Logo
Logo
×

বিশেষ সংবাদ

আজমেরীর ‘পাগলা হামিদের’ কাঁধে জাকির খানের হাত

Icon

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম

আজমেরীর ‘পাগলা হামিদের’ কাঁধে জাকির খানের হাত

আজমেরীর ‘পাগলা হামিদের’ কাঁধে জাকির খানের হাত

Swapno

সম্প্রতি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী শাসনামলের কুখ্যাত সন্ত্রাসী হামিদ প্রধান ওরফে পাগলা হামিদের সাথে সাবেক জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাকির খানের হাস্যেজ্জ্বল ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। পাগলা হামিদ দুর্ধর্ষ ওসমান পরিবারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। প্রয়াত সাবেক সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমানের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য পাগলা হামিদের বিশেষ কুখ্যাতি ছিল।


আজমেরী ওসমানের ক্যাডার কী করে সাবেক ছাত্রদল নেতা জাকির খানের দ্বারস্থ হলেন এবং আশ্রয় পেলেন এনিয়ে তীব্র সমালোচনা তৈরি হয়েছে। চলতি বছর দীর্ঘদীন পরে কারামুক্ত হয়ে বিএনপি নেতা জাকির খান যে ক্লীন ইমেজ তৈরির পথে হাঁটছিলেন, সেটিতে সন্ত্রাসী পাগলা হামিদের সাথে তার ভাইরাল হওয়া ছবি ইমেজ সংকটে ফেলেছে বলে মত রাজনৈতিক বোদ্ধাদের।


আজমেরী ওসমানের কুখ্যাত সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত পাগলা হামিদের কাঁধে জাকির খানের হাত রাখাকে মোটেও ভালো চোখে দেখছেন না সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক বোদ্ধারা। কী করে বিএনপি নেতা জাকির খানের সান্নিধ্য পেল কুখ্যাত পাগলা হামিদ তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।


জানা গেছে, এক সময় পাগলা হামিদ ছিলেন সামান্য কভার্ডভ্যান চালক। ফতুল্লার পঞ্চবটির এবি ভেজিটেবলের পিকআপ ভ্যান চালাতেন তিনি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি কৌশলে সাবেক সাংসদ প্রয়াত কবরীর বলয়ে গিয়ে নিজের তরী ভিড়িয়ে ছিলেন। সেই থেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠেন পাগলা হামিদ।


বেশ কয়েক বছর পর তিনি ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফ উল্লাহ বাদলের সাথে গিয়ে মিশেন। শুরু করেন কবরী বিরোধী কর্মকাণ্ড। এক পর্যায়ে সাইফ উল্লাহ বাদলের নির্দেশে মেয়র আইভীর ছবি বিকৃত করে বিভিন্ন ফেস্টুন তৈরী করে এনায়েতনগরের বিভিন্ন স্থানে সাটিয়ে দেয় এই পাগলা হামিদ।


সাইফ উল্লাহ বাদলের বলয়ে থাকাবস্থায় সাজনুর বলয়ে গিয়ে ভিড়ে ছিলেন হামিদ। সাজনুকে পল্টি দিয়ে এরপর শাহ নিজামের বলয়ে থেকেও চাদনী হাউজিং এলাকায় নানা অপকর্ম করে বেড়াতেন তিনি। গড়ে তুলেছেন চাঁদনী হাউজিংয়ে বিশাল আলীশান অট্টালিকা। এমন কোনো অপকর্ম নেই যা হামিদের দ্বারা সংগঠতি হয়নি। শেষ পর্যন্ত তিনি নারায়ণগঞ্জের ত্রাস ও শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমানের বলয়ে গিয়ে পুরোদমে শুরু করেছিলেন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড।


২০২৪ সালের ৫ আগষ্টের পর আওয়ামী লীগের অনেক সন্ত্রাসীও আজমেরী বাহিনীর ক্যাডাররা পালিয়ে গেলেও,এলাকার একজন শিল্পপতির নির্দেশে ও শেল্টারে হামিদ নিজের বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। সেই পাগলা হামিদ ২০২৪ সালের ১৫ অক্টোবর যৌথ বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন।


আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ” এমন একটি প্রবাদ বাক্য রয়েছে। এই প্রবাদ বাক্যটি পাগলা হামিদের বেলায় শতভাগ প্রযোজ্য। মাত্র ২০ বছর আগেও যিনি পেটের দায়ে পিকআপ ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সেই হামিদ ক্ষমতাসীন দলের হয়ে ফতুল্লা অঞ্চলে বিভিন্ন সেক্টরে অপকর্ম করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ। ২০০৫ সালেও হামিদ ছিলেন সামান্য একজন গাড়ি চালক।


২০০৭ সালে তিনি আওয়ামী লীগের দলে গিয়ে ভিড়েন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর হামিদ সাংসদ কবরীর ক্যাডারদের সাথে  গিয়ে মিশে যান। শুরু করেন চাঁদনী হাউজিং এলাকায় রাম রাজত্ব। হাউজিং ও এর আশপাশে  তৈরী করেন নিজের একটি বাহিনী। চাঁদনী হাউজিং মানেই পাগলা হামিদের রাজত্ব। এই রাজত্বে অন্য কেউ প্রবেশ ছিলো সম্পূর্ন নিষিদ্ধ। হাউজিংয়ে কোনো প্লট বা বাড়ি বিক্রি করতে হলে হামিদের কাছেই তা বিক্রি করতে হতো। হাউজিংয়ের  ইন্টারনেট থেকে শুরু করে তিতাসের অবৈধ গ্যাস সংযোগ সব কিছু ছিলো হামিদের নিয়ন্ত্রণে।

পাগলা হামিদের উত্থান


এক সময়ে কবরীর বলয়ে থাকা হামিদ প্রধান কবরীর মেয়াদ শেষ হওয়ার কিছুদিন আগে পাড়ি জমান ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফ উল্লাহ বাদলের ডেরায়। সে সময় বাদলকে বহনকারী ট্যাক্সিও চালাতেন তিনি। কবরী ক্ষমতায় থাকাবস্থায় তৎকালীন নাারয়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান আইভীর সাথে শামীম ওসমানের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে।


এসময় বাদলের নির্দেশে হামিদ পঞ্চবটি ও এর আশপাশের এলাকায় আইভীর ছবিকে বিকৃত করে বিভিন্ন ব্যানার ফেস্টুন সাঁটানোর দায়িত্ব পালন করেন। তখন বাদলের সাথে সখ্যতার কারণে শামীম ওসমানের কাছাকাছি যেতে পেরেছিল হামিদ।


এরপর শামীম ওসমান ক্ষমতায় আসলে সাইফউল্লাহ বাদলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে শুরু করেন বিভিন্ন অপকর্ম। সে সময় চাঁদনী হাউজিং এলাকায় হামিদ ৩ থেকে ৪’শ অবৈধ গ্যাস সংযোগ প্রদান করেন। প্রতিমাসে এসমস্ত অবৈধ সংযোগের সমস্ত টাকাই পাগলা হামিদ নিজের পকেটে পুরতেন।


তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলে হামিদ ও তার বাহিনীর লোকজন তাদের হামলা করতেন। অপরদিকে হাউজিংয়ের প্লট বা বাড়ি বিক্রি করতে হলে হামিদের কাছেই বিক্রি করতে হতো। আর হামিদ সেই ফ্ল্যাট বা বাড়ি অন্যত্র চড়া দামে বিক্রি করতেন। কেউ বাড়ি নির্মাণ করতে গেলে সমস্ত নির্মাণ সামগ্রী তার কাছ থেকেই নিতে হতো।


সূত্র আরো জানায়, হাউজিং এলাকায় বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাটে বিভিন্ন বয়সের তরুণীদের রাখতেন হামিদ। আর ফতুল্লা থানাসহ ডিবির বিভিন্ন অফিসারদের ঐ সমস্ত তরুনীদের দিয়ে অফিসারদের মনোরঞ্জন করাতেন। এর ফল স্বরুপ বিভিন্ন কাজ বাগিয়ে নিতেন তিনি। আর এভাবেই হামিদের অপরাধ জগৎ বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে।


সূত্র আরো জানায়, সাইফ উল্লাহ বাদলের কথা মতো হামিদ এক সময় গিয়ে ভিড়ে ছিলেন শামীম ওসমানের আস্থাভাজন শাহাদাৎ সাজনুর বলয়ে । শুরু করেছিলেন বিভিন্ন বিরোধপূর্ণ সম্পত্তি কেনা বেচার কাজ। সেখান থেকে পল্টি দিয়ে পরবর্তীতে তিনি শামীম ওসমানের আরেক সাগরেদ শাহ নিজামের হয়ে কাজ শুরু করেন। সেখান থেকেও তিনি নানা রকম সুবিধা ভোগ করতে শুরু করেন। এরপরই আজমেরী ওসমানের বাহিনীর দ্বারা বিভিন্ন স্থানে বাধার সম্মুখিন হয়েছিলেন তিনি। বিশেষ করে তেল চোর পাবেলের দ্বারা বিভিন্নভাবে হুমকির সম্মুখিন হয়েছিলেন পাগলা হামিদ।

 যেভাবে আজমেরী ওসমানের সেকেন্ড ইন কমান্ড হলেন হামিদ
 
আজমেরী বাহিনীর দ্বারা হুমকি ধামকির সম্মুখিন হওয়ার পর হামিদ পথ খুঁজছিলেন কিভাবে আজমেরীর কাছাকাছি যাওয়া যায়। আর সেই সুযোগও হয়ে যায় তার। একটি বিরোধপূর্ণ সম্পত্তির দখল নিতে গিয়ে হামিদ স্মরণাপন্ন হয়েছিলেন পিজা শামীমের। পিজা শামীম নিজে আজমেরীর কাছে হামিদকে নিয়ে যান।


আর সেই সম্পত্তির ব্যাপারে আজমেরী সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। আর এখান থেকে মোটা অংকের টাকা হামিদের মাধ্যমে নিয়ে নেয় আজমেরী। বিভিন্ন সেক্টর থেকে অবৈধ টাকা আনার মেশিনে পরিণত হয় পাগলা হামিদ। এক পর্যায়ে পিজা শামিমকে হটিয়ে হামিদ আজমেরীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠে বিভিন্ন সেক্টরে।


বিসিকের একজন ঝুট সন্ত্রাসীকে হটিয়ে হামিদ সেখানে ইন করতে চেয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত ঐ ঝুট সন্ত্রাসীকে না সরিয়ে সেখান থেকে কোটি টাকা আদায় করে আজমেরীকে দিয়ে ছিল সে। পাগলা হামিদ মানেই আজমেরী এমন একটি কথা পুরো নারায়ণগঞ্জ ও এর আশপাশে চাউর হয়ে যায়। বিভিন্ন সন্ত্রাসীরা আজমেরীর অবস্থান হিসেবে পাগলা হামিদকেই সম্মান করতে থাকে।


হামিদ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আজমেরী থাকলে কোনো রাজনৈতিক নেতার প্রয়োজন নেই বলেও দম্ভোক্তি করতেন। বিভিন্ন বিচার শালিশে আজমেরীর দেয়া একটি লাইসেন্স বিহীন অস্ত্রও প্রদর্শণ করতো প্রভাব বিস্তারের জন্য। ফতুল্লায় বিভিন্ন সেক্টরে হামিদ আতংক এক বছরে ছড়িয়ে পড়ে।


পতিত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বিএনপির ব্যবসায়ীরা পর্যন্ত হামিদের কারণে শান্তি পায়নি। বিভিন্নভাবে আজমেরীর দরবারে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের নিয়ে গিয়ে হাজির হতেন তিনি। মানুষদের জিম্মি করে মোটা অংকের টাকা হামিদের মাধ্যমে হাতিয়ে নিতেন আজমেরী। এতোটাই আজমেরীর কাছাকাছি তিনি হয়ে গিয়েছিলেন আজমেরীর গাড়ীর পিছনেই তাকে বসতে দেখা যেতো।


বিশাল আজমেরী বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতেন হামিদ, ইসদাইরের নাসির ও সিদ্ধিরগঞ্জের আমির। তবে তাদের মধ্যে হামিদ ছিলো সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী। ফতুল্লার ঝুট, পরিবহন, অবৈধ গ্যাস সংযোগ, বিরোধপূর্ণ সম্পতি দখল করাসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা হামিদের দ্বারা সংগঠতি হয়নি বলে বিভিন্ন সূত্রের দাবী।


২০২৪ সালের ৫ আগষ্টের আগে ফতুল্লার বক্তাবলীর ইউপি মেম্বার রশিদকে ধরে নিয়ে যেতে হামিদ লোকজন নিয়ে দিনে দুপুরে রশিদ তার বাড়ি ঘেরাও করে। উদ্দেশ্য ছিলো রশিদকে ধরে নিয়ে যেতে পারলে কয়েক কোটি টাকা আদায় করা। কিন্তু ব্যাটে বলে না মিলার কারণে রশিদকে ধরে নিয়ে যেতে পারেনি আজমেরীর টর্চারশেলে ।
 

৫ আগষ্টের পর গ্রেপ্তার হন দুর্ধর্ষ হামিদ


২০২৪ সালের ৫ আগষ্ট গণঅভ্যূত্থানের পর ফতুল্লায় আওয়ামী লীগ বা আজমেরী বাহিনী গা ঢাকা দিলেও নিজ এলাকায় নিজের বাড়িতেই ছিলেন পাগালা হামিদ। ৬ আগষ্ট পাগলা হামিদের বাড়িতে লোকজন হামলা করতে গেলে এলাকার একজন শিল্পপতির নির্দেশে হামিদকে কেউ কিছু বলেনি। এমনকি হামিদের আলীশান বাড়ি ভাংচূড়ের নির্দেশ থাকলেও ঐ শিল্পপতি ও তার লোকজনদের কারনে তার বাড়িটি সুরক্ষিতই থাকে।


আর হামিদ এলাকাই অবস্থান করে। পরে ২০২৪ সালের ১৫ অক্টোবর যৌথ বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয় সেই শীর্ষ সন্ত্রাসী পাগলা হামিদ। এখন জামিনে ছাড়া পেয়েছেন।

Abu Al Moursalin Babla

Editor & Publisher
ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন