ফতুল্লা স্টেডিয়ামে বালু ভরাট নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম ওসমান দোসরদের

যুগের চিন্তা রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

ফতুল্লা স্টেডিয়ামে বালু ভরাট নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম ওসমান দোসরদের
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেন্যুগুলোর মধ্যে একটি খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়াম। এটি দেশের মানুষের কাছে ফতুল্লা স্টেডিয়াম হিসেবে পরিচিত। ফতুল্লা স্টেডিয়াম হিসেবে পরিচিত স্টেডিয়ামের প্রকল্পটির শুরুতে নাম ছিলো ওসমানী স্টেডিয়াম-২। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড়ের পাশে ফতুল্লার রামারবাগে ২৭ একর জমি উপর স্টেডিয়ামটির নির্মাণ প্রকল্প শুরু করা হয়।
১৯৯১-১৯৯৫ সালের বিএনপি আমলে অর্থ বরাদ্দ করে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। ১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বরাদ্দ হয় ৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। টাকা বরাদ্দ হলেও স্টেডিয়ামের কাজ শুরু করতে পারেনি ঠিকাদার। ঠিকাদার কাজ করতে এলে শামীম ওসমানের ক্যাডাররা ককটেল ফাটিয়ে ধাওয়া করে ঠিকাদারকে। পরে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা মৃণাল কান্তি দে এই স্টেডিয়ামের কাজের ঠিকাদারি পান। সাবকন্ট্রাক্ট দেন সে সময় প্রথমবার এমপি হওয়া শামীম ওসমানকে।
ক্ষমতায় আসার পরই শামীম ওসমান তার প্রভাব খাটিয়ে স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করে তার দাদা খান সাহেব ওসমান আলী’র নামে নামকরণ করেন। স্টেডিয়ামটির টেন্ডার অনুযায়ী গড়ে জায়গাটিতে বারো ফুট বালি ফেলার কথা থাকলেও তারা গড়ে ছয় ফুট বালি ফেলেন। গড়ে ছয় স্কয়ার ফুট বালি না ফেলেই তারা বিল উত্তোলন করেন। এ টাকা উত্তোলনের সুবিধার্থে তারা স্টেডিয়ামকে মূল ডিজাইন উপেক্ষা করে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে আরো পশ্চিমে সরিয়ে নেন।
কারণ স্টেডিয়ামের জন্য নির্ধারিত জায়গার রাস্তার পাশের অংশে পনেরো ফুটেরও বেশি গভীর ছিলো। অন্যদিকে পশ্চিম দিক আগে থেকেই ভরাট ছিলো। পশ্চিম দিক ছিলো ‘তক্কার মাঠ’ এর অংশ। যেখানে আগেই স্থানীয় খেলা হতো। স্টেডিয়াম তৈরীর সময় তিন ধাপে এর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু প্রথম ধাপে ব্যাপক দুর্নীতির কারনে পরের দুই ধাপের অর্থ বরাদ্দ বাতিল করা হয়। প্রতিবছর স্টেডিয়াম সংস্কারের জন্য টাকা আসলেও সে টাকা ব্যবহার না করে বিল করে টাকা খেয়ে ফেলার অভিযোগ রয়েছে শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে।
২০০০ সালে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানাধীন রামারবাগ এলাকায় নির্মিত আন্তর্জাতিক এই ভেন্যু নিয়ে শুরুতে জেলাবাসীর মধ্যে আগ্রহের কমতি ছিল না। এই ভেন্যুর কল্যাণেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েছিল ফতুল্লা তথা নারায়ণগঞ্জের নাম। এই স্টেডিয়াম অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ, এশিয়া কাপ, বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়ার স্মরণীয় টেস্টসহ বেশ কিছু হাইভোল্টেজ ম্যাচের সাক্ষী হয়ে আছে এটি। তবে অযত্ন, অবহেলা ও অব্যবস্থাপানার ফলে পরিত্যক্ত রূপ ধারণ করেছে প্রায় ২৫ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন আন্তর্জাতিক এই ভেন্যুটি।
এই মাঠে সর্বশেষ বাংলাদেশের বিপক্ষে একমাত্র প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার কথা ছিল ক্রিকেট বিশ্বের পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়ার। কিন্তু পানিতে ডুবে থাকায় এই মাঠ ডেভিড ওয়ার্নার-স্টিভেন স্মিথদের আতিথেয়তা দিতে পারেনি। এক পর্যায়ে স্টেডিয়ামটি ব্যাপক জলাবদ্ধতায় পড়ে যায়। অথচ স্টেডিয়ামের পাশে কালভার্ট নির্মাণের জন্য দুইবার টাকা আসলেও কাজ না করেই সে টাকা উত্তোলন করা হয়। সর্বশেষ স্টেডিয়ামের জলাবদ্ধতা নিরসনে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও সামান্য বালি ফেলা ছাড়া আর কোনো কাজই হয়নি।
এছাড়াও গত পনেরো বছরে এই স্টেডিয়ামের জলাবদ্ধাতা নিরসনের জন্য কোটি টাকার বরাদ্দের বেশিরভাগ অংশ শামীম ওসমান, তার শ্যালক সাবেক বিসিবি পরিচালক তানভীর আহাম্মেদ টিটু সহ তার নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট লুটপাট করে খেয়েছে। স্টেডিয়ামটি শামীম ওসমান ও তার শ্যালক তানভীর আহমেদ টিটুর ছিলো টাকার গাছ।
সর্বশেষ গত ২০২৩ সালে স্টেডিয়ামটিতে বালু ভরাটের বরাদ্দ আসে। কিন্তু সেই বালু ভরাটের কাজটি ৬-৭ জন ঠিকাদার নেওয়ার জন্য সার্কুলার জমা দিলেও সেই কাজটি অল্প টাকার পান তানভীর আহমেদ টিটুর আস্থাভাজন ক্রিকেটার শেখ মো.আব্দুল্লাহ আল মাসুদ (রানা)। শেখ মো.আব্দুল্লাহ আল মাসুদ রানা নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলার কাশিপুর বড় মসজিদের শেখ নাজিম উদ্দিনের ছেলে। বিগত সরকার আমলে ক্রিকেট বোর্ডে তার ব্যাপক পরিচিতি ছিলো। তানভীর আহমেদ টিটু ও এস.এম রানার সাথে ছিলো তার অন্য রকম সর্ম্পক।
তাদের আর্শিবাদেই আলিফ এন্টারপ্রাইজ এর নামে বালু ভরাটের কাজটি তিনি পান। কিন্তু গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামীলীগ সরকার পালিয়ে গেলে সেই স্টেডিয়ামের কাজও বন্ধ হয়ে পরে। পরে ফতুল্লা থানা বিএনপি নেতা রিয়াদ মোহাম্মদ চৌধুরীকে নিয়ে সেই বালু ভরাটের কাজটি করেন ঠিকাদার। কিন্তু গত ১৫ মে রিয়াদ চৌধুরী গ্রেফতার হলে ১৬ মে আবার তার বিরুদ্ধে সেই বালু ভরাটের ঠিকাদার একটি চাঁদাবাজি মামলা করেন।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ্যে অনেকে জানান, ফতুল্লা স্টেডিয়ামটির বালু ভরাটের যে কাজ পেয়েছে সবাই আওয়ামীলীগের দোসর। তানভীর আহমেদ টিটু ছত্রছায়া তার আস্থাভাজনরা কাজটি পায়। পরে তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলে সেই কাজ বিএনপি নেতা রিয়াদ মোহাম্মদ চৌধুরীকে দেয়। তারা সকলেই এই ফতুল্লা স্টেডিয়ামের কাজ নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি করে।
এ বিষয়ে ঠিকাদার শেখ মো.আব্দুল্লা আল মাসুদ (রানা) যুগের চিন্তাকে বলেন, আমি স্টেডিয়ামের বালু ভরাটের কাজটি আলিফ এন্টার প্রাইজ এর নামে পায়। আলিফ এন্টার প্রাইজ নামে আমার একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেই সময় কাজটি পাওয়ার জন্য ৫-৭ জন টেন্ডার সার্কুলার জমা দেয়। কিন্তু আমি মাস্টার্স ক্রিকেটার বলে বোর্ডে আমার পরিচিতি রয়েছে। তাই অল্প রেটে তারা আমাকে কাজটি দিয়েছে। আমার ৬০ লক্ষ ঘন ফুট বালু ভরাট করার কথা ছিলো। আমি ২৬ লক্ষ ঘন ফুট থেকে একটু কম ভরাট করেছি।
এ দিকে ড্রেজারের সঙ্গে জড়িয়ে রিয়াদ চৌধুরীকে হয়রানি করা হচ্ছে বলে তার সমর্থকদের। তাদের দাবি, ফতুল্লা স্টেডিয়ামের সংস্কার কাজের জন্য বালু ভরাট কাজে ব্যবহৃত ড্রেজার লাইনের বুস্টার, পাইপ বিনা বাঁধায় ড্রেজারের মালিক পক্ষ বুঝে নেয়ার পরও, মিথ্যা অভিযোগ এনে ফতুল্লা থানা বিএনপির সদ্য সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াদ মো. চৌধুরীর বিরুদ্ধে একটি চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করা হয়েছে। তারা দাবি করছে, ফতুল্লা স্টেডিয়ামে বালু ভরাট কাজের সঙ্গে ড্রেজারের মালিক পক্ষের সঙ্গে রিয়াদ মো. চৌধুরীর কোন যোগসূত্র নেই।
তাদের বক্তব্য, বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের সময়ে গডফাদার শামীম ওসমানের শ্যালক বিসিবির পরিচালক তানভীর আহমেদ টিটুর সহযোগী শহরের নিতাইগঞ্জ এলাকার এসএম রানার ব্যবসায়ী পাটনার শেখ মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন রানাকে ফতুল্লা স্টেডিয়াম ভরাটের দায়িত্ব দেয়া হয়। ৫ আগস্টে সরকারের পতনের পর, ঠিকাদারের খোঁজ না মেলায় স্টেডিয়ামে বালু ভরাটের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে টেন্ডারের মাধ্যমে বিসিবি রিয়াদ মো. চৌধুরীকে বালু ভরাটের দায়িত্ব প্রদান করে এবং তিনি সেটা গ্রহণ করেন।
সম্প্রতি এই সংক্রান্ত মামলা প্রসঙ্গে রিয়াদ চৌধুরীর সমর্থকদের ভাষ্য, মামলায় বালু ভরাটে ব্যবহৃত ১ কোটি টাকা মূল্যের ড্রেজার, বুস্টার, পাইপ চুরির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। যদি চুরি করা হয়, তাহলে গত ১৯ মে প্রকাশ্যে ড্রেজারের মালিক তাঁদের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি ও কর্মচারীদের দিয়ে ড্রেজার, বুস্টার, পাইপ তাঁদের নিজস্ব পরিবহনের মাধ্যমে সরিয়ে নিয়েছে।