
গার্মেন্টস সেক্টরে বেকারত্ব বাড়ছে
# সাত মাসে না.গঞ্জে ২১ কারখানা বন্ধ
# কাজের সন্ধানে ভীড় জমাচ্ছেন শ্রমিকরা
নারায়ণগঞ্জ দেশের অন্যতম বৃহত্তম নদীবন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এছাড়াও এটি আশির দশকে পাট বাণিজ্য ও প্রক্রিয়াকরণ কারখানা এবং দেশের টেক্সটাইল সেক্টরের ব্যবসা ও শিল্পের একটি কেন্দ্র। অনেক পাটকলের উপস্থিতির কারণে এটিকে প্রাচ্যের ড্যান্ডি নামে ডাকা হতো। বর্তমানে পাট শিল্প হারিয়ে গেলেও গার্মেন্টস শিল্পের দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জ। ডিজিটাল জনশুমারী ও গৃহগণনা-২০২২ অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জ আয়তনে দেশের ৮ম এবং জনসংখ্যায় ৫ম বৃহত্তর মহানগর। বিগত সাত মাসে নারায়ণগঞ্জ ২৩ টি গার্মেন্টস কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে। এর বাইরে কয়েকটি কারখানা অস্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে। কারখানাগুলো বন্ধ হওয়ায় প্রায় ২০ হাজার-কর্মচারী শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন।
চাকরী হারানো গার্মেন্টস শ্রমিকরা কাজের জন্য প্রতি দিন ফতুল্লার বিসিক শিল্প কারখানা গুলোতে কাজের জন্য ভীড় করছে। আবার অনেকে ২০২৪ সনের ৫ আগষ্টের পরে শ্রমিক আন্দোলনে জড়িয়ে নিজের চাকরি হারিয়ে এখন দিশেহারা হয়ে রয়েছে। কেননা গত ৫ আগষ্টের পরে এমনিতেই বড় বড় গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেখানকার শ্রমিকরা কাজ পাচ্ছে না। তার মাঝে আবার কিছু শ্রমিক নেতা উস্কানি দিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ তৈরী করে ফায়দা নিয়ে চাচ্ছে। এতে করে শিল্প কারনা খানা গুলোর মালিকরাও বিপাকে রয়েছে। কিছু জায়গায় শ্রমিক নেতাদের উস্কানিতে ফাদে পড়ে যুক্তিক দাবীর সাথে অযুক্তিক দাবীও তুলে আন্দোলন করছে। এতে করে অনেক প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকরা সাময়িক বরখাস্ত পর্যন্ত হয়ে তারা দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় আর কাজে ফিরতে পারে নাই।
এদিকে নারায়ণগঞ্জ ঐতিহ্যগত ভাবে ব্যবসায়িক জোন হিসেবে পরিচিত জেলাটি। তাছাড়া রপ্তানী শিল্পে পাট যখন বাংলাদেশের প্রধানতম পণ্য, তখন নারায়ণগঞ্জ "প্রাচ্যের ডান্ডি" নামে খ্যাত থাকলেও বর্তমানে নিট গার্মেন্টস ও হোসিয়ারী শিল্পের জন্য সুপরিচিত। নিটওয়্যার রপ্তানীকারকদের সংগঠন "বিকেএমইএ" ও হোসিয়ারী শিল্প উদ্যোক্তাদের প্রধান কার্যালয় "হোসিয়ারী সমিতি" নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত। ফতুল্লা এনায়েতনগর এলাকায় অবস্থিত বিসিক শিল্পনগরীতে প্রায় ৭০০ গার্মেন্টস আছে। সারা নারায়ণগঞ্জ শহরে প্রায় ১ হাজার রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস আছে। এগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ গার্মেন্টসই নিট গার্মেন্টস। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের তৈরী পোশাক রাজধানী ঢাকাতে ও বেশ সুনাম অর্জন করতে পেরেছে। তাছাড়া রাজধানীর পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী জেলায় প্রায় ২ হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। তার মধ্যে নারায়ণগঞ্জে ২৩ প্রতিষ্ঠান স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে। অস্থায়ীভাবে একাধিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে রয়েছে।
যুগের চিন্তা প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে জানা যায়, সকাল সাড়ে ৭ টা থেকে দুপুর পর্যন্ত বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে চাকরীর জন্য নারায়ণগঞ্জ ফতুল্লার বেসিক শিল্প এলাকা সহ শহরের নিট গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীগুলোর গেটের সামনে ভীড় করছে। তাদের মাঝে অনেকে গার্মেন্টস এর কাটিং, সুইং স্যাকশন, ফিনিশিং, প্রিন্টিং, নিট স্যাকশনে নানা পদে কাজের জন্য সকাল থেকে দাঁড়িয়ে থেকে জীবিকার জন্য কাজ খুঁজছেন। বাড়ি থেকে কাজের আশা নিয়ে বের হলেও অনেকে কাজ না পেয়ে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে যান। এছাড়া অনেকে কাজ পেয়ে খুশি হন।
শিউলি নামের এক শ্রমিকের সাথে কথা হলে তিনি জানান, গত ছয় মাস যাবত চাককরী হারিয়ে এখন কাজের সন্ধানে ফতুল্লা বিসিক শিল্প এলাকার মার্টিন গার্মেন্টস এর গেটের সামনে সকাল ৮ টায় এসে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু কোন স্যাকশনে কাজ মিলছে না। আর এজন্য পরিবারের ছেলে সন্তানদের নিয়ে চলতে হিমসিম খেতে হচ্ছে।
বিসিকের আর ফোর ফ্যাক্টরীর সামনে চাকরীর জন প্রায় ২০ থেকে ২৫ জনের দাঁড়িয়ে রয়েছেন কাজের সন্ধানে। স্বাভাবিকভাবে মাসের শুরুর দিকে ফ্যাক্টরীগুলোতে লোক নিয়োগ দিয়ে থাকে। কিন্তু নানা কারণে শ্রমিকদের মাঝে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় তারা এখন চাকরীর জন্য পুরো মাস জুরে কাজের জন্য বিভিন্ন ফ্যাক্টরীতে ছুটে বেড়াচ্ছেন।
মরিয়ম নামের সুইংয়ের প্লে মেশিন অপারেটর বলেন, আমি অনেকদিন যাবত বিসিকের বিভিন্ন গামের্ন্টেস এ সুইং অপারেটর হিসেবে কাজ করে আসছি। কিন্তু ৫ আগষ্টের পরে আমি বাড়িতে যাওয়ার পর আমার চাকরী হারাই। এখন ৫ মাস যাবত চাকরী খুঁজছি। কিন্তু এখনো কাজ মিলে নাই। অথচ আগে একদিকে চাকরী হারালে আরেক দিকে অন্য ফ্যাক্টরীতে চাকরী হয়ে যেত। এখন আগের মত কাজ পাওয়া যায় না।
একাধিক গার্মেন্টস কর্মী জানান, অন্যদিকে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, শ্রমিক অসন্তোষ তৈরী হওয়ায় অনেক মালিকরা ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ায় কর্মসংস্থান কমেছে। এতে করে গার্মেন্টস শিল্পে শ্রমিকদের মাঝে বেকারত্ব বাড়ছে।
অন্যদিকে বিভিন্ন শিল্পকারখানার বেকার শ্রমিকেরা প্রায়ই কারখানা খুলে দেওয়া ও বকেয়া পাওনার দাবিতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছেন। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। কারখানা বন্ধের কারণ মোটাদাগে তিনটি। প্রথমত, বেশির ভাগ মালিক আর্থিক সংকট ও ক্রয়াদেশ না থাকায় কারখানা বন্ধ করেছেন।
দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মালিকদের কয়েকটি কারখানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল সেগুলো বন্ধ হয়েছে।
তৃতীয়ত, ক্ষমতাচ্যুত বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যবসায়ী আত্মগোপনে থাকায় তাঁদের কারখানা রুগ্ন হয়ে পড়েছে। যার জন্য এই প্রতিষ্ঠান গুলো বন্ধ হয়ে গেছে। তবে কিছু ফ্যাক্টরী বন্ধ হলেও নতুন করে আরও গার্মেনটস কারখানা চালু হয়েছে। সামনে আরও চালু হতে যাচ্ছে যা শ্রমিকদের জন্য আশার আলো।
বিশ্লেষকদের মতে, শ্রমিক অসন্তোষ তৈরী বন্ধে মালিক শ্রমিক মিলে এমন পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন যাতে করে এখানে কোন শ্রমিক নেতা উস্কানি দিয়ে আন্দোলন তৈরী করতে না পারে। তাছাড়া শ্রমিকদের কিছু যুক্তিগত আন্দোলন থাকলেও তা যেন শ্রমিক নেতার মাধ্যমে সমাধান না হয়ে ব্যবসায়ী নেতারা বসে সমাধান করে দেন। তাহলে শ্রমিক নেতারা ফায়দা নিতে পারবে না। আর এজন্য ব্যবসায়ী নেতাদের কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
শিল্প পুলিশ জানায়, শিল্প পুলিশ-৪-এর কর্মকর্তারা জানান, গত সাত মাসে গ্রিন বাংলা হোম টেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, এশিয়ান ফ্যালকন গার্মেন্টস, জিএল ফ্যাশন, মাস্টার টেক্সটাইল, ওয়েস্ট বেস্ট অ্যাটায়ার্স, স্টার কাটিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংসহ ২১টি কারখানা বন্ধ হয়। সব কারখানাই ছোট ও মাঝারি। আর্থিক সংকট ও পর্যাপ্ত ক্রয়াদেশের অভাবে কারখানা বন্ধ হয়েছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের বিকেএমইএ সহ সভাপতি ও বিসিক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোর্শেদ সারোয়ার সোহেল যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘আমরা চাই মালিক শ্রমিক মিলে এই দেশের শিল্পসেক্টরকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হোক। যাতে করে সারা বিশ্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পাড়ে। তাছাড়া উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, রাজনৈতিক অস্থিরতা অনেক কারখানা টিকে থাকতে পারছে না। বিদেশি বায়ারদের অসহযোগিতা ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির পরিকল্পনাও মালিকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। এমনকি শ্রমিকদের বেতন ৫৬% বৃদ্ধি এবং প্রতি বছর ৯% বৃদ্ধি শুধুমাত্র পোশাক খাতে, ব্যাংকের সুদ প্রায় ৯% থেকে ১৪% বৃদ্ধি প্লাস, বিদ্যুৎ বিল বৃদ্ধি, শ্রমিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, গ্যাস বিল বৃদ্ধি, বিশ্বব্যাপী খারাপ পরিস্থিতি, প্রতিবেশী দেশগুলি রপ্তানি পোশাক খাতে মারাত্মকভাবে অস্থিরতার চেষ্টা করছে ইত্যাদি। এজন্য গার্মেন্স শিল্পকে টিকে রাখতে হলেও মালিক শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করতে হবে।
এর বাইরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর মালিকানাধীন গাজী গ্রুপের দুই কারখানার কয়েকটি ইউনিট বন্ধ রয়েছে। নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত কারাখানা দুটিতে কাজ করতেন চার হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এক দফা ও গোলাম দস্তগীর গাজীকে গ্রেপ্তারের পর আরেক দফায় দুষ্কৃতিকারীদের লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে কারখানা দুটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
চাকরি হারানো শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ দরকার বলে মনে করেন শ্রমিকনেতা সহ শ্রমজীবি মানুষ। দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি পোশাক খাত। তাই সরকার, শিল্প মালিক এবং শ্রমিকদের সমন্বিত উদ্যোগই পারে এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ দেখাতে।