
এস এম রানা, বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ, তানভীর আহমেদ টিটু, ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান এবং জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের কানুনগো এবিএম হাবিব উল্লাহ
শামীম ওসমান ও তার শ্যালক তানভীর রহমান টিটু-এর ছত্রছায়ায় থেকে জমি দখল, চাঁদাবাজি, লুটতরাজ, গুম-খুন ইত্যাদি বিভিন্ন অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত ছিলো এস এম রানা। তার এসব অপকর্মে শামীম ওসমান, তার শ্যালক তানভীর আহমেদ টিটুসহ একটি বিরাট চক্রের বিষয়ে অনুসন্ধানে প্রমাণ পেয়েছেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন কদম রসুল অঞ্চল কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থার জন্য ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন প্রকল্পে এস এম রানা, বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ, ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান এবং জনৈক নজরুল ইসলামের মালিকানাধীন অপ্সরা হোল্ডিং এর এক অভিনব উপায়ে রাষ্ট্রের অর্থ লোপাটের প্রমাণ মিলেছে। এই ক্ষেত্রেও সম্প্রতি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রূপগঞ্জে জমি অধিগ্রহণ কাজে ব্যাপক দুর্নীতিতে জড়িত থাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের কানুনগো এবিএম হাবিব উল্লাহ’র নামও আলোচনায় এসেছে। জুলকারনাইন সায়ের বলেন, এ যেন সংঘবদ্ধ এক অপরাধ চক্র! পার্থক্য হলো এরা ক্রিকেটার হিসেবে সমাজে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছেন।
দু’দিন আগে জানিয়ে ছিলাম, কিভাবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) এর সভাপতি, পলাতক সন্ত্রাসী এস এম রানা'কে বিসিবির অর্থে পাঁচ তারকা হোটেল এবং বিমান টিকিট প্রদান করেছিলেন। এর জবাবে গতকাল ফারুক যমুনা টেলিভিশনকে বলেছেন এস এম রানাকে তিনি একজন ‘সাবেক ক্রিকেটার’ হিসেবে চেনেন। এবং ক্রিকেটের বাইরে রানা'র সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে ভিন্ন তথ্য।
বিশ্বস্ত সূত্রের দেয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে অগ্রসর হতেই প্রকাশ পেয়েছে ফারুক আহমেদ, এস এম রানা, সাকিব আল হাসান এবং জনৈক নজরুল ইসলামের মালিকানাধীন অপ্সরা হোল্ডিং এর এক অভিনব উপায়ে রাষ্ট্রের অর্থ লোপাটের প্রমাণ।
শামীম ওসমান চক্রের মদদে ফারুক-রানা-সাকিব-অপ্সরা হোল্ডিং চক্র আগেই জেনে নিতো কোন জমি, ভূমি অধিগ্রহণ শাখা হতে অধিগ্রহণ করা হবে। এবং এরা সকলে মিলে সেসকল জমি প্রভাব খাটিয়ে আগেই কম দামে কিনে ফেলতো। এবং পরবর্তীতে ওই একই জমি যখন সরকার অধিগ্রহণ করতো তখন ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে অধিগ্রহণ শাখা হতে জমির আসল মূল্যের বহুগুণ টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে তুলে নিত।
এরকম একটি ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশন-ভূমি সার্ভেয়ার কাওসারকে হাতে নাতে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে ফারুক-রানা-সাকিব-অপ্সরা হোল্ডিং চক্রের নাম যেন সামনে না আসে, তাই সার্ভেয়ার কাওসারের উপরেই সকল দোষ চাপিয়ে দেয়া হয়। এস এম রানা ও শামীম ওসমান শ্যালক টিটুর সহায়তায় ফারুক আহমেদ-সাকিব আল হাসান ভূমিদস্যুতে পরিণত হয়েছিলেন।
বিভিন্ন ছলেবলে কৌশলে, বায়না করে, আসল ওয়ারিশদের বাদ দিয়ে এরা বিভিন্নভাবে অধিগ্রহণ হতে পারে এমন জমি দুর্নীতিবাজ সরকারী কর্মকর্তাদের মদদে আগেই জেনে নিতো, এবং শক্তি-ভয়ভীতি প্রদর্শণ করে তা নাম মাত্র মূল্যে কিনে নিজ দখল প্রতিষ্ঠা করতো। পরবর্তীতে ওই একই জমি সরকারের ভূমি অধিগ্রহণ কর্তৃপক্ষের কাছে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন, ২০১৭ এর ধারা ৯ অনুযায়ী (সরকার জমি অধিগ্রহণ করলে ওই এলাকার জমির ১২ মাসের গড় মূল্যের সাথে আরও অতিরিক্ত ২০০ ভাগ ক্ষতিপূরণ পায় জমির মালিক। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে জমির গড় মূল্যের ৩০০ ভাগ। অর্থাৎ সরকার নিজের প্রয়োজনে ৫০০ টাকার মূল্যের জমি অধিগ্রহণ করলে জমির মালিক পাবে ১৫০০ টাকা ৩ গুণ, বেসরকারি (চার গুণ) বিক্রি করতো।
প্রসঙ্গত, শামীম ওসমান ও তার শ্যালক তানভীর রহমান টিটু-এর ছত্রছায়ায় থেকে জমি দখল, চাঁদাবাজি, লুটতরাজ, গুম-খুন ইত্যাদি বিভিন্ন অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত ছিলো এস এম রানার সাথে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি ফারুক আহমেদের সখ্যতা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা তৈরি হয়। বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের। তিনি তার ফেসবুক পেজে রানা ও ফারুক আহমেদের সখ্যতা ছবি জুড়ে দিয়ে লেখেন, কিছু ঘটনা সিনেমার স্ক্রীপ্ট'কেও হার মানায়। পুলিশ হন্য হয়ে খুঁজছিলো, এমন এক অপরাধীকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) এর অফিসিয়াল বানিয়ে রেডিসন হোটেলে রুম এমনকি চট্টগ্রাম-ঢাকা যাতায়াতের বিমানের টিকিট পর্যন্ত প্রদান করে বিসিবি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিসিবির বর্তমান সভাপতি ফারুক আহমেদের সাথে বিশেষ সখ্যতা রয়েছে নারায়ণগঞ্জের চিহ্নিত ভূমিদস্যু ও ওসমান পরিবার ঘনিষ্ঠ এসএম রানা'র। দু'জনকে একসাথে কয়েকটি ম্যাচেও দেখা যায়। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সময় নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সামনে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য করে গুলিবর্ষণ এবং হামলা, গুম-খুনের অভিযোগ রয়েছে এই রানার বিরুদ্ধে (নারায়ণগঞ্জ সদর ও ফতুল্লা মডেল থানায় রানা'র মামলার নং যথাক্রমে ১২/২৭-০৮-২৪ এবং মামলা নং ১৮ -২২-আগস্ট -২০২৪)।
জানা যায়, ফারুকের সরাসরি নির্দেশে এসএম রানা'কে বিসিবি অফিসিয়াল হিসেবে দেখিয়ে রেডিসন হোটেলে ৩০ অক্টোবর-১ নভেম্বর ২০২৪ দু’রাত রাখা হয়, যার খরচও বহন করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। আবার একই ব্যক্তিকে বিমানের টিকিটও দেয় বিসিবি। আর এই সকল ঘটনা ঘটে যখন এস এম রানা একজন ফিউজিটিভ।
পরবর্তীতে এসএম রানাকে ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ১৯ ফেব্রুয়ারি দুপুরে দুবাই যাওয়ার চেষ্টাকালে তাকে আটক করা হয়। এবং পরে তাকে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। শামীম ওসমান ও তার শ্যালক তানভীর রহমান টিটু-এর ছত্রছায়ায় থেকে জমি দখল, চাঁদাবাজি, লুটতরাজ, গুম-খুন ইত্যাদি বিভিন্ন অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত ছিলো এস এম রানা।
বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ কেন এসএম রানার মতো একজন অপরাধীকে ক্রিকেট বোর্ডের অর্থে আতিথেয়তা প্রদান করলেন? আর কি উদ্দেশ্যে তাকে বিসিবি অফিসিয়াল হিসেবে উল্লেখ করা হলো?
উল্লেখ্য, এসএম রানার বিরুদ্ধে জমি দখল, অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। ফতুল্লার পঞ্চবটি থেকে মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুর পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় ভূমি অধিগ্রহণের বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। স্থানীয়দের অভিযোগ, ভূমি মালিকদের ভুল তথ্য দিয়ে তাদের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে জমির মালিকদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে জমির দখল নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। স্থানীয়রা দাবি করেন, তিনি বিভিন্ন কৌশলে জমির মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করে পরে জোরপূর্বক তাদের জমি নিজের নামে লিখিয়ে নিতেন। এর আগে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ৪২ লাখ টাকা উদ্ধারকাণ্ডে তার নাম উঠে এসেছিল। তবে সেই সময় তিনি আইনি প্রক্রিয়ার ফাঁকফোকর দিয়ে রেহাই পেয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।