Logo
Logo
×

বিশেষ সংবাদ

রাজাকার স্লোগানে উত্তাল সারাদেশ

Icon

লতিফ রানা

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম

রাজাকার স্লোগানে উত্তাল সারাদেশ

রাজাকার স্লোগানে উত্তাল সারাদেশ

Swapno

২০২৪ সালের ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের সামনের আন্দোলন থেকে হঠাৎ করেই যেনো ভেসে আসে “তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার” স্লোগানটি। আর এই স্লোগানটি-ই যেনো বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ব্যানারে চলা কোটা বিরোধী আন্দোলনের বারুদে আগুন ধরিয়ে দেয়।


একদিকে এই স্লোগানই পরে পুরো দেশজুরে ছড়িয়ে পড়ে অন্যদিকে এই স্লোগানটি সরকারের আত্মসম্মানে অনেকটা কাঁটার মতো বিঁধে। সেদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্দোলনকারীদের রাজাকারে বাচ্চা ও নাতিপুতি বলে আখ্যায়িত করার পর থেকেই শিক্ষার্থীদের আঁতে ঘা লাগে এবং সবাইকে গণহারে রাজাকার বলায় এই শব্দটিকেই তারা নিজেদের স্লোগানের টার্গেট করে নেয়। বিশ্লেষকদের মতে এই স্লোগান ’২৪-এর গণ অভ্যুত্থানের আন্দোলনের বারুদে অনেকটা আগুনের মতো কাজ করে।


আর এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে একদিকে আন্দোলনকারীদের আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে সরকারের রাগ, ক্ষোভ ও দমন প্রক্রিয়ার মাত্রাও ম্যাজিকের মতো বৃদ্ধি পায়। সচেতন মহলের মতে, আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর থেকে রাজাকার শব্দটিকে যে অর্থে ব্যবহার করা হতো, শেখ হাসিনার রাজাকার ট্যাগ এবং শিক্ষার্থীদের স্লোগান সেই অর্থই যেন পাল্টিয়ে দিলো। যে শব্দটি অত্যাচারী, বেঈমান, দেশদ্রোহী ও দালাল হিসেবে ব্যবহৃত হতো, একদিনের মধ্যে সেই শব্দটি একটি কমন বিশেষণে রূপান্তরিত হয়ে গেলো।


বিভিন্ন মাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্য মতে, কোটা সংস্কারের জন্য শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময় আন্দোলন করলেও ২০২৪ সালের আন্দোলনের মাত্রা দেশ জুড়ে একটি ভিন্ন মাত্রা পায়। বিশেষ করে ২০১৮ সালে কোটা বাতিলের পরও বিভিন্ন নাটকীয়তায় ২০২৪ সালে তা পুনরায় যুক্ত হওয়ায় দেশ জুড়ের শিক্ষার্থীদের মনে ব্যাপক দাগ কাটে।


একটা সময় তার শিক্ষার্থীদের গন্ডি পেরিয়ে অভিভাবক শ্রেণিসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের মনেই বিষয়টি নাড়া দেয়। তাই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ব্যানারে চলা এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে গণ পদযাত্রার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে স্মারক লিপি প্রদানে বঙ্গভবনে হাজির হয় কোটা সংস্কার আন্দোলনের হাজার হাজার শিক্ষার্থী।


প্রথমে পুলিশের ব্যরিকেড ভেঙ্গে অবস্থান নেয় নূর হোসেন চত্বরে, পরে সেখান থেকে আবারও পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে অবস্থান করে বঙ্গবন্ধু চত্বরে। তারপর সেখান থেকে আন্দোলনের ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল পুলিশের নিরাপত্তায় স্মারক লিপি প্রদানের উদ্দেশ্যে বঙ্গভবনে যায়। সেখানে তাদের স্মারকলিপি গ্রহণ করেন সামরিক সচিব। এরপর পরবর্তী ২৪ ঘন্টার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তারপরের করনীয় বিষয় ঠিক করবেন বলে জানায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।


একই দিন রাতে চীন সফরের বিষয়ক এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্ন উত্তর প্রদানের সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের উপর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “শিক্ষার্থীদের সংবিধান ও আইন নিয়ে ধারণা না থাকায় তারা এই আন্দোলনে নেমেছে। তিনি বলেন, বিষয়টি যেহেতু আদালতে চলে গেছে, সেখানে যেহেতু রায় হয়েছে, সেই রায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আমার কোন এখতিয়ার নাই।


তিনি আরও বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার তাদের কে দিয়েছে ? কোটা এবং মেধাতো এক জিনিস না। এই দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা একটি টেকটিস। তার মানে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নাতিপুতিরা কেউ মেধাবী না, যত রাজাকারের বাচ্চারা, নাতিপুতি হলো মেধাবী ! তারা আদালত মানে না, আইন মানে না, সংবিধান কি তা তারা চিনে না, একটা সরকার কিভাবে চলে এই সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা বা জ্ঞানই তাদের নাই।


এর পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের সামনে থেকে প্রথমে “তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার” স্লোগানটি শোনা যায়। তারপর যেন অনেকটা বিদ্যুৎ গতিতেই তা ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। একদিকে কিছুক্ষণ আগেই শেখ হাসিনার ট্যাগ করা এমন মন্তব্য তখন তরুন শিক্ষার্থীদের মনে ছুড়ির মতো বিঁধে।


তাই এই স্লোগানটি কানে যাওয়ার পরই যেন তাদের শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়, রক্তে আগুন ধরিয়ে দেয়। তাইতো কোন প্রকার রাখ-ডাক না রেখেইে তারা ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার’ বলে স্লোগান দিতে থাকে। একই সাথে ‘কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ বলে তারা তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।  


রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, কোটা পুরোপুরি বাতিলের দাবি করেনি শিক্ষার্থীরা। তাদের আন্দোলন ছিল কোটা সংস্কারের জন্য। এই যৌক্তিক দাবিতে করা আন্দোলনে সরকারের মধ্যস্থতায় সমাধানের অনেক উপায়ই ছিল। শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি ন্যূনতম সহনুভূতি দেখিয়ে তা হয়তো খুব সহজেই মিটিয়ে ফেলা যেতো।


কিন্তু বিগত বছরগুলোতে সরকারের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের দমনে স্টীম রোলার পন্থায় সফলতা পাওয়ায় সেই কঠোরতাকেই একমাত্র পন্থা হিসেবে মনে করেছিল সরকার। তাদের মতে বিষয়টি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার মতো বিষয়। যে জন্য শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন ও কর্মসূচীকে সরকার প্রধানসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের মন্ত্রী ও কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ পর্যায়ের নেতা কর্মীরাও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ এবং উপহাসের মাধ্যমে হাস্যকর কার্যক্রমে আখ্যায়িত করার অপচেষ্টা চালায় সর্বত্র।


তবে কথায় বলে ‘অহংকারই পতনের মূল’। তাইতো দেশের বাঘা বাঘা রাজনৈতিক দলগুলো যখন সরকারের চাপে অস্তিত্ব সংকটে ভোগে, উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সাধারণ পর্যায়ের নেতা কর্মীরা যখন কোনঠাসা হয়ে নিজ দেশে পরবাসীর মতো জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত হতে বাধ্য হয়। তখন শিক্ষার্থীদের এক কোটা আন্দোলনে বোল্ড আউট হয়ে সেই জাঁদরেল সরকারের উইকেটের পতন ঘটে। ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher
ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন