গাজীর পোষা বিড়াল এমদাদ কোথায়?
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক বছর হতে চলল। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগ কী পরিমাণ দুর্বৃত্তায়ন চালিয়েছে তা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার দিকে তাকালে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে। ক্ষমতার মসনদে থেকে গোটা রূপগঞ্জ উপজেলাকে গিলে খেয়েছেন সাবেক বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। তার এইসব কাজের নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক মন্ত্রী গাজী এপিএস এমদাদুল হক ওরফে চাঁদাবাজ এমদাদ।
গাজীর হয়ে ঝুট, বালু, হাউজিং কোম্পানির জমি কেনা-বেচা, রেজিষ্ট্রি অফিস, উপজেলা পরিষদ সব কিছু ছিল এই এমদাদের হাতে। স্থানীয়দের তথ্য মতে, শুধু চাঁদাবাজি থেকেই মাসে এমদাদের আয় ছিল ৫ কোটি টাকার উপরে। গোটা রূপগঞ্জ লুটপাটের নেতৃত্ব দেয় এই চাঁদাবাজ এমদাদ। এমদাদের এসব কাজে সহায়ক হিসেবে ছিলো জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য আনছর আলী ও ভোলাব ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন টিটু। এই সিন্ডিকেট গোটা রূপগঞ্জবাসীর আতঙ্ক হিসেবে পরিচিত ছিল।
রূপগঞ্জে গাজী ভয়ংকর সন্ত্রাসী, ভূমিদস্যু হিসেবে পরিচিত হলেও মন্ত্রণালয়ে ছিলেন তার এপিএসের ‘পোষা বিড়াল’। মন্ত্রণালয়ে তিনি যখন যেতেন, তখন সারাক্ষণ পাশে বসে থাকতেন তার সহকারী একান্ত সচিব এমদাদুল হক। এমদাদুল হক তাকে মন্ত্রণালয়ে নিয়ে যেতেন, বসাতেন, এমনকি যে কোনো ফাইল স্বাক্ষরের আগে এমদাদ দেখে দিতেন। এমদাদের ক্লিয়ারেন্স ছাড়া কোনো ফাইল স্বাক্ষর করতেন না গোলাম দস্তগীর গাজী।
মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ এবং নীতিনির্ধারণী বৈঠকগুলোতে মন্ত্রীর পাশে বসতেন এমদাদ। মন্ত্রী বসে ঝিমাতেন, কখনো ঘুমিয়ে পড়তেন। এমদাদই মন্ত্রীর ভূমিকা পালন করতেন এসব বৈঠকে। শেষে বলতেন ‘এপিএস সাহেব যেভাবে বলেছে, সেভাবেই করুন। ’ এ নিয়ে আমলাদের মধ্যেও ছিল দারুণ অস্বস্তি ও ক্ষোভ।
গতবছরের ৫ আগষ্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার পতনের পর গত ২৪ আগস্ট রাজধানীর শান্তিনগরের বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। বর্তমানের তিনি কয়েকটি হত্যা মামলায় কারাগারে আছেন। পট-পরিবর্তনের একবছর পরেও গাজীর সেই কুখ্যাত এপিএস এমদাদের কথা রূপগঞ্জবাসীর মুখে মুখে।
তারা বলছেন, চাঁদাবাজ এমদাদ ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পর কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকলেও এখন পর্দার অন্তরালে থেকে বিএনপির কয়েক নেতার সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে চাঁদাবাজি ও লুটপাটের হারানো সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। শুন্য থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া এমদাদ রাজধানী ঢাকাতেই লুকিয়ে আছে বলে জানিয়েছে সূত্র।
সূত্র জানিয়েছে, গত ১৬ বছর শুন্য থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া চাঁদাবাজ এমদাদ কোথায় তা জানা আছে তার দুই বিশ্বস্ত সহযোগী জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য আনছর আলী ও ভোলাব ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন টিটুর। সূত্র জানায়, গত মার্চে অতিরিক্ত মদ্যপানে সে অসুস্থ হয়ে গেলে টিটু ও আনছর আলীর মাধ্যমে উত্তরার একটি হাসপাতালে কয়েকদিন ভর্তিও ছিলেন।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, প্রশাসনের নাগের ডগায় মন্ত্রী গাজীর ঘাড়ে চেপে কুকীর্তি সামাজ্য গড়ে অঢেল টাকা লুটপাটের নেপথ্য কারিগর চাঁদাবাজ এমদাদকে কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছেনা। সাবেক মন্ত্রী গাজীর কুকর্মে সহযোগী চাঁদাবাজ এমদাদ, আনছার আলী এবং আলমগীর হোসেন টিটুকে গ্রেপ্তার করলে তাদের সকল অপকর্মের তথ্য ও লুটপাট করা অর্থের উৎসের সংবাদ পাওয়া যাবে বলে মনে করে রূপগঞ্জবাসী। প্রশাসন কেন তাদের গ্রেপ্তার করছেনা এনিয়েও নানা মুখরোচক কথা চলছে রূপগঞ্জ উপজেলায়।
স্থানীয় জানান, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে অঘোষিত মন্ত্রী ছিলেন তার এপিএস এমদাদুল হক। এমদান যেখানে সিদ্ধান্ত দিতো বাকিদের আর তেমন কিছু করার ছিলনা। এমদাদের প্রভাবের উৎস ছিল মন্ত্রীর ব্যক্তিগত দুর্বলতা ও গোপন তথ্য বিশেষত নারী কেলেঙ্কারি ও ভিডিও ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগ। পাশাপাশি, রূপগঞ্জের চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ করেএমদাদ গাজীর নির্বাচনি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেন, যার ফলে বিনা ভোটে এমপি হওয়া সহজ হয়ে উঠেছিল।
সূত্র জানিয়েছে, মন্ত্রণালয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল ও বস্ত্রকল পানির দামে বিক্রির অভিযোগ রয়েছে গাজীর বিরুদ্ধে। এসব বিক্রির পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেন এমদাদ। কথিত আছে, প্রকল্পের নামে বরাদ্দ কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। যেমন, ‘প্লাস্টিক বিকল্প প্রকল্পে’ ৫৭০ কোটি টাকা বরাদ্দের কোনো বাস্তব কাজ হয়নি; পুরো অর্থ গাজী তুলে নেন।
একই সময়ে রূপগঞ্জে গড়ে ওঠে এমদাদ বাহিনীর ভয়ংকর ত্রাসের রাজত্ব। স্থানীয়ভাবে চিহ্নিত সন্ত্রাসী শমসের আলী, শেখ ফরিদ মাসুম, আলী বান্দা, তোফায়েল আলমাছ, মামুন মিয়া, রনি মিয়ারা সরাসরি এমদাদের ছত্রছায়ায় বিভিন্ন অপকর্মে যুক্ত ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে হত্যা, চাঁদাবাজি, অস্ত্র ও মাদক কারবারসহ বহু মামলা, যদিও অনেকেই এখনো পলাতক।
গতবছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রূপগঞ্জের পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও, এলাকাবাসী এখনো অতীতের আতঙ্ক স্মরণ করে কেঁপে ওঠেন। রূপগঞ্জ ছাড়াও সিরাজগঞ্জেও এমদাদের প্রভাব ছিল বলেও জানা গেছে। তিনি সেখানে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আওয়ীমী লীগ সরকার পতনের পর থেকে গা ঢাকা দিয়ে আছে চাঁদাবাজ এমদাদ ও তার সহযোগীরা। তবে আড়ালে থেকেই ভিন্ন লোক মারফত এখনো পুরোনো রাজত্ব কায়েমের নীলনকশা করেছেন এমদাদের সহযোগীরা। স্থানীয়রা দ্রুত এমদাদসহ গোটা সিন্ডিকেটের সদস্যদের গ্রেপ্তার করতে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
চলতি মাসের ৮ জুলাই জালিয়াতি, প্রতারণা, হুন্ডি, কমিশন গ্রহণসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর প্রায় ৪৮৮০ শতাংশ জমি এবং স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের সিনিয়র স্পেশাল জজ এই ক্রোকাদেশ প্রদান করেন।
সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের আবেদনের ভিত্তিতে এ আদেশ দেওয়া হয়। সিআইডি জানায়, নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানার খাদুন এলাকায় ৬৯টি দলিলের আওতায় থাকা জমির দলিল মূল্য প্রায় ১৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা হলেও সেখানে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা ও অবকাঠামোসহ মোট সম্পদের বাজারমূল্য প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। গাজীর অপরাধ সাম্রাজ্য পরিচালনার মূল নায়ক এমদাদের সম্পত্তি ক্রোক এবং তাকে গ্রেপ্তার জানিয়েছে রূপগঞ্জবাসী।
কীভাবে এমদাদ এতো সম্পদের মালিক হলেন
সূত্র জানিয়েছে, এক যুগের বেশি সময় ধওে সাবেক বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ছিলেন এমদাদুল হক ওরফে দাদা এমদাদ। এই সময় বিপুল সম্পদের মালিক হন তিনি। রাজধানীতে নামে-বেনামে গড়েছেন স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ। শুরু করেছেন ড্রেজার ব্যবসা।বিনিয়োগ করেছেন আবাসন ব্যবসায়ও। রূপগঞ্জে জমি দখল, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা সব কিছুতে তাঁর হাত আছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে এলাকায় চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন।
এপিএস এমদাদ ছিলেন মন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাধর।তাঁকে টাকা না দিলে এলাকায় নিরাপদে চলা দায় হতো। চাঁদা না দিলে গাড়ি চলে না, বন্ধ থাকতো কলকারখানা। রূপগঞ্জের বালু ব্যবসা থেকে শুরু করে মাদকের ব্যবসা সব ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রণে। ফেসবুকে দেখা যায়, এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের প্রায় সবার সঙ্গে তাঁর ছবি আছে। ২০১৯ সালের ৬ আগস্ট এক প্রজ্ঞাপনে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের সহকারী একান্ত সচিবদের (এপিএস) ষষ্ঠ গ্রেডে বেতন নির্ধারণ করা হয়। ষষ্ঠ গ্রেড অনুযায়ী একজন এপিএস সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬৭ হাজার ১০ টাকা বেতন গ্রহণ করতে পারেন। সর্বোচ্চ বেতন হিসাব করলে এমদাদুল হক গত ১৫ বছরে এক কোটি ২১ লাখ টাকা বেতন উত্তোলন করেছেন।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ বনশ্রী জামে মসজিদ-৪-এর সঙ্গে লাগোয়া উঁচু দেয়ালঘেরা ভবনটি এমদাদুল হকের। কে ব্লকের ১৩/৩ নম্বর রোডের ৩০/বি-৩০/সি বাড়ি রযেছে এমদাদের। এই ভবনটির দায়িত্বে রয়েছেন এমদাদুল হকের গাড়িচালক রাজ্জাক। বাসাবোতে একটি ১০ তলা বাড়িতে এমদাদের রয়েছে আটটি ফ্ল্যাট। একই এলাকার ছয়তলা আরেকটি ভবনে রয়েছে দুটি ফ্ল্যাট।
সূত্র জানিয়েছে, ৩৬ নম্বর উত্তর বাসাবোর বেস্ট লিভিং লিমিটেডের বেস্ট বেয়ারেক লিভিং অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন এমদাদ। অ্যাপার্টমেন্টটির কয়েকজন জানান, ওই অ্যাপার্টমেন্টে এমদাদের ফ্ল্যাট রয়েছে দুটি। তিনি থাকতেন পাঁচতলায়। স্থানীয়রা বলছেন, বেস্ট বেয়ারেক লিভিং অ্যাপার্টমেন্টের প্রতিটি ফ্ল্যাটের দাম প্রায় দেড় কোটি টাকা। আবাসন ব্যবসায়ও বিনিয়োগ করেন এমদাদ। রিমঝিম আবাসনের ১৫ শতাংশ শেয়ার এমদাদের নামে ছিল। এ ছাড়া রূপগঞ্জের বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প থেকেও নামে-বেনামে প্লট নেন তিনি।
সূত্র জানায়, গ্রামে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েন এমদাদ। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর পৌরসভার দরগাহপাড়া গ্রামের মন্টু মিয়ার ছেলে এমদাদুল হক দাদুল। এক যুগের কিছুদিন আগেও ছিলেন অতি সাধারণ মানুষ। সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সঙ্গে থেকে কয়েক বছরে শাহজাদপুরে কয়েক কোটি টাকার জায়গা, বাড়ি ও মার্কেট গড়ে তুলেছেন। মন্ত্রীর পিএস হওয়ার পর তিনি আধা বিঘা জমির ওপর একটি টিনশেড বাড়ি ক্রয় করেন। সেখানে অট্টালিকা তোলার পরিকল্পনা ছিল এমদাদের।
এর পরের বাড়িটি তাঁর পৈতৃক বাড়ি। বাড়িটি আধাপাকা। সেই বাড়িতে তাঁর ফুফাতো ভাই থাকেন। গ্রামে গেলে এমদাদ এই বাড়িতে থাকতেন। শাহজাদপুরের দ্বারিয়ারপুর পাতিলপট্টিতে বিশাল একটি মার্কেট আছে এমদাদের। মাঝখানে সাদা তিনতলা ভবন। ভবনসহ ওই মার্কেটে অন্তত ২২টি দোকান আছে। দ্বারিয়াপুর দক্ষিণে কয়েক কোটি টাকা দিয়ে আরো একটি ভবন কিনে ভাড়া দেয় এমদাদ । প্রায় ৩ শতাংশ জায়গার ওপর পাঁচতলা ভবনের দোতলা পর্যন্ত করে ভাড়া দেয়া আছে। স্থানীয়রা জানান, এমদাদের স্ত্রী ও স্ত্রীর ভাইয়ের নামেও সম্পদ কিনেছেন তিনি।
রূপগঞ্জের স্থানীয়রা জানান, রূপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় তিতাস গ্যাসের বিতরণ লাইন থেকে নিম্নমানের পাইপ টেনে সেখান থেকে অবৈধ গ্যাসের সংযোগ দিয়েছেন এমদাদ। এই সংযোগ দিতে এমদাদ তিতাসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ প্রতিটি এলাকার স্থানীয় সন্ত্রাসীদের দিয়ে গড়ে তোলেন একটি চক্র। এই অবৈধ সংযোগের ফলে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারায় সরকার।
রূপগঞ্জে এমদাদের ব্যবস্থাপনায় প্রায় দেড় লাখ আবাসিক ও ব্যাণিজিক গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ আছে। এর মধ্যে তারাব বেড়িবাঁধ, মোগরাকুল, বরাব, খাদুন, মৈকুলী, খিদিরপুর, নয়াপাড়া, বড়ভিটা, আরাফাতনগরসহ ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের আশপাশের বেশির ভাগ ভবন ও কারখানায় এই সংযোগ দেয়া হয়। স্থানীয়দের বরাতে জানা গেছে, প্রতিটি আবাসিক সংযোগে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা এককালীন দিতে হয়। সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলে আবারও কিছু টাকা দিলে পুনরায় সংযোগ পাওয়া যায়। তবে আবাসিক সংযোগে গ্যাসের চাপ বুঝে সর্বনিম্ন দুই থেকে ১৫ লাখ টাকাও দিতে হয়।
সূত্র জানায়, সাবেক মন্ত্রীর এপিএস হওয়ায় রূপগঞ্জের স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে সখ্য বাড়ে এমদাদের। ধীরে ধীরে রূপগঞ্জের ড্রেজার ও বালুর ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেন তিনি। রূপগঞ্জের যুবলীগের সভাপতি কাউসারের তত্ত্বাবধানে দুটি ড্রেজার পরিচালন কারেন। এই দুটি ড্রেজার থেকে বর্তমানে ভোলাব, কুতুবপুর, মোচারতালুক মৌজায় রিমঝিম আবাসনে বালু ভরাটের কাজ করেন।
এমদাদের দাপটের কারণে হাইকোর্টে রিট করেও এই বালু ভরাট বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এর আগে সাধারণ জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে ড্রেজারে আগুন লাগিয়ে দেয় কাঞ্চন পৌর মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সামসুন্নাহারের নামে এমদাদের ড্রেজার চলে আমেরিকান সিটিতে। আর ইস্টউড সিটিতে একটি ডেজার চালানো হয় এমদাদের। রূপগঞ্জের যত ড্রেজার রয়েছে, তার থেকে উত্তোলিত বালুর দামের ৫ শতাংশ মন্ত্রীর এপিএস এমদাদকে দিতে হতো।
স্থানীয়রা জানান, রূপগঞ্জের বিভিন্ন ইউনিয়নের মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণও দাদা এমদাদের হাতে। পুলিশের হাতে কোনো মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার হলেই ছাড়াতে ফোন দিত এমদাদ। সূত্র জানায়, ভোলাব ইউনিয়নের মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রক যুবলীগ সভাপতি কাউসার প্রধান, কাঞ্চনে বাছির ও শাহিন মিয়া (লোহা শাহিন)। দাউদপুর, রূপগঞ্জ ইউনিয়ন ও কায়েতপাড়ার চনপাড়ায় শমসের আলী ওরফে ডাকু শমসের, তারাব, গোলাকান্দাইল, ভুলতা, মুড়াপাড়ায়ও ছিল তার দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক। এসব মাদক ব্যবসায়ী থেকে মাসে প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি টাকা চাঁদা তুলতেন এমদাদ।
এছাড়া সূত্র জানায়, ভুলতা গাউছিয়ার ফুটপাতে চার শতাধিক দোকান থেকে দৈনিক ১৫০ থেকে ২০০ টাকা চাঁদা তুলতো এমদাদের নিয়ন্ত্রিত ছাত্রলীগ-যুবলীগের ছেলেরা। চাঁদা না দিলে পিটিয়ে এলাকা ছাড়া করে দিত সন্ত্রাসীরা। এ ছাড়া সিলেট, গাজীপুর, মদনপুর ও ঢাকার সংযোগ সড়কের বিভিন্ন স্ট্যান্ডের পরিবহন থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলার কাজে ছিল এমদাদের লোকেরা। প্রতিদিন গাড়িপ্রতি সর্বনিম্ন অটো ৫০ টাকা সর্বোচ্চ ১০০ টাকা চাঁদা দিতে হয় চালকদের।
সরেজমিনে জানা যায়, রূপগঞ্জ স্ট্যান্ডে সিএনজি অটোরিকশা, লেগুনা ও ভাড়ায়চালিত প্রাইভেট কার রয়েছে যথাক্রমে প্রায় ২৭০টি, ২৫০টি ও ৮০টি। প্রতিটি সিএনজি থেকে দৈনিক ৫০ টাকা, লেগুনা ৬০ টাকা, প্রাইভেট কার থেকে ১০০ টাকা চাঁদা সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া মাসিক এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা এককালীন চাঁদাও দিতে হতো।
সূত্র জানায়, এমদাদের ছত্রচ্ছায়ায় শীতলক্ষ্যা নদীর সীমানা পিলার সরিয়ে ভূমি দখল করে সন্ত্রাসীরা। সূত্র বলেছে, গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক সেতুর উভয় পাশের নদীর তীর দখল করে নেয় এমদাদ ও তাঁর বাহিনী। রূপগঞ্জের মঠের ঘাট, দড়িকান্দি, বানিয়াদি, আতলাশপুর, হাটাব জেলেপাড়া, ইছাখালি, পাড়াগাঁও, বড়আলু, পূর্বগ্রাম, চনপাড়া, রূপসী, গন্ধবপুরের নদীর দুই পাশের জমি দখল করে বিভিন্ন কম্পানির কাছে বিক্রি করা হয়। বিভিন্ন কোম্পানির দখলে আছে এসব জমি।
একদিকে গাজীর লুণ্ঠন, অন্যদিকে এমদাদের অবাধ লুটপাট দুই মিলিয়ে এক ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এবং একই সঙ্গে রূপগঞ্জে। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় অপেক্ষাকৃত ছোট এবং গুরুত্বহীন এক মন্ত্রণালয়। এই ছোট্ট মন্ত্রণালয়ে গোলাম দস্তগীর গাজী দায়িত্ব গ্রহণ করে একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন পাটকল, বস্ত্রকল পানির দামে বিকিয়ে দিয়েছেন। এসব পাটকল এবং বস্ত্রকলের সবচেয়ে লোভনীয় ব্যাপার ছিল জমি। ধরা যাক বন্ধ থাকা একটি পাটকলের জমির মূল্যই ১০০ কোটি টাকা।
সে পাটকল গাজী-এমদাদের কারসাজিতে বিক্রি করা হয় ১০ কোটি টাকায়। যিনি কেনেন তিনি অনায়াসে ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকা দিয়ে দিতেন মন্ত্রীর এপিএসকে। বিভিন্ন প্রকল্পের নামে টাকা আত্মসাৎ করেছেন গাজী অবাধে। এসবই হয়েছে এমদাদের পরিকল্পনায়। বাংলাদেশ জুটমিল করপোরেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কে নিয়োগ হবে, কে প্রকল্প পরিচালক হবে-সবই এমদাদের নির্দেশে হতো। বিভাগীয় প্রধান হওয়ার জন্য আগে এপিএস এমদাদের আস্থা অর্জন করতে হতো।
বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা নিয়ে পুরোটাই আত্মসাৎ করেছেন গাজী-এমদাদ জুটি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্লাস্টিক বিকল্প প্রকল্পের কথা। এই প্রকল্পের প্রাথমিক গবেষণার জন্য ৫৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। পুরো টাকাই গাজী তুলে নিয়েছিলেন এবং কোনো কাজই হয়নি। মুখ্য গবেষককে জোর করে বাধ্য করা হয়েছে স্বাক্ষর প্রদানের জন্য এবং এই টাকা পুরোটাই গাজী কুক্ষিগত করেছেন। এরকম বহু প্রকল্পের উদাহরণ দেখা যায় যে প্রকল্পগুলো একনেকে পাস করানো হয়েছে। প্রকল্প কাগজে আছে কিন্তু বাস্তবে নাই।
২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পুরো সময় এই মন্ত্রণালয়ে শুধু লুটপাটই হয়েছে, কোনো কাজ হয়নি। একদিকে পাটকল বিক্রি, অন্যদিকে বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের মাধ্যমে গাজী প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এই টাকার সবই তদারকি করতেন এমদাদ। গাজী শুধু পুতুল ছিলেন মাত্র। মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি গাজীর নির্বাচনি এলাকাতেও মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন এমদাদ। এলাকার চিহ্নিত দাগি অপরাধীদের নিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। এ সময় এমদাদ এলাকায় ঘুরতেন সশস্ত্র অবস্থায়। ভয়ংকর এমদাদ বাহিনীর ত্রাসের কারণে জিম্মি ছিল এলাকাবাসী। নিরীহ মানুষের জমি দখল, খুন, গুম, ধর্ষণসহ গুরুতর সব অপরাধ করে বেড়াতেন বাহিনীর সদস্যরা।
রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেউ কেউ আইনের আশ্রয় নিলেও কোনো লাভ হয়নি। উল্টো মামলা করতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের রোষানলে পড়তে হয়েছে অভিযুক্তদের। গাজীর ছত্রছায়ায় রূপগঞ্জে এমদাদ গড়ে তোলেন নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী। এমদাদের বাহিনীতে ছিল জেঞ্জারম্যান শমসের আলীসহ দাগি সব সন্ত্রাসী। যাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ছিল অসংখ্য মামলা। জানা গেছে, রূপগঞ্জের চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র এলাকার হাসমত দয়ার ছেলে শমসের আলী খান ওরফে ডাকু শমসের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল।
কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শমসেরের বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজি ও মাদকের একাধিক মামলা রয়েছে। রূপগঞ্জ থানায় হওয়া ১৩টি মামলার আসামি ছিলেন তিনি। ২০১৮ সালে ইউপি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এলাকায় প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি, গুম, খুন, মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তার হাতে। চনপাড়ার বাসিন্দাদের মাদক, অস্ত্র কারবারসহ নানা অপকর্মে যুক্ত হতে বাধ্য করেন। এখন এসব সন্ত্রাসীরা আত্মগোপনে। মাছিমপুর এলাকার আফসার উদ্দিনের ছেলে তাওলাদ মেম্বার।
এলাকায় নানা অপরাধকাণ্ড করে ত্রাস সৃষ্টিকারী। ‘এমদাদের লোক’ পরিচয়ে অপকর্ম করে বেড়িয়েছেন। রূপগঞ্জ থানায় তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ডাকাতি, হত্যার উদ্দেশ্যে মারধর, অবৈধ অস্ত্র বহন এবং মাদকের দুটি মামলা রয়েছে (নম্বর ১১(১০)২২ ও ২২(৮)২৩)। সোনারগাঁ থানায় আছে আরও একটি মামলা এবং সাধারণ ডায়েরি (জিডি)। কিন্তু ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগের পতনের পরও এসব মামলার কোনো অগ্রগতি নেই। তবে এমদাদ বাহিনীর লোকজন এখনো পলাতক।
এই এলাকার জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে শেখ ফরিদ মাসুমও নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। এলাকায় মাদক ও অবৈধ অস্ত্র কারবারি হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন সময় সরকারি ও সাধারণ মানুষের সম্পদ লুটপাটের বিস্তর অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। এসব অপরাধের পাশাপাশি চাঁদাবাজি ও হত্যার হুমকির দায়ে রূপগঞ্জ থানায় রয়েছে চারটি মামলা (নম্বর ৯৯(৫)১৮, ২৭(৬)১৬, ৪১(২)০৩ ও ৩৫(১০)০৬)। তিনি উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকেরও দায়িত্ব পালন করছিলেন। এই মামলার তদন্তের কোনো অগ্রগতি নেই।
পূর্ব কালাদী গ্রামের সুরুজ মিয়া মুন্সীর ছেলে মো. আলী হোসেন ওরফে আলী বান্দা এমদাদের ছত্রছায়ায় নানা অপকর্ম করেন। তার বিরুদ্ধে রূপগঞ্জ থানায় একটি মামলা রয়েছে (নম্বর ৩৮(১২)২২)। এলাকার একাধিক মানুষ তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় ভূমি দখল, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ করেন।
রূপগঞ্জ উপজেলার মুড়াপাড়া ইউনিয়নে আরেক আতঙ্কের নাম ছিল তোফায়েল আহমেদ আলমাছ। তার বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগে মামলা রয়েছে। মুড়াপাড়ার শিল্পপতি রাসেল পার্কের স্বত্বাধিকারী রাসেল ভুঁইয়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তার ফাঁসির আদেশ হয়। ফাঁসির আসামি হয়েও জেল থেকে ছাড়া পান তিনি।
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সান্নিধ্য ও তদবির কাজে লাগিয়ে ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মুড়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বনে যান তিনি। ৫ আগস্টের পর আলমাছ পলাতক। মাছিমপুরের মাদক ও অবৈধ অস্ত্র কারবারি, লুটপাট, চাঁদাবাজি, হত্যার হুমকি, ইয়াবা কারবারি মো. মামুন মিয়া। তার বিরুদ্ধেও রূপগঞ্জ থানায় আছে বেশ কিছু মামলা।
মাছিমপুরের মাদক, ইয়াবা ও অবৈধ অস্ত্র কারবারি, লুটপাট, চাঁদাবাজি, হত্যার হুমকিদাতা মোহাম্মদ রনি মিয়া। রূপগঞ্জ থানার এজাহারভুক্ত আসামি তিনি। এমদাদ বাহিনীর এই সদস্যও ৫ আগস্টের পর গা-ঢাকা দিয়েছেন।
এভাবেই গত বছরের ৫ আগস্টের আগে গোটা রূপগঞ্জে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল এমদাদ বাহিনী। আওয়ামী লীগের পতনের পর এখন এরা বেশির ভাগই পলাতক। এলাকাবাসী তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে। গাজীর ছত্রছায়ায় রূপগঞ্জে এমদাদ বাহিনীর ভয়ংকর স্মৃতি এখনো স্মরণ করে আতঙ্কে ওঠে এলাকাবাসী। এমদাদ শুধু রূপগঞ্জেই নন, তার স্থায়ী ঠিকানা সিরাজগঞ্জেও ছিলেন ত্রাস। তিনি সিরাজগঞ্জ-৫ (বেলকুচি-চৌহালী) থেকে সংসদ নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বলে জানা গেছে।


