানি, দখল, লুটতরাজসহ সব ধরণের স্বৈরতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডে ছাত্রলীগ ছিল লাঠিয়াল বাহিনী। সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার ফলে অন্যান্য সকল দলগুলোর ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মনোভাব দূরিভূত হবে।’ 

 

জামায়াতে ইসলামী নারায়ণগঞ্জ মহানগরের সেক্রেটারি ইঞ্জিনিয়ার মনোয়ার হোসেন যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তা আরো অনেক আগেই নেয়া উচিৎ ছিল। গত ১৫ বছরের কুকর্মের কথা বাদ দিয়েও যদি ৫ আগস্টের আগে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার উপর ছাত্রলীগ যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে সেসকল ছাত্রলীগ নেতাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা উচিৎ। যেসকল ছাত্রলীগ নেতা যতটুকু অন্যায় করেছে অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিৎ বলে মনে করি।’ 

 

জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহবায়ক ও জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি মাশুকুল ইসলাম রাজীব এব্যাপারে যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আইন করে কোন রাজনৈতিক সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নই। ছাত্রলীগ অতীতে যেসকল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে মানুষের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন হয়েছে বলে আমি মনে করি। ছাত্রলীগের বিগত দিনের কর্মকাণ্ডের শাস্তি হওয়া উচিৎ, তবে সেটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নয়, অপরাধ বিবেচনা করে।’

 


গণসংহতি আন্দোলন নারায়ণগঞ্জ জেলার সমন্বয়ক তরিকুল সুজন যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘বিগত ১৫ বছরের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনে সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো ছাত্রলীগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে গণরুম-গেস্টরুমে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন, সারারাত ধরে পিটিয়ে ছাত্র হত্যা, ধর্ষণসহ এমন হেন কোন অপরাধ নাই যার সাথে ছাত্রলীগ জড়িত নয়। সারাদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনেও সবসময় প্রধান লাঠিয়ালের ভূমিকায় অবতীর্ন হয়েছিলো ছাত্রলীগ। তাদের সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছে সকল ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। তারই ধারাবিাহিকতায় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান দমাতে সংগঠিত গণহত্যার প্রধান অংশীদারে পরিণত হয় ছাত্রলীগ।

 

হাজারো মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন হয়েছে। জনগণের মাঝে এই গণহত্যায় অংশ নেয়া সকলের বিচার নিশ্চিত করা ও গণহত্যায় অংশগ্রহণকারী সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার আকাঙ্খা তৈরী হয়েছে। এমতাবস্থায় অন্তবর্তীকালিন সরকার নির্বাহী আদেশে গতকাল ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এই মুহুর্তে এ সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা থাকলেও আমরা মনে করি ৬ মাসের মধ্যে বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার স্থায়ী সমাধান করে তাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে।’

 

খেলাফত মজলিস নারায়ণগঞ্জ মহানগরের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস আহমেদ মনে করেন, ছাত্রলীগ গত ১৫ বছর ধরে ক্যাম্পাস রাজনীতি ধ্বংসের মূল কারিগর হিসেবে কাজ করছে। সারা বাংলাদেশে তারা নৈরাজ্যমূলক কাজের সাথে জড়িত ছিলো। আবরার হত্যাকাণ্ডসহ শিঙ্গাঙ্গনের ক্যাম্পাসগুলোতে রক্তের স্রোত বইয়ে দিয়েছে। এরকম ছাত্রসংগঠন কখনোই রাজনীতি করার অধিকার রাখেনা। প্রশাসনের উচিৎ যেসকল ছাত্রলীগ নেতা খুন, গুম, রাহাজানি, নৈরাজ্যের সাথে জড়িত ছিল তাদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা।  

 

হেফাজতের ইসলামী নারায়ণগঞ্জ মহানগরের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাওলানা ফেরদৌসুর রহমান যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে কোন রাজনৈতিক সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নই। কোন ব্যক্তি অপরাধ করে থাকলে তাকে আইনের আওতায় নিয়ে উচিৎ। এই সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক হবে কি না এটিই দেখার বিষয়, কেননা সবজায়গাতেই একটা বিরাট শুন্যতা অনুভূত হচ্ছে। দোষীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসাই ছিল সবার আগের কাজ।’

 

ইসলামী আন্দোলন নারায়ণগঞ্জ মহানগরের সভাপতি মুফতি মাসুম বিল্লাহ যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘ছাত্রলীগের বিগত দিনের কর্মকাণ্ড বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত যৌক্তিক। আরো আগে নিষিদ্ধের প্রয়োজন ছিল। নতুন করে নিষিদ্ধ করার আগে আরো ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ ছিল বলে মনে করি। নিষিদ্ধ হওয়ার পর ছাত্রলীগ নানা সংগঠনে ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করবে এটিই স্বাভাবিক।’ 

 

মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি রাকিবুর রহমান সাগর যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘ছাত্রলীগ নিজেদের অনেক আগেই সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে প্রমাণ করেছে। ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত আরো বহু আগেই নেয়া উচিৎ ছিল। স্বৈরাচারী সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে তাদের প্রত্যক্ষ মদদে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। ছাত্রলীগ সবজায়গাতেই সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই।’

 

গণঅধিকার পরিষদ নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার নাহিদ যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ছাত্রলীগ কলঙ্কিত অধ্যায় রচনা করেছে। বাংলার ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। ছাত্রদের উচিৎ কলমের মাধ্যমে দাওয়াত দেওয়া, কিন্তু বিগত দিনে ছাত্রলীগ যেভাবে বিশৃঙ্খলা করেছে তাতে সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। ছাত্রসংগঠনের কোন সন্ত্রাসী বাহিনী চাইনা। ছাত্রসংগঠন হবে জনকল্যাণমুখী।’ 

 

প্রসঙ্গত, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হত্যা, নির্যাতন, গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ নানা ধরনের জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল এবং এ সম্পর্কিত প্রামাণ্য তথ্য দেশের সব প্রধান গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এবং কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় সংগঠনটির নেতাকর্মীদের অপরাধ আদালতেও প্রমাণিত হয়েছে।  গত ১৫ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ জনগণকে উন্মত্ত ও বেপরোয়া সশস্ত্র আক্রমণ করে শতশত নিরপরাধ শিক্ষার্থী ও ব্যক্তিকে হত্যা করেছে এবং আরও অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করেছে। সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে যে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক, ধ্বংসাত্মক ও উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কাজে জড়িত আছে।

 

এই অবস্থায় সরকার  ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯' এর ধারা ১৮ এর উপ-ধারা (১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন  ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ'কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল এবং ওই আইনের তফসিল-২ এ ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ নামীয় ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্ত্বা হিসেবে তালিকাভুক্ত করল বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়। এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।