২০২৪’র ১৯ জুলাই সরকারের কিলিং মিশনে প্রাণ হারায় অর্ধশত
লতিফ রানা
প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
ফিরে দেখা : ২০২৪’র ১৯ জুলাই সরকারের কিলিং মিশনে প্রাণ হারায় অর্ধশত
শিক্ষার্থীদের কমপ্লিট সাটডাউনের ধারাবাহিক কর্মসুচীতে ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই দেশজুড়ে চলছিল তান্ডব। দেশ জুড়ে এই একদিনের সহিংসতায় ৫০ জনেরও বেশি লোকের নিহত হওয়ার খবরা পাওয়া যায়। যার মধ্যে ঢাকা শহরেই কমপক্ষে ৩৬ জন নিহত হয়েছে বলে জানা যায়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় হেলিকপ্টার থেকেও আন্দোলনকারীদের উপর হয় শুরু গুলি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগের সামনে গুলিতে ক্ষতবিক্ষত হওয়া আন্দোলনকারীদের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠে। সেই আন্দোলন তখন আর শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। দেশের প্রায় সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণে এই আন্দোলনের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করে।
তাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন হয়ে দাঁড়ায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন। অন্যদিকে ছাত্র জনতাকে প্রতিহত করতে ইন্টারনেট বন্ধ করে কিলিং মিশনে নামে ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সংগঠনের ক্যাডারগণ। তাদের সাথে যোগ দেয় পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, সোয়াদ, ডিবিসহ বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনী। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় প্রচার মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে খবর না আসলেও বিভিন্ন বিকল্প উপায়ে ভিডিও ধারণসহ তথ্য প্রচার ব্যবস্থা চালু রাখার চেষ্টা চালিয়ে যায় আন্দোলনকারীসহ সংশ্লিষ্টরা। রাতের বেলা আটক করা হয় সমন্বয়ক নাহিদ ও ভিপি নূরকে।
এর আগে জুলাইয়ের শুরু থেকে ধারাবাহিকভাবে চলা আন্দোলনে ১৬ জুলাই ৬ জনকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রাণহানির ঘটনা। প্রতিদিনই মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় আগের দিনের তুলানায়। বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে রক্তে লাল করে দিতে শুরু করলো শিক্ষার্থীসহ সাধারণ জনগণ, তার সাথে সাথে লম্বা হতে থাকে মৃতদেহের তালিকা। বাংলাদেশের রাক্তাক্ত ইতিহাসের তালিকায় ১৯ জুলাইয়ের দিনটিও থাকবে কলঙ্কিত হয়ে।
১৯ জুলাই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন রোধ করতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ধরনের সভা-সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে ঢাকার সাথে সারাদেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।
১৮ জুলাইয়ের ধারাবাহিকতায় ১৯ জুলাইতেও সারাদেশে সকল ধরনের ইন্টারনেট বন্ধ করে রাখা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুবি বিভাগে মিছিলে মিছিলে আসতে থাকে বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া আহত শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সেখানে পুলিশ ও ছাত্রলীগের ক্যাডারদের বাধায় চিকিৎসা নিতে পারেনি আহতরা।
এইদিনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক অবরোধে আন্দোলনকারীরা দুপুরের দিকে কিশোরগঞ্জের ভৈরব থানা ঘেরাও করলে থানার ভেতর থেকে পুলিশ সদস্যরা ছররা গুলি ছুঁড়ে। ঢাকার উত্তরা, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা পল্টনসহ কয়েকটি এলাকায় সারাদিন দফায় দফায় সংঘর্ষ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। মিরপুরে জুমার নামাজের পর বেলা তিনটার দিকে কাজীপাড়া, শ্যাওড়াপাড়া এবং মিরপুর ১০, সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে তুমুল সংঘর্ষ।
বিকেলের দিকে ঢাকার রামপুরা থানা ঘেরাও করে শিক্ষার্থীরা। বিকেলে মিরপুর ১৪ নম্বরে অবস্থিত বিআরটিএ ভবনে আগুন দেয় বিক্ষোভকারীরা। এদিন সারাদেশে কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েনের ঘোষণা করে সরকার। মধ্যরাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে আটক করা হয়। এছাড়া গণঅধিকার পরিষেদের সভাপতি নুরুল হক নুরকেও আটক করা হয়। এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন প্রতিনিধির সাথে সরকারের তিনজন মন্ত্রীর বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও সেখানে শিক্ষার্থীদের দেওয়া আট দফা দাবি নিয়ে দেখা যায় মতবিরোধ।
১৯ জুলাই বিকেলে নরসিংদী শহরের ভেলানগরের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে অবস্থিত জেলা কারাগারে হামলা করে কয়েক হাজার লোক। সেখানে গিয়ে তারা প্রথমে ইট-পাটকেল, পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে। তবে সেই হামলায় কোন সাধারণ শিক্ষার্থীদের দেখা যায়নি বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়।
সেখানে হামলাকারীদের প্রায় সবার হাতেই লাঠিসোঁটা, দেশীয় অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল বলেও জানা যায়। এ সময় কারারক্ষীরা তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে তাদের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ ধরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। একটা সময় কারারক্ষীরা পিছু হটলে হামলাকারীরা কারাগারের দুই দিকের ফটকের কিছু অংশ ভেঙে ভেতরে ঢুকে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় আন্দোলনকারীরা কারাগার থেকে ৭০টি অস্ত্র এবং ৬,০০০ গুলি লুটপাট করে।


