আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢালে আ.লীগের বেফাঁস মন্তব্য
লতিফ রানা
প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢালে আ.লীগের বেফাঁস মন্তব্য
# ২০১৮ সালে আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা বলেন মতিয়া চৌধুরী
# ২০২৪ সালে শেখ হাসিনাও রাজাকারের বাচ্চা বলে মন্তব্য করেন
# আত্মস্বীকৃত রাজাকারদের জবাব ছাত্রলীগ দিবে বলে জানান ওবায়দুল কাদের
কোটা সংস্কারের দাবি দীর্ঘদিনের হলেও তা প্রকাশ্যে আসে ২০১৩ সালে। তবে সে সময়ের আন্দোলন দমিয়ে অনেকটাই দক্ষতার পরিচয় দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু ২০১৮ সালে নতুন করে একই দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন নেতাদের বেশ কিছু বক্তব্য আরও বেগবান করে তুলে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা। এমনকি আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা বলে ও সম্বোধন করা হয় বিভিন্ন সময়।
যার ফলে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ে এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেকটা ক্ষোভের সাথেই কোটা বাতিলের ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। তাদের মতে, ২০২৪ সালে আদালত কর্তৃক কোটা বাতিলের ঘোষণা স্থগিত করার পর পুনরায় শুরু হওয়া আন্দোলনেও তা মীমাংসার দিকে নজর না রেখে সরকার কঠোর হস্তে দমনে মনোনিবেশ করলে হিতে বিপরীত হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের ডাকে প্রথমে ৯ দফা, পরে তা কমিয়ে ৮ দফা, পরে তা আরও কমিয়ে ৫ দফা সর্বশেষ তা সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে রূপ নেয়। বিশ্লেষকদের মতে এর মধ্যে দলীয় নেতাদের বেফাঁস মন্তব্য সেই আন্দোলনে ঘি ঢালার অবস্থা তৈরি হয়। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শিক্ষার্থীদের রাজাকারের বাচ্চা বলে সম্বোধন করলে শিক্ষার্থীরাও নিজেদের রাজাকার বলতেও কুন্ঠিত হন না। একটা সময় যে রাজাকার শব্দটি বাংলাদেশীরদের মধ্যে একটি গালি হিসেবে ব্যবহার হতো, সেই শব্দটিকেই শিক্ষার্থীরা তাদের নামের সাথে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহার বলে স্লোগান দিতে থাকে।
বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ সালের কোটা সংস্কারের আন্দোলনের সময়ও সরকারের বিভিন্ন নেতাদের মুখ থেকে শিক্ষার্থীদের নিয়ে উস্কানীমূলক ভাষা ব্যবহার করে আক্রমণ করা হয়। ’১৮-এর ৯ এপ্রিলে তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সংসদ অধিবেশনে এক বক্তৃতায় ক্ষোভের সাথে বলেন, ‘যারা জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, তাদের ছেলে মেয়ে বা বংশ, তারা সুযোগ পাবে না, রাজাকারের বাচ্চারা সুযোগ পাবে! তাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংকুচিত করতে হবে’!
এরপর কোটা সংস্কার আন্দোলন আরও তীব্র হলে আন্দোলনকারীদের চাপের মুখে ১১ এপ্রিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘কোটা থাকলেই সংস্কার। আর না থাকলে সংস্কারের কোন ঝামেলাই নাই। কাজেই কোটা পদ্ধতিরই দরকার নাই। ঠিক আছে বিসিএস যেভাবে পরিক্ষা হবে, মেধার মাধ্যমে সব নিয়োগ হবে। এতেতো কারও আপত্তি থাকার কথা না’! যদিও শিক্ষার্থীদের দাবি কোটা বাতিলের পক্ষে ছিল না। তাদের দাবি ছিল কোটা সংস্কারের পক্ষে। প্রধানমন্ত্রীর সেই বক্তব্যে দাবি মেনে নেওয়ার চেয়ে ক্ষোভ প্রকাশই বেশি ছিল বলে মনে করা হয়।
তবে এরপরও কোটা সংস্কারে সরকার কার্যকরী কোন ভূমিকা না রাখলে এবং শিক্ষার্থীদের দমনে ছাত্রলীগকে মাঠে নামালে সেই আন্দোলন ক্রমেই সহিংসতায় রূপ নেয়। সে সময় শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা দেওয়ার পরও কোটা বাতিল না হওয়ার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলে ’১৮-এর জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করতে দেরি হওয়ার বিষয়ে সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা কোটা সংস্কার করবো, আমি চেয়েছিলাম টোটাল বাদ দিতে। তবে হাইকোর্টের রায় আছে। হাইকোর্টের রায়তো কেউই অবমাননা করতে পারে না”। এরপর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোটা বাতিলের ঘোষণা দেয় সরকার।
২০২৪ সালের ৫ জুন যখন নতুন করে কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন বাতিল করে রায় প্রদান করেন আদালত। তখন দেশজুড়ে আবারও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে শিক্ষার্থীরা। সে সময় কোটা বিরোধী আন্দোলন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামে পরিচিতি পায়। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ২০২৪ সালে ১৪ জুলাই দু’জন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “কোটা আর মেধাতো এক জিনিস না, এটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করার একটি টেকটিস।
তার মানে কি ? মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, নাতিপুতিরা মেধাবী না, যত রাজাকারের বাচ্চারা, নাতিপুতি হলো মেধাবী” ! প্রধানমন্ত্রীর এই রাজাকারের বাচ্চা গালিটিকে কোন অবস্থাতেই মেনে নিতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। এরপরই শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিতে শুরু করেন, “তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে, সরকার সরকার”। যা শুধু বাংলাদেশই না, হতবাক করে পুরো বিশ্বকে। এর পরের দিন ১৫ জুলাই শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের কটাক্ষ করে বলেন, “নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জা হয় না”।
অন্যদিকে ১৪ জুলাই তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “সংস্কার আন্দোলনের কতিপয় নেতা যে সব বক্তব্য এনেছে তার জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগসহ যারা এই আত্মস্বীকৃত রাজাকার যারা নিজেদের ঔদ্বত্যপূর্ণ মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছে। তার জবাব তারাই দিবে”। এভাবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমাতে ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দেয়। এরপর ছাত্রলীগের দমন পীড়নের মাত্রা বহুগুণে বেড়ে যায়।
২০২৪ সালের ১৮ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করার বিষয়ে তৎকালীন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক বলেন, সরকার দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করেনি, ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে ১৭ জুলাই থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত টানা ১১ দিন মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করার বিষয়েও মিথ্যে তথ্য দেন তিনি। এই সময়ের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রচুর হতাহতের ঘটনা ঘটে বলে ভিপিএন ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তথ্যচিত্র উঠে আসে।
এসব বেফাঁস মন্তব্য এই আন্দোলনকে দমন বা স্তিমিত করার বদলে আন্দোলনের মাত্রা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। যা পরবর্তীতে সরকার পতনসহ সরকার প্রধান ও দলীয় নেতা কর্মীরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হতে ভূমিকা রাখে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।


