জেলার মিলন-ইফতে খাইরুল দুই ভাই ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক

যুগের চিন্তা রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম

জেলার মিলন-ইফতে খাইরুল দুই ভাই ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক
# জেলারের আপন ভাই ইফতে খাইরুল, ওসমান পরিবারের জামাই হওয়ার সুবাদে স্থানীয়দের মাঝে মূর্তিমান এক ত্রাস ছিলেন
# ৫ আগস্টের পর উপ-পুলিশ কমিশনার ইফতে খাইরুলের গাড়িতে করে পালান আজমেরী ওসমান
মাহাবুবুল ইসলাম মিলন। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে ডেপুটি জেলার পদে থাকা অবস্থায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জেলারের দায়িত্ব পান। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর পদোন্নতি ছাড়াই জেলারের দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে। পরে ২০১২ সালের জুলাইয়ে জেলার পদে স্থায়ী করা হয় তাকে। এক এগারোর সময়ে পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদ ভবন এলাকায় যে ভবনে বন্দী ছিলেন সেখানকার ডেপুটি জেলার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন এই মাহবুবুল ইসলাম মিলন। সেই সুবাদে তিনি সাবেক ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা দেন। যে কারণে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিতি পান কারা অধিদপ্তরে।আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর কারা কর্মকর্তাদের কাছে হাসিনার খুব কাছের মানুষ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেন মাহবুবুল ইসলাম মিলন। শেখ হাসিনাকে মা বলেন ডাকতেনও বলে জানা যায়। চাকরিতে থাকা অবস্থায় জেলার মাহবুবুল ইসলাম নিজের ফেসবুকে গণভবনে শেখ হাসিনার সাথে থাকা ছবি পোস্ট দিতেন। এছাড়াও তার ছেলের জন্মদিনে গণভবনে পালন করার ছবিও পাওয়া যায়।আওয়ামী ক্ষমতার অপব্যবহার করে কারা কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, বদলি বাণিজ্য, কারাগারের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন এই মাহবুবুল ইসলাম মিলন। বন্দীদের কাছ থেকে উৎকোচ নেওয়া এবং বন্দিদের কাছে মাদক সরবরাহ করার বিষয়টি কারা অধিদপ্তরে ওপেন সিক্রেট ছিল। কারাগারের বন্দীদের ভালো সেলে থাকার সুযোগ এবং ভালো খাবার দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিবছর বন্দীদের কাছ থেকে অবৈধভাবে হাতিয়ে নিতো লাখ টাকা।
অনুসন্ধানে জানা যায় মাহবুবুল ইসলাম মিলন, চাকরিজীবনের বেশি সময় তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দায়িত্বে কাটিয়েছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে কারা বিধীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিয়ম ভেঙ্গে টানা সাত বছর জেলার হিসেবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দায়িত্ব পালন করেছেন। যেখানে দুই বছরের বেশি একই স্থানে থাকা কারা বিধির নিয়মে নেই। অবৈধ উপায়ে আয়কৃত অর্থ বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে এই মাহবুব এর বিরুদ্ধে।
মাহাবুবুল ইসলাম মিলন শেখ হাসিনাকে মা ডেকে ডেপুটি জেলার থেকে সরাসরি জেলার হয়ে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। এই জেলারের আপন ভাই অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার ইফতে খাইরুল কে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেয়ার পর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পুলিশ বাহিনীতে তার ছিল একক আধিপত্য। কারণ আওয়ামী লীগের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের আত্মীয় তিনি।
জানা যায়, শামীম ওসমানের ভাই নাসিম ওসমানের মেয়েকে বিয়ে করে পুলিশ বাহিনীতে অদৃশ্য ক্ষমতার মালিক হয়েছেন তিনি। আওয়ামী ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে এ দুই ভাই পুলিশ বাহিনীতে যেমন প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, তাদের নিজ এলাকা নারায়ণগঞ্জের মদনগঞ্জেও ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে নানারকম অপকর্ম করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ক্ষমতার দাপটে অন্যের জমি বাড়ি দখল, নানারকম অপকর্ম করলেও তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কেউ দেখায়নি।
শেখ হাসিনার পতনের পরও এখনো তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস করে না এলাকার সাধারণ মানুষ। আওয়ামী প্রেমে মগ্ন ছিলেন ইফতে খায়রুল ইসলাম। মাঝে মাঝেই কবিতা আবৃত্তি করতেন শেখ মুজিবকে নিয়ে। এসব আবৃত্তি ছিল তার দুর্নীতির খোরাক। ৩০তম বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তা অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার ইফতে খাইরুল ইসলাম পুলিশ বাহিনীতে ক্ষমতাধর ছিলেন।
এছাড়াও ওসমান পরিবারের জামাই হওয়ার সুবাদে স্থানীয়দের মাঝে মূর্তিমান এক ত্রাস ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, মদনগঞ্জ এলাকায় ইফতেখারুল ও মাহবুবের ছত্রছায়ায় একদল সন্ত্রাসী বাহিনী মাদক ব্যবসা চাঁদাবাজি সহ ও নানারকম অপকর্ম করতেন। অন্যের জমি দখলসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটাতে ওই বাহিনীকে ব্যবহার করতেন। হাসিনা পতনের পর সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ত্বকী হত্যার আসামী ও নাসিম ওসমানের ছেলে ইফতে খাইরুল ইসলামের গাড়ি করে পালিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন নারায়ণগঞ্জ সন্ত্রাস নির্মূল কমিটি ত্বকী মঞ্চের আহবায়ক রফিউর রাব্বি। এ ঘটনায় আবারও সমালোচনায় সামনে এসেছেন ইফতেখারুল ইসলাম ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সাবেক সাংসদ নাসিম ওসমানের মেয়ে আফরিন ওসমানের স্বামী হওয়ায় ওসমান পরিবারের সকল অপকর্মে জড়িত ছিলেন ইফতে খায়রুল ইসলাম।
নাসিম ওসমানের জামাতা হওয়ার সুবাদে প্রশাসন সহায়তা করেছে ওসমান পরিবারকে। সেই সাথে ওসমান পরিবারের রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে পুলিশ বাহিনীতে ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করেছিলেন ইফতেখারুল।
মাহাবুবুল ইসলাম মিলন এবং ইফতেখারুল ইসলাম এর অবৈধ আয়ের সিংহভাগ অস্ট্রেলিয়ায় পাচার করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে বিদেশে পাচার করার পরও দেশে নামে বেনামে অসংখ্য প্লট, ফ্ল্যাট সেই সাথে বহুতল একাধিক ভবন, কাঁচা বাজার ও মার্কেট কমপ্লেক্স এর মালিকানা।
নারায়ণগঞ্জে তাদের নিজ এলাকাসহ আশেপাশের বিভিন্ন স্থানে মাহাবুবুল ইসলাম মিলনের অবৈধ অঢেল সম্পদ থাকার সত্যতা মিলে অনুসন্ধানে।
নারায়ণগঞ্জ শহরের গলাচিপা রোডে সুগন্ধা বেকারের পেছনে সাড়ে ৫ শতাংশ জমিরসহ ছয় তলা বিল্ডিং, নারায়ণগঞ্জের প্রাণকেন্দ্র চাষাড়া অবস্থিত নারায়ণগঞ্জ কমার্স কলেজের মালিকও এই মিলন। অভিযোগ রয়েছে গলাচিপা এলাকায় মিলনের শ্বশুরবাড়ির ৫ তলা বাড়িটিও করে দিয়েছেন মিলন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের রয়েল ক্যাপিটাল নারায়ণগঞ্জ স্টক এক্সচেঞ্জ হাউসটির মালিকও তিনি। এছাড়াও চাষাড়া রামবাবুর পুকুর পাড়ে ৮ কাঠা জমিসহ ছয় তলা বাড়ি, বন্দর কলাগাছিয়ায় বিশাল কাঁচা বাজারের শতাধিক দোকান, বন্দর ফরাজীকান্দায় অর্ধশত দোকানসহ বিশাল মার্কেট রয়েছে। মদনগঞ্জ কবরস্থানের পাশে দেড় একর জমি, বন্দর উপজেলার পাশে কয়েক একর খালি জমি, উত্তর চাষাড়ায় কয়েকটি বাড়ি ও আত্মীয়স্বজনদের নামেও নিজের নামে অস্ট্রেলিয়ায় দুইটি বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছে বলে জানা যায় অনুসন্ধানে। এছাড়াও অন্যের সম্পদ জবরদখল করে রাখার সত্যতা ও মিলেছে অনুসন্ধানে।
মদনগঞ্জ এলাকার সৈয়দ আলী সরকারের ১২ শতাংশ দখল করে নেওয়ার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে এখনো তাদের পরিবারের দাপটে মুখ খুলতে ভয় পান ভুক্তভোগী পরিবার।নারায়ণগঞ্জের বন্দরে নাসিম ওসমান সেতু পার হয়ে ফরাজিকান্দা কাঁচাবাজারের মালিক পারভেজকে ব্যাপক মারধর করে বাজারটি দখল করে নেওয়ার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।
জানা যায়, ইফতে খাইরুলের স্ত্রীর আফরিন ওসমান ও আজমিরি ওসমানের স্ত্রী সাবরিনা ওসমানের নামে বাজারের দলিল করে নেয় দুর্নীতিবাজ এই জেলার ও তার ভাই। পারভেজের বড় ভাই জানান বাজারের অবৈধ দখল নিতে ইফতে খাইরুলের নির্দেশে পারভেজকে গুলি করা হয়।ছাত্র জনতার আন্দোলনের শেষ মুহূর্তে এ জেলার গা ঢাকা দিয়েছিলেন। কর্মস্থলে যোগ দেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ একাধিকবার কৈফিয়ত চেয়ে পত্র প্রেরণ করলেও তিনি কর্মস্থলে যোগদান করেননি বলে কারা অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে।
জেলার মাহবুব এর দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে অনেকেই হারিয়েছেন চাকরি। তাদের মধ্যে একজন কারারক্ষী লোকমান হোসেন। লোকমান জানান মাহবুবের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলায় তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে মাহাবুবুল ইসলাম।ঢাকা কারা অধিদপ্তর এর সহকারী কারা-মহাপরিদর্শক জান্নাতুল ফরহাদ জানান, মিলন অন্যায়ভাবে অধিবাস করায় তার বিরুদ্ধে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো ৩ আগস্ট থেকে জেলার মাহবুব পলাতক থাকলেও ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে জেলার মাহাবুবকে উপ-তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে পদোন্নতি সূত্রে বদলি করা হয়।তারা কর্তৃপক্ষ যখন পলাতক মাহবুবকে খুঁজে পাচ্ছেন না তখন তাকে পদোন্নতি দেওয়া প্রমাণ করে কতটা শক্তিধর হাসিনা সরকারকে মা সম্বোধনকারী মাহবুব। এই মাহবুব এর সকল অপকর্মে যিনি সহায়তা করেন চট্টগ্রাম রেঞ্জ কারা ডিআইজি টিপু সুলতান।
আওয়ামী লীগের সহযোগী টিপু সুলতান ২০২৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে যোগদান করেন। ৫ আগস্ট এর পরে ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগী অনেক সরকারি কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হলেও টিপু সুলতান এখনো স্বপদে রয়েছেন।এই টিপু সুলতানের প্রভাবে পলাতক জেলার মাহবুবুলকে পদোন্নতি দেয়া হয়।
এই টিপু সুলতান সম্প্রতি মিডিয়া শিরোনাম হন বন্দীদের কাছে ১০০ টাকা লিটার দুধ বিক্রি করে। এই টিপু সুলতান হলেন পলাতক চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের সাবেক ডিআইজি নূরে আলম মিনার মামা। নূরে আলম মিনার আরেক ভাই নূরে এলাহী মিনা ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি হিসেবে কর্মরত ছিলেন ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগ সরকারের।টিপু সুলতান কর্তৃক কারাগারে আটক আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের অবহিত সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ করেছেন ৫ আগস্ট এরপর কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া বন্দিরা।
এসব বিষয়ে জানতে চেয়ে চট্টগ্রাম রেঞ্জ কারা ডিআইজি টিপু সুলতানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলেননি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মাহবুবুল ইসলামকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে গত বছরের ১২ মে কুমিল্লা কারাগারে বদলি করা হয়। তবে তিনি শেখ হাসিনার কাছের লোক কারা অধিদপ্তরে প্রভাব খাটিয়ে ঢাকাতেই থেকে যান।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পূর্বে গত বছরের ৩ আগস্ট পারিবারিক কারণ দেখিয়ে তিনি পাঁচ দিনের ছুটি নেন। এরপরে আবার শারীরিক অসুস্থতার অজুহাতে তিন মাসের ছুটি চেয়ে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে ইমেইল প্রেরণ করেন। তিন মাসের মেয়াদ ও গত বছরের ৮ নভেম্বর শেষ হয়েছে বলে জানা যায়। মাহাবুল ইসলাম এরপরেও কারা অধিদপ্তরের সাথে কোন রকম যোগাযোগ করেনি বলে জানা গেছে।
শেখ হাসিনা পতনের পর ইফতে খাইরুল ইসলামের ও বদলি হয় আর্ম এপিবিএন এ। তবে তিনি কর্মস্থলে যোগদান করেনি বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। তার মোবাইল ফোন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফোন করে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে পুলিশ সদর দপ্তরের গণসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার সহকারি মহাপরিদর্শক এনামুল হক সাগরের সাথে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
শেখ হাসিনাকে মা পরিচয় দেওয়া মাহবুবুল ইসলাম মিলন ও ইফতে খাইরুল এর বিরুদ্ধে সরকার কোন পদক্ষেপ না নিলেও নিজেদের অপকর্মের আতঙ্কে নিজেরাই রয়েছে আত্মগোপনে। দুর্নীতি এবং আওয়ামী ক্ষমতার প্রভাবে এ দুই ভাই এর অবৈধ সকল সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা সহ দখল করে রাখা সকল সম্পদ প্রকৃত মালিকদের কাছে হস্তান্তর করতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে স্থানীয়রা।