আবু সাঈদের মৃত্যুতে ফুঁসে ওঠে পুরো দেশ
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে চলা টানা দেড় মাসের আন্দোলনের মাত্রা ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হয় ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই। সেই আন্দোলনে একদিকে কোটা বিরোধী শিক্ষার্থীরা। তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে একযোগে কাজ করে পুলিশ বাহিনী, বিজিবি, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সশস্ত্রবাহিনী।
এর আগে ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর রাজাকার ট্যাগ দিয়ে বক্তব্য দেওয়ার পর আন্দোলনের তীব্রতা বাড়লেও ১৬ জুলাই রংপুরের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের বুক চিতিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়াসহ কমপক্ষে ৬ জন শিক্ষার্থীর মৃত্যু এবং অর্ধশতাধিক গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থীর আহতের খবরে আন্দোলন কোটা বাতিলের দাবি থেকে সরে সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপান্তর ঘটে বলে বিশ্লেষকদের অভিমত। এই দিন-ই বন্ধ ঘোষণা করা হয় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্থগিত করা হয় এইচএসসি পরিক্ষা। আন্দোলনের তীব্রতায় মাঠে নামে বিজিবি। আন্দোলনে যোগদান করেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।
বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনরত সকল শিক্ষার্থীকে গণহারে রাজাকার ট্যাগ দিয়ে মন্তব্য করলে বিষয়টি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আত্মসম্মানে আঘাত লাগে। ছাত্রদের দাবি, একটি যুক্তিযুক্ত দাবি দমাতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যদি প্রকাশ্য মিডিয়ায় তাদের রাজাকার আখ্যায়িত করতে পারে তাহলে তারা সেই রাজাকার ট্যাগ মাথায় নিয়েই আন্দোলন করতে রাজি।
এমনকি ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ স্লোগানে তাদের আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ১৫ জুলাই তাদের আন্দোলন দমাতে পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলা নির্যাতনসহ প্রকাশ্যে গুলি করা এবং শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার প্রতিবাদে ১৬ জুলাই তাদের আন্দোলন একটি ভিন্ন মাত্রা পায়। ১৬ জুলাই কোটা আন্দোলনে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশ বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
এ সময় তারা আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। এদিন দুপুরের পর রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে প্রথম বাধা দেয় ছাত্রলীগ। এরপর শুরু হয় পুলিশের এ্যকশন। এ সময় পুুলিশের সরাসরি গুলিতে নিরস্ত্র অবস্থায় বুক চিতিয়ে মারা যায় রংপুরের পীরগঞ্জ এলাকার আবু সাঈদ। সে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল।
ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় আবু সাঈদের সামনে একটি পুলিশ দল ফায়ার করছে। এ সময় কোন প্রকার অস্ত্র ছাড়া হাতে একটি লাঠি জাতীয় কিছু নিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল আবু সাঈদ। পুলিশ তখন তাকে টার্গেট করে একাধিক গুলি ছুড়ে এবং ঘটনা স্থলে ঢলে পড়ে আবু সাঈদ। পরে তার সহযোদ্ধারা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করে চিকিৎসক।
১৬ জুলাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা ছাত্রলীগের হামলার ভয়ে উপাচার্যের বাসভবনের ভেতরে আশ্রয় নেন। সেখানে ঢুকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মারধর করে ছাত্রলীগ। এই দিন আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে আন্দোলনে যোগদান করেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা।
আন্দোলনে অংশ নেয় মিরপুর ১০-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজিসহ মিরপুরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা।
বিকেল ৪টার দিকে চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের হামলায় নিহত হয় তিনজন। এর মধ্যে একজন চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী, একজন এমইএস কলেজের শিক্ষার্থী এবং অন্যজন পথচারী। বিকেলে ঢাকা কলেজের সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সংঘর্ষের এক যুবক নিহত হন। তাকে পিটিয়ে মারা হয়েছে বলে জানা যায়।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠান) এবং পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোর শ্রেণি কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধের ঘোষণা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এদিন রাতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ঘোষণা করে যে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সারাদেশে সকল সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকবে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে আবাসিক হলগুলো খালি করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয় কমিশন।
এদিকে ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) পালিত হতে যাচ্ছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের শাহাদতবার্ষিকী ও ‘জুলাই শহীদ দিবস’। জুলাই শহীদ দিবসের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন। আজ বুধবার (১৬ জুলাই) বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা স্মারক মাঠে শহীদ আবু সাঈদের শাহাদতবার্ষিকী ও ‘জুলাই শহীদ দিবস’ পালন করা হবে।
দিনটিকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, অনুষ্ঠানে আবু সাঈদের বাবা থাকবেন প্রধান অতিথি। এই দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি থাকবেন অন্তর্র্বতী সরকারের চার উপদেষ্টা। তারা হলেন আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার,
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বীরপ্রতীক। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এসএমএ ফায়েজ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের এবং ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. তানজীমউদ্দীন খান।
জুলাই শহীদ দিবসের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকাল সাড়ে ৬টায় পীরগঞ্জ উপজেলার জাফরপাড়ার বাবনপুর গ্রামের উদ্দেশে ক্যাম্পাস থেকে যাত্রা, সাড়ে ৭টায় শহীদ আবু সাঈদের কবর জিয়ারত, সোয়া ৯টায় কালো ব্যাজ ধারণ ও শোকর্যালি, ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ আবু সাঈদ তোরণ ও মিউজিয়ামের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, সোয়া ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন শহীদ আবু সাঈদ চত্বরে শহীদ আবু সাঈদ স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, সাড়ে ১০টায় আলোচনা সভা, বিকেল সাড়ে ৩টায় চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা এবং বাদ আসর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল।
জুলাই শহীদ দিবস পালন কমিটির আহ্বায়ক ড. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আবু সাঈদ আমাদের গর্ব। আবু সাঈদের শাহাদাতবার্ষিকী আমরা অন্যভাবে নিয়েছি। সারাদেশের জাতীয় প্রোগ্রাম এটি। সারা বাংলার চোখ কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে থাকবে। এজন্য আমরা প্রোগ্রামের কোনো ঘাটতি রাখিনি।’


